পেশী
পেশী (ইংরেজি: Muscle) হলো প্রাণীদেহের বিশেষ এক ধরনের নরম কিন্তু স্থিতিস্থাপক কলা যার উদ্দেশ্য প্রাণীর , চলন ও গমনে সহায়তা করা। প্রাণীদেহের অভ্যন্তরেও পেশীসমূহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যেমন হৃৎপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণ, পৌষ্টিকনালীর ভেতর দিয়ে খাদ্য পরিবহন, ইত্যাদি। ভ্রূণীয় মেসোডার্ম থেকে তৈরি সংকোচন প্রসারণশীল বিশেষ ধরনের দেহকলাকে পেশীকলা বলে।
পেশী | |
---|---|
![]() ঐচ্ছিক পেশী | |
বিস্তারিত | |
পূর্বভ্রূণ | মেসোডার্ম |
তন্ত্র | পেশী ও কঙ্কালতন্ত্র |
শনাক্তকারী | |
লাতিন | musculus মুস্কুলুস্' |
মে-এসএইচ | D009132 |
টিএ২ | 1975, 1994 |
এফএমএ | 5022 FMA:30316, 5022 |
শারীরস্থান পরিভাষা |
প্রাণীদেহে পেশীকলা সংকোচন এবং প্রসারণের মাধ্যমে কাজ করে। পেশীকোষগুলোর ভিতরে অ্যাকটিন ও মায়োসিন নামের প্রোটিনশৃঙ্খল থাকে যেগুলি একে অপরের সাথে ঘেঁষে পিছলে যেতে পারে। ফলে পেশীকোষগুলির দৈর্ঘ্য ও আকার উভয়েরই পরিবর্তন সম্ভব হয়। [১]
পেশীর প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনাঅবস্থান, গঠন এবং কাজের ভিত্তিতে মানবদেহে পেশী কলা প্রধানত তিন প্রকার। এগুলি হল: ঐচ্ছিক পেশী, অনৈচ্ছিক পেশী এবং হৃদপেশী।
কঙ্কাল পেশীগুলি দেহের কঙ্কাল তথা অস্থির সাথে অস্থিসন্ধির মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। যেহেতু আমরা কঙ্কাল পেশীগুলির নড়াচড়া আমাদের ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাই এগুলিকে ঐচ্ছিক পেশীও বলা হয়। পেশীগুলির দেখতে ডোরাকাটা বলে এগুলিকে রেখাঙ্কিত পেশীও বলা হয়। কঙ্কাল পেশীগুলি আমাদেরকে হাঁটতে, থেমে যেতে এবং কোনও কিছু ওঠাতে সহায়তা করে। কঙ্কাল পেশীগুলি দুই ধরনের হয়। দ্রুত স্পন্দনশীল পেশী ও ধীর স্পন্দনশীল পেশী। দ্রুত স্পন্দন পেশীগুলি দ্রুত সাড়া দেয় ও দ্রুত নড়াচড়া করতে পারে, কিন্তু এগুলি অল্প সময়েই ক্লান্ত হয়ে যায়। যেমন পায়ের পেশীগুলি দ্রুত স্পন্দন পেশী, তাই আমরা দীর্ঘ সময় ধরে বারবার লাফ দিতে পারি না। এর বিপরীতে ধীর স্পন্দন পেশীগুলি অপেক্ষাকৃত অনেক ধীরে নড়াচড়া করে, কিন্তু এগুলি ক্লান্ত হতেও অনেক বেশি সময় নেয়। যেমন, হাতের বা কব্জির পেশীগুলি ধীর স্পন্দন পেশী, তাই আমরা বহুক্ষণ ধরে কলম দিয়ে লিখতে পারি।
অনৈচ্ছিক পেশী বা মসৃণ পেশীগুলি অন্ননালী, পাকস্থলী, অন্ত্র, শ্বাসনালী, মূত্রথলি, মূত্রনালী, রক্তনালী, এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গের দেয়ালে বা আস্তরণে অবস্থান করে। এগুলি সচেতন জ্ঞান ছাড়াই নিজে নিজে সংকুচিত-প্রসারিত হয়। তাই এগুলি অনৈচ্ছিক পেশী, অর্থাৎ এগুলিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। যেমন, আমরা শত চেষ্টা করলেও পাকস্থলীকে দ্রুত বা আস্তে খাবার হজম করার নির্দেশ দিতে পারি না।
হৃদপেশী হলো হৃৎপিণ্ডের দেওয়ালে অবস্থিত পেশী যার কাঠামো ঐচ্ছিক পেশীর মত হলেও এর কার্যক্রম অনৈচ্ছিক। এগুলি সর্বক্ষণ কাজ করতে থাকে এবং কখনোই ক্লান্ত হয় না। মসৃণ পেশীগুলোর মত এগুলিও অনৈচ্ছিক পেশী। আমরা ইচ্ছা করলেই আমাদের হৃৎপিণ্ডকে দ্রুত বা ধীরে কাজ করতে বাধ্য করতে পারি না।
ঐচ্ছিক পেশীর গঠন ও কাজ
সম্পাদনাঐচ্ছিক পেশী (Voluntary muscle): এই পেশী গুলির সংকোচন আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। এগুলি অস্থিসংলগ্ন থাকে বলে এদের অনেক সময় অস্থি পেশী (Skeletal muscle) ও বলে। মোট ঐচ্ছিক পেশীর ওজন আমাদের দেহের ওজনের প্রায় চল্লিশ শতাংশ।
গঠন: ঐচ্ছিক পেশী প্রচুর সমান্তরাল পেশীতন্তু নিয়ে গঠিত। পেশীগুলি টেনডনের (Tendon) সাহায্যে অস্থির সঙ্গে যুক্ত থাকে। পেশীতে রক্ত নালী এবং স্নায়ুও দেখা যায়। প্রতিটি পেশীতন্তু বা কোষ ১৫-৪০ মাইক্রন ব্যাসযুক্ত এবং একটি পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। একে সারকোলেমা (Sercolemma) বলে। এর নীচ বরাবর অনেকগুলি করে গোলাকার নিউক্লিয়াস দেখা যায়। পেশী কোষের সাইটোপ্লাজমকে সারকোপ্লাজম (Sarcoplasm) বলে। সারকোপ্লাজমে মাইটোকনন্ড্রিয়া ছড়িয়ে থাকে। এ ছাড়া গ্লাইকোজেনও দেখা যায়। সারকোপ্লাজমের মধ্যে সমান্তরালভাবে প্রচুর মায়োফাইব্রিল (Myofibril) অবস্থান করে। এদের এক একটির ব্যাস প্রায় এক মাইক্রন। মায়োফাইব্রিলের ভেতরে সমান্তরাল ভাবে অবস্থিত দুরকমের ফিলামেন্ট দেখা যায়। এদের একটির নাম অ্যাকটিন (Actin) এবং অপরটির নাম মায়োসিন (Myosin)। একএকটি পেশীকোষে এই ধরনের ফিলামেন্ট প্রায় এক কোটি করে থাকে। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এদের দেখা যায়। ফিলামেন্ট গুলি পেশী সংকোচনে উল্লেখযোগ্য অংশ নেয়। অ্যাকটিন এবং মায়োসিনের পর্যায়ক্রমিক অবস্থান পরিবর্তনের ফলে পেশী সংকোচন ঘটে। পেশীতন্তুতে আড়াআড়ি ডোরা দাগ দেখা যায়। তাই এই ধরনের পেশীগুলিকে চিহ্নিত পেশী (Striped বা Striated muscle) বলা হয়।
কাজ: ইচ্ছাকৃত অঙ্গ সঞ্চালনের কাজে এই পেশীগুলি ব্যবহৃত হয়।[২]
অনৈচ্ছিক পেশীর গঠন ও কাজ
সম্পাদনাঅনৈচ্ছিক পেশী (Involuntary muscle): এই পেশী আমাদের ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এগুলি স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পৌষ্টিকনালী, বিভিন্ন গ্রন্থির নালী, ইউটেরাস, ফ্যালোপিয়ান নালী ইত্যাদিতে এই ধরনের পেশী থাকে।
গঠন: মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে পেশীতন্তু গুলিকে দেখা যায়। এর দুপাশ সুঁচালো এবং মাঝখানটা মোটা, প্রতি কোষে একটি অথবা দুটো গোলাকৃতি নিউক্লিয়াস থাকে। নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি সেনট্রিওল দেখা যায়। পেশীতন্তুতে লম্বালম্বি ডোরা দাগ দেখা যায় তবে এখানে আড়াআড়ি দাগ থাকে না। এই পেশীকে মসৃণ পেশী (Smooth muscle) বলে। পেশীতন্তুর সারকোপ্লাজমে অ্যাকটিন, মায়োসিন ইত্যাদি থাকে।
কাজ: পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র ইত্যাদিতে এই পেশী থাকায় উক্ত অংশগুলি স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুর মাধ্যমে উত্তেজিত হয়ে নড়াচড়া করতে পারে। ফলে খাদ্যের পাচন ও শোষণ সঠিক ভাবে হয়।
হৃদপেশীর গঠন ও কাজ
সম্পাদনাহৃদপেশী (Cardiac muscle): হৃদযন্ত্র এই পেশীতে গঠিত। এতে ফসফোলিপিড, কোলেসটেরল ইত্যাদি যৌগগুলি বেশী পরিমাণে পাওয়া যায়।
গঠন: এই পেশীর গঠন একটু অন্যরকম। পেশীতন্তু বা পেশীকোষের লম্বচ্ছেদ নলের মতো কিম্বা আয়তাকার হয়। সারকোলেমা ঠিক মত বোঝা যায় না অর্থাৎ অস্পষ্ট। কোষের মাঝখানে একটি নিউক্লিয়াস থাকে। আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি ডোরা গুলি অস্পষ্ট। পেশীতন্তুগুলি শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে জালের সুতোর মত যুক্ত থাকে। ফলে তাদের মধ্যে প্রোটোপ্লাজমীয় যোগসূত্র স্থাপিত হয়। হৃদপেশীতে রং `প্রয়োগ করলে একটি বিশেষ অংশে গাঢ় রং ধরে। এই অংশটিকে ইন্টারক্যালেটেড ডিস্ক (Intercalated disc) বলে।
কাজ: উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া ও সংকুচিত হওয়া, স্পন্দনের পরিবহন, সঠিক ছন্দময়তা ইত্যাদি কাজগুলি হৃদপেশী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে করে। হৃদপেশী ক্রমাগত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে সারা দেহে রক্ত সরবরাহ করে। এই পেশীর ক্লান্তি নেই। এই পেশীর সংকোচন প্রসারণ বন্ধ হলে প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ https://my.clevelandclinic.org/health/body/21887-muscle সংগ্ৰহের তারিখ:১ মার্চ ২০২৫
- ↑ শারীরবিদ্যা: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী,পৃ.১৬