অক্ষয়কুমার দত্ত

ভারতীয় লেখক, প্রবন্ধক এবং সাংবাদিক

অক্ষয়কুমার দত্ত (ইংরেজি: Akshay Kumar Datta; ১৫ জুলাই ১৮২০ - ১৮ মে ১৮৮৬) ছিলেন একজন বাঙালি সাংবাদিক, প্রবন্ধকার এবং লেখক৷ বাংলা, সংস্কৃত এবং ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তার দক্ষতা ছিল৷

অক্ষয়কুমার দত্ত
Akshay Kumar Datta photo.jpg
জন্ম১৫ জুলাই, ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ
চুপি গ্রাম, ব্রিটিশ বাংলা (বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমবঙ্গ)
মৃত্যু১৮ মে, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ
জাতীয়তাবাঙালি
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয় British Raj Red Ensign.svg
পরিচিতির কারণসাংবাদিক, প্রবন্ধকার এবং লেখক
আত্মীয়কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (নাতি)

প্রথম জীবনসম্পাদনা

অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে পীতাম্বর দত্ত এবং দয়াময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র অক্ষয়কুমার জন্মগ্রহণ করেন৷ প্রখ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন তার নাতি৷

কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে দুই বছর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন৷ বাবার মৃত্যু ঘটলে তাকে স্কুল ছেড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়৷ কিন্তু তিনি বাড়িতে পড়াশোনা করে গণিত, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করেন৷ তিনি জ্যোতিষবিদ্যা ও হিন্দুশাস্ত্রেও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন৷ ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সিজার্মান ভাষায় তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেন৷ মাত্র ১৪ বছর বয়সে অনঙ্গমোহন কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন৷

কর্মজীবনসম্পাদনা

অক্ষয়কুমার সংবাদপত্রে লেখালেখির মাধ্যমে লেখক জীবন শুরু করেন৷ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন; তিনি মূলত ইংরেজি সংবাদপত্রের প্রবন্ধগুলি বাংলায় অনুবাদ করতেন৷ ১৮৩৯ সালে তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার অন্যতম সভ্য মনোনীত হন এবং কিছুদিন সভার সহ-সম্পাদকও ছিলেন৷ ১৮৪০ সালে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন৷ ১৮৪২ সালে তিনি নিজস্ব উদ্যোগে দিগ্‌দর্শন নামের একটি মাসিক পত্রিকা চালু করেন৷ কিন্ত এই পত্রিকা বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি৷ লেখক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি লাভের কারণে ১৮৪৩ সালে তাকে ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের পদে মনোনীত করা হয়৷ তিনি ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছিলেন৷ এই পত্রিকায় অক্ষয়কুমারের প্রবন্ধ প্রকাশিত হত৷ প্রবন্ধগুলিতে সমসাময়িক জীবন ও সমাজ সম্পর্কে অক্ষয়কুমারের নির্ভীক মতামত (জমিদারি প্রথা, নীলচাষ, ইত্যাদি সম্পর্কিত মতামত) প্রকাশ পেত৷ এই সব প্রবন্ধ তিনি পরে বই হিসাবে বার করতেন৷ তার প্রথম বই ভূগোল (১৮৪১) তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার পড়াশোনার জন্য তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল৷ দীর্ঘদিন পরে তার দ্বিতীয় বই বাহ্যবস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার ১ম ভাগ ১৮৫২ সালে বের হয়৷ এরপর এই বইয়ের ২য় ভাগ, চারুপাঠ (তিনভাগ), ধর্মনীতি, ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায় (দুই ভাগ), ইত্যাদি বই প্রকাশিত হয়৷ চারুপাঠ শিশুপাঠ্য বই হিসেবে একসময় জনপ্রিয় ছিল৷

অক্ষয়কুমারের অনেক রচনা ইংরেজি থেকে অনূদিত ও সংকলিত৷ তবে ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায় বইটিতে নিজস্ব মৌলিক উপাদান অনেক ছিল৷ তিনি ছিলেন ভারতে বিজ্ঞান আলোচনার পথপ্রদর্শক৷

অক্ষয়কুমারের অণুপ্রেরণার উৎস ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তিনি ১৮৪৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও ১৯ জন বন্ধুর সাথে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছ থেকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন; এরাই ছিলেন প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম৷ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় সামাজিক সংগঠন তত্ত্ববোধিনী সভায় তিনি সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করতেন৷ ব্রাহ্ম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হিন্দু হলেও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও শিল্পকলার প্রাধান্য মেনে নেয়ার মানসিকতা তার মধ্যে ছিল৷ তিনিই প্রথম ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলা ভাষায় প্রার্থনার প্রবর্তন করেন৷ তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন৷ এ কারণে হিন্দুদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ-এ বর্ণিত আত্মা এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে বহু ব্রাহ্ম ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন৷ এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রভাবিত হয় তার সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলনে শরিক হন৷ ধর্ম এবং দর্শনের পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের বেড়াজালে পড়ে তিনি হতবুদ্ধি হয়েছিলেন৷ এ কারণে পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম সমাজ এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-ও পরিত্যাগ করেন৷

অক্ষয়কুমার মধ্য বয়সে ফরাসি দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একাত্মাবাদ গ্রহণ করেছিলেন৷ কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তিনি প্রাথর্নার প্রয়োজন অস্বীকার করেন, এবং পরিণত হন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদে বিশ্বাসী একজন অজ্ঞেয়বাদীতে৷ দেখা যাচ্ছে, তিনি বারবার নিজ মত ও আদর্শ পরিবর্তন করেছেন৷ তিনি আসলে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বা দর্শনেই আস্থা স্থাপন করতে পারেননি৷ উনিশ শতকের বাঙালি পণ্ডিত সমাজ কতটা অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছিল তার জীবন থেকে এর প্রমাণ মেলে৷ হিন্দু জীবনাচার ও অনুষ্ঠান পালনে তিনি অনাগ্রহী ছিলেন, কিন্তু বাংলা ভাষা, কলা এবং সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছেন৷ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন৷ উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তিনি স্মরণীয়৷[১][২][৩]

অক্ষয়কুমার দত্তের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসম্পাদনা

  • প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্র যাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার
  • ভূগোল (১৮৪১)
  • বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১ম ভাগ ১৮৫২; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৩)
  • চারুপাঠ (১ম ভাগ ১৮৫২, ২য় ভাগ ১৮৫৪, ৩য় ভাগ ১৮৫৯)
  • ধর্মনীতি (১৮৫৫)
  • পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬)
  • ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (১ম ভাগ ১৮৭০, ২য় ভাগ ১৮৮৩)।[৪]

মৃত্যুসম্পাদনা

বালিগ্রামে ‘বোটানিক গার্ডেন’ নামের বাড়িতে তিনি শেষ জীবন অতিবাহিত করেন৷ ১৮৮৬ সালের ১৮ মে মারা যান৷ [৪]

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. "দত্ত, অক্ষয়কুমার - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-২৮ 
  2. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০২০-০৭-১৮)। "অক্ষয়কুমার দত্ত: সময়ের থেকে এগিয়ে"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-২৮ 
  3. "বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা অক্ষয়কুমার দত্ত"sangbad.net.bd (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-২৮ 
  4. সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; দ্বিতীয় সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা: ১, আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪৩৫৪-৬