আচ্ছাদন তন্ত্র
আচ্ছাদন তন্ত্র (ইংরেজি: Integumentary system) মানবদেহের একটি তন্ত্র। এটি মানবদেহের বাহ্যিক অঙ্গসমূহ আচ্ছাদন করে রাখে, দেহের অবয়ব রক্ষা করে। রাসায়নিক ও যান্ত্রিক বাধার মাধ্যমে শরীরকে রক্ষা করে।এছাড়া দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ,অতিবেগুনী রশ্মি হতে রক্ষা করা (মেলানিন) এর কাজ। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ভিটিমিন ডি উৎপাদন দেহের চামড়া বা ত্বক করে থাকে।
ত্বক
সম্পাদনাত্বক আচ্ছাদন তন্ত্রের একটি অঙ্গ আরও থাকে
- ধমনী
- শিরা
- চুল
- নখ
- স্নায়ু
ত্বক শরীরের বৃহত্তম অঙ্গগুলির মধ্যে একটি। মানুষের ক্ষেত্রে, এটি শরীরের মোট ওজনের প্রায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ এবং পৃষ্ঠীয় ক্ষেত্রফলের ১.৫ থেকে ২ মি২ জুড়ে থাকে। [১]
ত্বক তিনটি স্তরে বিভক্ত:[২]
- ইপিডার্মিস ..বাইরের স্তর
- ডার্মিস ..ভেতরের স্তর
- সাবকিউটেনিয়াস কলা
ডার্মিসের নিচের সাবকিউটেনিয়াস কলা নিম্নবর্তী পেশী, কলা এবং অন্যন্য অঙ্গকে রক্ষা করে। এই কলা অনেক তন্তু ও এ্যাডিপোস (মেদ) কোষ দ্বারা গঠিত। তন্তুগুলো ডার্মিস হতে সাবডার্মিস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে তাদের পরস্পরের বাঁধন মজবুদ করে এবং স্থিতিস্থাপকতা দেয়। ত্বকের উপরের চুল দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণে এবং ক্ষতিকারক বন্তুকণা হতে রক্ষা করে।
ত্বকের গ্রন্থিগুলো হলো:
- ঘর্মগ্রন্থি (সুডোরিফেরাস গ্রন্থি হিসাবেও পরিচিত) – ঘাম নিষ্ক্রমণের মাধ্যমে দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে
- সেবাশিয়াস গ্রন্থি - তেল উৎপাদন করে যার দ্বারা ত্বক এবং চুল আর্দ্র ও মোলায়েম থাকে
- সেরুমিনাস গ্রন্থি – কর্ণ গহ্বরের গ্রন্থি যা কানের খোল তৈরি করে
- স্তন গ্রন্থি - দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি যা স্তনে অবস্থিত।
স্তর সমূহ
সম্পাদনাইপিডার্মিস
সম্পাদনাইপিডার্মিস ত্বকের বহিস্থঃ পাতলা স্তর যেখানে মেলানিন থাকে। এই মেলানিন ত্বকের রঙ নির্ধারণ করে এবং রোদে ত্বককে কালো করে। ক্যারোটিন ও অক্সিজেন-পূর্ণ হিমোগ্লোবিণও ত্বকের রঙের জন্য দ্বায়ী। ক্যারাটিন নামক আমিষ দ্বারাও ইপিডার্মিস আবৃত থাকে যা ইপিডার্মাল কলাকে শক্ত করে আঙ্গুলের নখ তৈরি করে। এর সর্ববহিস্থঃ স্তরে ২৫-৩০ স্তর বিশিষ্ট মৃত কোষের আবরণ থাকে। অন্যান্য স্তরগুলো হলো:
- আঁশালো কোষ ত্বকের বহিঃতল তৈরি করে
- মেলানোসাইট ত্বকের রঙ নির্ধারণ করে
- ল্যাঙ্গারহেন্স কোষ অস্থিমজ্জায় তৈরি হয় এবং রোগসংক্রমণ হতে রক্ষা করে
এটি নিম্নক্ত উপস্তরে বিভক্ত:
উপস্তর সমূহ
সম্পাদনাইপিডার্মিস নিম্নক্ত ৫টি উপস্তর বা স্ট্র্যাটায় বিভক্ত:
- স্ট্র্যাটাম কর্ণিয়াম..৫ম ও সর্ববহিস্থঃ স্তর। সাইটোপ্লাজমে ক্যারাটিন (পানিনিরোধী আমিষ) থাকে এবং কোষগুলো মৃত।
- স্ট্র্যাটাম লুসিডাম..একটি ইলেডিন সম্মৃদ্ধ পাতলা স্তর। ইলেডিন একধরনের সচ্ছ পদার্থ যা ক্যারাটোহায়ালিন কণা হতে উৎপন্ন হয়। এই স্তর সকলের ত্বকে থাকে না।
- স্ট্র্যাটাম গ্র্যানুলোসাম..সাধারণত ৩ থেকে ৫ কোষ পুরু। সাইটোপ্লাজমে ক্যারাটোহায়ালিন কণা থাকে।
- স্ট্র্যাটাম স্পাইনোসাম..(কন্টক কোষ স্তর) কয়েক স্তর কোষ পুরু। কোষগুলো সাধারণত অসম বা সুচালো আকৃতির।
- স্ট্র্যাটাম ব্যাজালি..সর্বঅন্তস্থঃ কোষ স্তর। এরা মাইটোসিসের (কোষ বিভাজন) মাধ্যমে নতুন ইপিডার্মাল কোষের জন্ম দেয়।
এছাড়াও এর মধ্যে মেকার সেল,এবং মেলানোসাইট কোষ থাকে.যা আমাদের দেহের রং নির্ধারণ করে
ডার্মিস
সম্পাদনাডার্মিস ত্বকের সবচেয়ে নিচের, পুরু স্তর। এটি রক্ত নালী, যোজক কলা, স্নায়ূ, লসিকা গ্রন্থি, ঘর্মগ্রন্থি এবং চুলের গোড়ার সমন্নয়ে গঠিত। এটি দুটি প্রধান স্তরে বিভক্ত:
- প্যাপিলারি স্তর: এখানে স্পর্শ রিসেপ্টর বিদ্যমান যারা কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের সংগে যুক্ত। এছাড়া এরা আঙ্গুলের ছাপ তৈরি করে। প্যাপিলার মাধ্যমে এরা ইপিডার্মিসের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
আচ্ছাদন বা ত্বক-তন্ত্রের উৎপত্তি এবং কাজ
সম্পাদনাআচ্ছাদন বা ত্বক-তন্ত্র (Integumentary System) দেহের ত্বক বা চামড়া আর চামড়া থেকে উৎপন্ন রোম (দেহের রোম বা মাথার চুল), নখ ইত্যাদিকে নিয়েই গড়ে ওঠে ত্বক-তন্ত্র। রোম, নখ গুলিকে বলা হয় বহিঃকঙ্কাল (exoskeleton) কেননা দেহের বাইরে এগুলির অবস্থান।
উৎপত্তি- ত্বক-তন্ত্র প্রধানত উৎপন্ন হয় বাহ্যিক স্তর এক্টোডার্ম (ectoderm) থেকে যা তিনটি আদি ভ্রূণ-স্তরের (এক্টোডার্ম, মেসোডার্ম ও এন্ডোডার্ম) অন্যতম। অবশ্য দেহপ্রাচীরের গভীরতর স্তর মেসোডার্ম থেকে উৎপত্তি লাভ করে।
ত্বক বা চামড়ার কাজ- দেহত্বক বা চামড়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র (Organ)। বাইরের তাপ, চাপ বা আঘাত থেকে দেহকে রক্ষা করার দায়িত্ব এই ত্বকের। শুধু তাই নয় বাইরের রোগজীবাণুর আক্রমণও ঠেকিয়ে রাখে যতক্ষণ তা অক্ষত বা অভগ্ন থাকে। (ক্ষতস্থান দিয়ে জীবাণু প্রবেশের সম্ভাবনা থাকাতেই ক্ষতস্থানে আয়োডিন বা ডেটল জাতীয় অ্যান্টিসেপটিক ওষুধ দেওয়ার কথা বলা হয়)।
নানান টিসু বা কলায় তৈরী জটিল গঠনের দেহত্বক আরও নানাভাবে কাজ করে। যেমন চামড়ার মধ্যে প্রোথিত ঘর্মগ্রন্থি (sweat gland) রক্ত থেকে রেচন পদার্থ ও অতিরিক্ত লবণ নিষ্কাশনের কাজে সহায়তা করে রেচন ক্রিয়ায় অংশ নেয়। এই কারণে চামড়াকে অনেক সময় একটি মেলে রাখা কিডনী বলে বর্ণনা করা হয়। জানা গেছে যে আমাদের দেহতাপ সংরক্ষণেও চামড়ার মূল্যবান ভূমিকা আছে। চামড়ায় ছড়িয়ে থাকা রক্তবাহিকাসমূহ থেকে অতিরিক্ত তাপ বাইরে চলে যায় আবার দেহকে শীতল করার প্রয়োজনে ঘর্মের বাষ্পীভবন ঘটিয়েও তাপ টেনে নেওয়া হতে পারে। সবশেষে দেহত্বক যে স্পর্শেন্দ্রিয়ের কাজ করে তা উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেহত্বকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সংবেদজ গ্রাহক কোষ (receptors) যে অনুভূতি গ্রহণ করে স্নায়ুর মাধ্যমে তা মস্তিষ্কে বা সুষুম্নাকাণ্ডে পাঠায়। এইভাবে অনুভূতি গ্রহণের কাজ চলে। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের গঠনেও চামড়া প্রত্যক্ষ অংশ নেয়।[৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Martini, Frederic; Nath, Judi L. (২০০৯)। Fundamentals of anatomy & physiology (8th সংস্করণ)। San Francisco: Pearson/Benjamin Cummings। পৃষ্ঠা 158। আইএসবিএন 978-0321505897।
- ↑ Kardong, Kenneth V. (২০১৯)। Vertebrates : comparative anatomy, function, evolution (Eighth সংস্করণ)। New York, NY। পৃষ্ঠা 212–214। আইএসবিএন 978-1-259-70091-0।
- ↑ উচ্চমাধ্যমিক জীববিজ্ঞান (শারীরবিদ্যা): তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, বছর:১৯৭৬, পৃঃ ২,৩