কৃষি শিক্ষা
কৃষি শিক্ষা হল কৃষি বিষয়ক বিজ্ঞান, ব্যবসা ও প্রযুক্তিসহ ভূমি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থী, কৃষক কিংবা যেকোনও ব্যক্তির জন্য লভ্য প্রণালীবদ্ধ ও সুসংগঠিত তাত্ত্বিক শিক্ষণ ও ব্যবহারিক মাঠ-পর্যায়ের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ।[১]
কৃষি শিক্ষা বিভিন্ন স্থানে প্রদান করা হতে পারে।[২] অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে এটি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এছাড়া তৃতীয়-পর্যায়ের অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মমুখী কারিগরি বিদ্যালয়গুলিতেও এটির ব্যবস্থা থাকতে পারে। এছাড়া যুব সংগঠন, খামারে শিক্ষানবিশি, কৃষি কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ অধিবেশন, কৃষি প্রদর্শনী ও মেলা, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারি মন্ত্রণালয় ও সংস্থা, অলাভজনক সংস্থা, ইত্যাদি কৃষি শিক্ষার উপকরণ সামগ্রী ও হাতে-কলমে শেখার বন্দোবস্ত করে দিতে পারে। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলিতে যেসব ব্যক্তির প্রবেশাধিকার নেই এবং যাদের গৎবাঁধা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ নেই, তাদের জন্য সম্প্রতি আন্তর্জাল (অনলাইন) শিক্ষণ ও দূরশিক্ষণ কর্মসূচিগুলি উত্তরোত্তর বেশি প্রাসঙ্গিকতা লাভ করছে। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমগুলিতে কৃষি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল খামার ও কৃষিখাতে চাকুরি ও কর্মজীবনের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে প্রস্তুত করা।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত ভূমি ব্যবস্থাপনার সাধারণ মূলনীতি (ভূমির ব্যবহার ও টেকসই কৃষির জন্য ভূমি সংরক্ষণ), কৃষি অর্থনীতিবিদ্যার মূলনীতি (চাহিদা ও যোগান, মূল্য নির্ধারণ, বাজার বিশ্লেষণ ও অন্যান্য আর্থিক দিক), মৃত্তিকা বিজ্ঞান (মৃত্তিকার গঠনপ্রক্রিয়া, ধরন, গঠনবিন্যাস, বুনট, তাপমাত্রা, উর্বরতা, ক্ষয় ও সংরক্ষণ, জল নিষ্কাশন ও সেচ, জলচক্র), উদ্ভিদের বৃদ্ধির মূলনীতি (উদ্ভিদ শারীরবিদ্যা ও খাদ্য ও পুষ্টি পরিবহন, প্রজনন ও অংকুরোদ্গম), শস্য উৎপাদন (ভূমি প্রস্তুতকরণ, অর্থকরী শস্য চাষ, শস্য নির্বাচন, রোপন ও রক্ষণাবেক্ষণ), শস্য সুরক্ষা (আগাছা, বালাই ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও কৃষি রাসায়নিকের দায়িত্বশীল ব্যবহার), গবাদি পশুর শারীরস্থান ও শারীরবিদ্যা (রোমন্থক ও অ-রোমন্থক প্রাণীদের হজম প্রক্রিয়া, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যৌন প্রজনন), গবাদি পশু উৎপাদন (গবাদি পশুর আবাসন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যরক্ষা, যাতে তারা সুস্থ থাকে ও কাম্যতম মাত্রায় উৎপাদন করে), চারণভূমি ব্যবস্থাপনা (ব্যাপক ও নিবিড় চারণভূমি ব্যবস্থাপনা, যাতে তৃণভোজন এলাকাটি সুস্থ থাকে), গবাদিপশু ও শস্য প্রজনন (বংশাণুবিজ্ঞান ও প্রজননের মূলনীতি, যার মধ্যে একসংকর উত্তরাধিকার, নৈর্বাচনিক প্রজনন, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত), খামারের অপরিহার্য ভবন, স্থাপনা ও সরঞ্জাম (বেড়া, খামার ভবন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি)।
যেসব ছাত্র মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে ইচ্ছুক, তাদেরকে আরও গভীর ও কেন্দ্রীভূত শিক্ষা প্রদান করা হয়, যাতে তারা বিশেষায়িত ক্ষেত্র যেমন পশু বিজ্ঞান (দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদি পশু, ভেড়া, হাঁস-মুরগী, ইত্যাদি গৃহপালিত পশুপাখিদের শারীরবিদ্যা, পুষ্টি, প্রজনন ও স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক), খাদ্য বিজ্ঞান (টেকসই খাদ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্যের শারীর-রাসায়নিক ও জৈব দিক, ইত্যাদি), বংশাণুবিজ্ঞান (প্রাণী ও উদ্ভিদ বংশাণুবিজ্ঞান ও বংশাণুসমগ্রবিজ্ঞান এবং পশু প্রজনন ও জৈবপ্রযুক্তিতে এগুলির প্রয়োগ), আন্তর্জাতিক কৃষি (আন্তর্জাতিক কৃষি বাণিজ্য, বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা, পানি ও শক্তি বিষয়ক সমস্যাদি, বিভিন্ন অঞ্চলে শস্য উৎপাদন ব্যবস্থার বিভিন্নতা, ইত্যাদি), কৃষিখামার ব্যবসা ব্যবস্থাপনা (বাজেট নির্ধারণ, বিপণন, পরিকল্পনা ও অন্যান্য দক্ষতা যেগুলি কৃষি কর্মকাণ্ডের আর্থিক ও ব্যবসায়িক দিকগুলি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন), টেকসই ও জৈব কৃষি ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করে। উদ্যানবিদ্যা, ক্ষুদ্র প্রাণীকল্যাণ, চাপড়া ঘাস ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদিও শেখানো হতে পারে।
কৃষি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যগুলি হল ভবিষ্যৎ কৃষক ও কৃষি বিষয়ক পেশাদারদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতকরণের মাধ্যমে কৃষিখাতের জন্য একটি দক্ষ শ্রমশক্তি নির্মাণ করা, টেকসই ও দায়িত্বশীল কৃষিচর্চাকে উৎসাহিত করা, খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা, সর্বাধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভাবক ও নেতাদের বিকাশ সাধন করা, কৃষি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা ও উপলব্ধি উন্নত করা, যাতে খাদ্যের উৎস ও ব্যাপকতর ভোক্তা সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস পায়, গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা এবং নগরবাসী সম্প্রদায় ও গ্রামীণ কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে সংযোগ শক্তিশালী করা।
ঐতিহাসিকভাবে কৃষি কৌশল ও জ্ঞান কথ্য ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হত। ১৯শ শতকের শুরুতে পশ্চিম ইউরোপে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে এবং ঐ শতাব্দীর মধ্যভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোরিল আইনগুলি পাশের মাধ্যমে একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক বিষয় বা শাস্ত্র হিসেবে কৃষি শিক্ষা এক ধরনের সুসংগঠিত, বিধিবদ্ধ রূপ লাভ করে। এর পরের বছরগুলিতে এটির আওতায় ধীরে ধীরে প্রাণী, উদ্ভিদ, শস্য, মৃত্তিকা, ব্যবসা, খাদ্য, ভূমি বা জমি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কিত অনেকগুলি বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র স্থান পায়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কৃষি শিক্ষাতে আধুনিক প্রযুক্তি, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলি অঙ্গীভূত করা হয়েছে। যেসব সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উন্নতিগুলি কৃষি শিক্ষায় অধ্যয়ন করা হচ্ছে, সেগুলির মধ্যে সুনির্দিষ্ট কৃষিকাজের সমন্বয়, জৈবপ্রযুক্তি, উন্নত যন্ত্রপাতি এবং উপাত্ত-নির্ভর পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদনের মাত্রা কাম্যতমকরণ, সম্পদের অপচয় হ্রাস, সামগ্রিক কর্মদক্ষতার উন্নতি ও পরিবেশের উপর কৃষির নেতিবাচক প্রভাব ন্যূনতমকরণ, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতে আন্তর্জালে বা ইন্টারনেটে কৃষি শিক্ষাগ্রহণ, আন্তঃশাস্ত্রীয় গবেষণা, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং কৃষিখাতে বিভিন্ন ধরনের পেশার কর্মজীবনে সুযোগ বৃদ্ধি, ইত্যাদি কৃষিখাতের উদীয়মান সমস্যাগুলির সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।