এন্টনী ফিরিঙ্গী

সুনীল বন্দোপাধ্যায় পরিচালিত ১৯৬৭ সালের ভারতীয় জীবনীনির্ভর চলচ্চিত্র

এন্টনী ফিরিঙ্গী সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ১৯৬৭ সালের ভারতীয় জীবনীনির্ভর সঙ্গীতধর্মী নাট্য চলচ্চিত্র। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার এবং তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন তনুজা। এটি পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত বাংলা ভাষার লোক কবি এন্টনী ফিরিঙ্গীর জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র। এন্টনী ফিরিঙ্গী একজন পর্তুগিজ ভারতীয় বাংলা ভাষার কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ, যিনি নিরুপমার প্রেমে পড়েন। নিরুপমা তার নিজের জীবনের বিষাদময় ঘটনা প্রকাশপূর্বক তাকে বিয়ে করতে রাজি হন। কিন্তু এন্টনীর খ্যাতিও তাদের সমাজচ্যুত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেনি এবং তাদের জীবনে পুনরায় দুঃখ নেমে আসে।

এন্টনী ফিরিঙ্গী
পরিচালকসুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রযোজকবি. এন. রায়
রচয়িতাসুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রেষ্ঠাংশে
সুরকারঅনিল বাগচী
চিত্রগ্রাহকবিজয় ঘোষ
সম্পাদকরাসবিহারী সিংহ
প্রযোজনা
কোম্পানি
বি. এন. রায় প্রোডাকশন্স
পরিবেশকছায়ালোক প্রাইভেট লি.
মুক্তি৬ অক্টোবর ১৯৬৭
স্থিতিকাল১৫৭ মিনিট
দেশভারত
ভাষাবাংলা

চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর কবি এন্টনী বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।[১] উত্তম কুমার এই চরিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া চলচ্চিত্রটি এর সঙ্গীতের জন্য উল্লেখযোগ্য, বিশেষত মান্না দেসন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ, অনিল বাগচীর সুর এবং গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গীতের জন্য।

কাহিনি সংক্ষেপ সম্পাদনা

হান্সমান এন্টনী একজন পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত যুবক। তার ঠাকুরদা পর্তুগিজ ছিলেন। তিনি এক বাঙালি মহিলাকে বিয়ে করে বাংলায় স্থায়ী হন। পৈতৃকসূত্রে অগাধ সম্পত্তি পেলেও এন্টনীর ভবঘুরে এবং গান ভালোবাসেন। উচ্চ সমাজের পার্টি ও গান তার পছন্দ নয়। মারিনা তার পাণিপ্রার্থী। মারিনার বাড়িতে এক পার্টিতে সে মারিনাকে অপমান করে বাড়ি ফিরে আসে। তার ভাই কেলী বাড়ি ফিরে তাকে এবং তার মাকে কথা শোনায়। এক পর্যায়ে তার মা মারা যায়। কেলী বাংলার সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পর্তুগালে ফিরে যায় এবং এন্টনীর জন্য লবণের ফ্যাক্টরি রেখে যায়।

মায়ের মৃত্যুর পরও এন্টনীর বন্ধুরা এন্টনীকে নিয়ে বাঈজী শাকিলা বেগমের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু এন্টনী বিদেশি সাহেব বলে শাকিলা তাদের গান শুনাতে অস্বীকৃতি জানায়। ফিরে আসার পথে এন্টনী শাকিলার সুরে মুগ্ধ হয়। পরের দিন সে পুনরায় শাকিলার নিকট তার গান শুনতে আসে। সেদিনও শাকিলা তাকে ফিরিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে মারিনা তার সাথে দেখা করতে আসে এবং তাকে এক পার্টিতে নিমন্ত্রণ করতে আসে। এন্টনী সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। সে শাকিলার জলসাঘরের পাশের বাগানে দাঁড়িয়ে তার গান শুনে।

কয়েকদিন পর পাড়ার জমিদার বাড়িতে লখনৌ থেকে বাঈজী আসে। বন্ধুরা এন্টনীকে নিয়ে তার গান শুনতে যায়। গান শুনে জমিদার বাঈজী প্রশংসা করলেও এন্টনীয় ওঠে দাঁড়িয়ে বলে তার গানে দরদ নেই। সকলের অনুরোধে সে নিজেই শাকিলার কাছ থেকে শোনা একটি গান গায়। সকলেই তার গানের গলার প্রশংসা করে। শাকিলার দাসী আমিনা সেই জলসাঘরে তার গান শুনে শাকিলাকে গিয়ে জানায়। শাকিলা আমিনাকে এন্টনীকে একদিন নিমন্ত্রণ জানাতে বলে। এন্টনী শাকিলার সাথে দেখা করতে গেলে এন্টনী শুনেই কীভাবে গানটি শিখে নিয়েছে তাতে অবাক হয়।

শাকিলার এন্টনীকে ভালো লাগে। সে এন্টনীকে জানায় তার প্রকৃত নাম নিরুপমা। এক হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে। তার পিতা তাকে বুড়ো এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর সহমরণ প্রথা অনুসারে তার স্বামীর সাথে তাকেও মরতে হতো। সে রাতে তার পুরনো প্রেমিক হরিপদ তাকে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং লম্পট হিসেবে কুখ্যাত হরিপদ তার একাকীত্বের সুযোগ নেয়। তারপর তাকে কলকাতায় এক বাঈজীর কাছে বেচে দেয়। সেখান থেকে জমিদার তাকে কিনে নিয়ে আসে। ইতোমধ্যে তাদের দুজনের একত্রে গানরত অবস্থায় জমিদার এসে এন্টনীকে চাবুকপেটা করে। নিরুপমা জানায় জমিদারের সেই অধিকার নেই এবং তারা দুজনে নতুন করে সংসার শুরু করতে সেখান থেকে দূরে ফরাশডাঙ্গায় চলে যায়।

ফরাশডাঙ্গায় এন্টনী কবিগানের এক আসরে গিয়ে কবিগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে কবিগানের গুরু ভোলা ময়রার কাছে তালিম নিতে কলকাতায় যায়। কিন্তু সেখানে তাকে পায় না কারণ সে ময়মনসিংহে গান করতে গেছে। কিছুদিন পর তার আসরে গিয়ে হাজির হয় এন্টনী। ভোলা তাকে জানায় কবিগানের জন্য সাধনা করতে হয়, শাস্ত্র জানতে হয়। সে অপর এক কবিয়ালের কাছে যায়। এই কবিয়াল তাকে বাংলা উচ্চারণ শুদ্ধ করার কথা বলে। এদিকে নিরুপমা এন্টনীর অনুপস্থিতিতে তার গয়না বিক্রি করে সংসার চালায়। এক রাতে হরিপদ তার ঘরে আসে এবং তাকে পুনরায় তার কাজে ফিরে যেতে বলে। নিরুপমা তাকে শাসিয়ে বিদায় করে। ইতোমধ্যে এন্টনী ফিরে আসে এবং জানায় সে নিজেই কবিগানের দল করবে। সে ধর্ম-শাস্ত্র ইত্যাদি সমস্ত বিদ্যা অর্জন করে।

এখন এন্টনী একজন কবিয়াল। সে বিভিন্ন স্থানে কবিগানে অংশগ্রহণ করে। কয়েকজন কবিয়ালকে তার বিদ্যা ও গান দিয়ে কুপোকাত করে। কিন্তু ভোলা ময়রার কাছে সে পরাজিত হয় এবং তাকে তার কণ্ঠহার পড়িয়ে দিয়ে তাকে সম্মান জানায়। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখে তার ঘরে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ঘরে ঢুকে সে নিরুপমাকে উদ্ধার করে, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। শেষ দৃশ্যে তার স্বগতোক্তি শোনা যায় - "পৃথিবীতে যারা শিল্পী, যারা স্রষ্টা - তারা চিরকাল এভাবে নিরুপমাদের খুঁজে বেড়িয়েছে তাদের সৃষ্টির মধ্যে। যুগ যুগ ধরে তাদের কণ্ঠে কেবল এই কথাই ধ্বনিত হয়েছে - তোমাকে আমরা ভুলি নাই, তোমাকে আমরা ভুলতে পারি না।"

কুশীলব সম্পাদনা

সঙ্গীত সম্পাদনা

এন্টনী ফিরিঙ্গী চলচ্চিত্রটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন অনিল বাগচী। অলোকনাথ দে এর সহযোগী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। এই চলচ্চিত্রে কয়েকটি গান সমালোচনামূলক ও বাণিজ্যিকভাবে সফলতা লাভ করে। এই চলচ্চিত্রের গীত রচনা করেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, প্রণব রায়, ভোলানাথ নায়েক ও ঠাকুরদাস সিংহ। এন্টনী ফিরিঙ্গীরর গানও চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয় এবং কবিগানের মূল রচনার পদ পূরণ করেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

এই চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মালবিকা কানন, রুমা গুহঠাকুরতা, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অধীর বাগচী, অলোক বাগচী, চিত্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল চক্রবর্তী, সলিল মিত্র, ছায়া দে, ও স্বপ্না রায়।

পুরস্কার সম্পাদনা

উত্তম কুমার ১৫তম চলচ্চিত্র পুরস্কারে এন্টনী ফিরিঙ্গী চরিত্রে তার অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Mr & Mrs Antony Firingee"দ্য টেলিগ্রাফ। ৪ আগস্ট ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০২০ 
  2. "National Awards for Films: Uttam Kumar (1967)" (পিডিএফ)। চলচ্চিত্র উৎসব অধিদপ্তর। ২৫ নভেম্বর ১৯৬৮। পৃষ্ঠা 29। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০২০ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা