১৯৮০ মোরাদাবাদ দাঙ্গা

১৯৮০ সালের মোরাদাবাদ দাঙ্গা উত্তর প্রদেশ-এর মোরাদাবাদ শহরে ১৯৮০র আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত হওয়া হিংসাত্মক ঘটনারাজিকে বোঝায়। এই হিংসাত্মক ঘটনারাজি আংশিকরূপে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঘটা সংঘাত ও আংশিকরূপে পুলিশ ও মুসলমানের মধ্যে ঘটা সংঘাত ছিল। ১৩ আগস্টর দিন স্থানীয় পুলিশ ঈদগাহ ময়দানে চরতে থাকা একটা শুয়োরকে বার করতে অসন্মত হওয়া ও সেটিকে নিয়ে মুসলমানদের একটা দল পুলিশদেরকে পাথরখন্ড ছোঁড়াকে কেন্দ্র করে এই দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালনা করায় একশরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পরে বিষয়-সম্পত্তি আগুন লাগিয়ে দেয়া, লুটপাট, হত্যা ইত্যাদি এমন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে, যার প্রকৃতি ছিল ধর্মীয়। দাঙ্গা ১৯৮০র নভেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে। মোট নিহতের সংখ্যা অনিশ্চিত যদিও সরকার ৪০০ জন মানুষের মৃত্যু চিহ্নিত করে এবয ক্ষতিপূরণ প্রদান করে; যেক্ষেত্রে বেসরকারী হিসাব মতে নিহতদের সংখ্যা ২৫০০রও বেশি।[১] এই দাঙ্গা মোরাদাবাদের পিতল শিল্পোদ্যোগে কু-প্রভাব ফেলে। পিতলের সামগ্রীর উৎপাদন ও রপ্তানী লক্ষণীয়ভাবে কমে যায়।[২]

১৯৮০ মোরাদাবাদ দাঙ্গা
ভারতের ধর্মীয় হিংসাত্মক ঘটনা-এর অংশ
ভারতের মানচিত্রে মোরাদাবাদের অবস্থান
তারিখআগস্ট ১৯৮০
অবস্থান
প্রক্রিয়াসমূহহত্যা, অগ্নিদাহ, লুটপাট
নাগরিক সংঘাতের দলসমূহ
পুলিশ, হিন্দু
মুসলমান

পটভূমি সম্পাদনা

মোরাদাবাদের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার এক ইতিহাস আছে। প্রথম ১৮৪৮এ তেমন এক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল ; অন্য একটা দাঙ্গা হয়েছিল ১৮৭২এ।[১] ১৮৮০তে শহরটিতে হিন্দু ভোটারের আধিক্য ছিল যদিও সেইসময়ের পৌরসভার মুসলমান সচিবরা পৌরসভার ভোটার ওয়ার্ডের সীমারেখা এমনভাবে অঙ্কন করেছিল, যাতে হিন্দুরা মাত্র এটা ওয়ার্ডে সীমিত হয়ে থাকে। বাকী পাঁচটা ওয়ার্ডে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।[৩] ফলস্বরূপ মুসলমানরা পৌরসভাতে সর্বদাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছিল। হিন্দুরা এর বিরোধিতা করায় পৌর-ওয়ার্ডগুলির সীমারেখা নতুনকরে অঙ্কন করা হয়েছিল এবং এর পর হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। উভয় সম্প্রদায় ধর্মীয় দৃস্টিভঙ্গীতে প্রশাসনীয় ক্ষমতা ব্যবহার করতে চেয়েছিল; যা উভয় সম্প্রদায়কে শত্রু মনোভাবাপন্ন করে তুলেছিল।[১]

সূত্রপাত সম্পাদনা

১৯৮০র মার্চর থেকে কয়েকজন মুসলমান ব্যক্তির একটি দলিত মেয়েকে অপহরণ করাকে কেন্দ্র করি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এই দলিত ও মুসলমানরা এটি ঈদগাহ ময়দানের কাছে দুটো পৃথক বস্তিতে বাস করত। মেয়েটিকে পরে উদ্ধার করা হয় এবং তার অপহরণকারীদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই বছরের জুলাইতে তার বিয়ে একজন দলিত যুবকের সাথে ঠিক হয়েছিল ; কিন্তু বরযাত্রী দলটিকে কয়েকজন মুসলমান লোক মসজিদের কাছে উচ্চস্বরের সংগীত বাজিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে বাধা প্রদান করে। অতি অল্পকালে দুই পক্ষের মধ্যে হওয়া তর্ক-বিতর্ক দুইটি সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসাত্মক কাজিয়ার রূপ নেয় এবং বহু ঘরবাড়িতে লুটপাট চালানো হয় ।[৪]

১৯৮০র ১৩ আগস্টের দিন একটা গৃহপালিত শুয়োর ঈদগাহ ময়দানে চরে বেড়াচ্ছিল। সেইসময়ে সেখানে প্রায় ৫০,০০০ লোক ঈদ-মিলাদুন-নবীর প্রার্থনা করছিল। মুসলমানরা শুয়োরকে হারাম (অপবিত্র) বলে বিবেচনা করে। তারা শুয়োরটিকে কাছের হিন্দু দলিতরা ইচ্ছাকৃতভাবে ঈদগাহ ময়দানে ছেড়ে দিয়েছে বলে বিশ্বাস করে নেয়।[৫] তারা সেইসময়ে কর্তব্যরত একজন পুলিশ জওয়ানকে শুয়োরটি তাড়িয়ে দিতে বলে। কিন্তু জওয়ানটি তা করতে অস্বীকার করায় উত্তপ্ত বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি হয় এবং কয়েকজন লোক পুলিশের ওপর পাথরখন্ড নিক্ষেপ করে।[৪]

বড় পুলিশ অধীক্ষকের (SSP) কপালে একটা পাথরখন্ড লাগে এবং তিনি পড়ে যান। অতিরিক্ত জেলা দন্ডাধীশ (ADM) ডি.পি. সিংকে কয়েকজন লোক ধরে নিয়ে যায় এবং পরে তার মৃত্যু ঘটে। পুলিশ তখন ভিড়কে উদ্দেশ্য করে এলোপাথাড়িভাবে গুলি চালাতে থাকে।[৬] গুলি লেগে বেশ কয়েকজন মুসলমান ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। হুড়োহুড়িতে প্রায় ৫০জন লোকের প্রাণ যায়। পরে মুসলমান নেতা সৈয়দ সাহাবুদ্দিন এই ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড-এর সাথে তুলনা করেছিলেন।[১]

আগস্ট হিংসা সম্পাদনা

ঈদগাহ ময়দানে থাকা বাকী উন্মত্ত মুসলমান লোকরা জোট বেঁধে দলিতদের বস্তিতে গণ লুটপাট, আগুন লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কার্যে লিপ্ত হয়। তারা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশ বাহিনীর লোককে মারধর করে। উত্তর প্রদেশের সশস্ত্র পুলিশের একজন কনস্টেবলকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।[৪] সন্ধেবেলা, মুসলমানদের একটা জনতা গলশহিদ পুলিশ চৌকিতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং দুজন পুলিশকে হত্যা করে অস্ত্র-শস্ত্র লুট করে। এরপর পুলিশও হিংসাত্মক পন্থা নেয়।[১]

পরদিন ১৪ আগস্টে জামাত-ই-ইসলামী-হিন্দ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুসলমান লোকদেরকে নিয়ে সমাবেশ করে ও দাঙ্গাটির নিন্দা করে একটা বিবৃতি জারী করে।[৭] পরবর্তী পর্যায়ে হিংসা ধর্মীয় রূপ নেয় এবং মোরাদাবাদ জেলার গ্রামীণ অঞ্চলকে ধরে কাছের আলিগড় শহরেও হিংসা ছড়িয়ে পড়ে।[৮] হিংসা প্রশমণ করতে অঞ্চলটিতে সেনা বাহিনী নিয়োগ করা হয়। ২ সেপ্টেম্বরে মোরাদাবাদে হিংসা নিয়ন্ত্রণাধীন হয় এবং সরকার সেনাবাহিনীকে অপসারণ করতে আরম্ভ করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতা ভি পি সিঙের মুখ্যমন্ত্রিত্বর সময়কালে এই দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যোগেন্দ্র মাকবানাই হিংসার জন্য আর.এস.এস, জনসংঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টিকে দায়ী করে। প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এর পিছনে বিদেশী শক্তি (অর্থাৎ পাকিস্তান-এর) সাম্প্রদায়িক দলগুলি থাকার অভিযোগ করে। দি টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক গিরিলাল জৈন মুসলমানদের মধ্যে থাকা “অসামাজিক ব্যক্তি” (anti-social elements) দের আংশিকরূপে দায়ী করেন এবং মুসলমান নেতাদের প্রকৃত সত্যকে স্বীকার না করে আর.এস.এসকে দায়ী করতে চাওয়ার কথাটিরও সমালোচনা করেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ‘’বিদেশী হাত’’ তত্বটিকে credence দেন এবয উত্তর প্রদেশে আসা পাকিস্তানের ভ্রমণকারীর একটি তালিকা দিয়ে একটা প্রবন্ধও প্রকাশ করেন। বি.জে.পি. নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি হিংসার জন্য মুসলমান নেতাদেরকে দোষারোপ করেন।[৮] সরকার এলাহাবাদ উচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতি সাক্সেনাকে দাঙ্গার বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য নিয়োগ করেন। বিচারপতি সাক্সেনা ১৯৮৩র মে তে প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে হিংসাত্মক ঘটনারাজির জন্য মুসলমান নেতাদের এবং ভি.পি. সিঙের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছিল ।[৯]

পরবর্তী প্রভাব সম্পাদনা

হিংসাত্মক ঘটনা কম পরিমাণে ১৯৮০র নভেম্বর পর্যন্ত চলেছিল। একটা কড় হিংসাত্মক ঘটনা সেপ্টেম্বরে হিন্দুদের উৎসব রাখী বন্ধন-এর দিন সংঘটিত হয়েছিল । অক্টোবরের শেষের দিকে আততায়ীর হাতে কম করে হলেও ১৪জনের মৃত্যু ঘটেছিল।[৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Satish Saberwal, Mushirul Hasan (১৯৯১)। "14. Moradabad Riots, 1980: Causes and Meanings"। Asgharali Engineer। Communal riots in post-independence India। Universities Press। পৃষ্ঠা 209–227। আইএসবিএন 978-81-7370-102-3। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৩ 
  2. Sami Uddin (১৯৮৯)। Entrepreneurship Development In India। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 254–। আইএসবিএন 978-81-7099-115-1। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৩ 
  3. Francis Robinson (৩ ডিসেম্বর ২০০৭)। Separatism Among Indian Muslims: The Politics of the United Provinces' Muslims, 1860-1923। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 80–81। আইএসবিএন 978-0-521-04826-2। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৩ 
  4. Shashi B Sahai (১ জানুয়ারি ১৯৯৭)। India: Twilight at Midday : Untold Story of a Sick Society। Gyan Books। পৃষ্ঠা 123–124। আইএসবিএন 978-81-212-0532-0। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৩ 
  5. Steven I. Wilkinson (২৩ নভেম্বর ২০০৬)। Votes and Violence: Electoral Competition and Ethnic Riots in India। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 37–। আইএসবিএন 978-0-521-53605-9। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৩ 
  6. Krishna Gandhi (৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০)। "Anatomy of the Moradabad Riots"Economic and Political Weekly15 (36): 1505–1507। 
  7. S. K. Ghosh (১৯৮৭)। Muslim Politics In India। APH Publishing। পৃষ্ঠা 33–। আইএসবিএন 978-81-7024-070-9। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৩ 
  8. Paul R. Brass (১৫ মে ২০১১)। The Production of Hindu-Muslim Violence in Contemporary India। University of Washington Press। পৃষ্ঠা 124–104। আইএসবিএন 978-0-295-80060-8। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৩ 
  9. India Today। Thomson Living Media India Limited। ১৯৯৭। পৃষ্ঠা 46। সংগ্রহের তারিখ ৭ এপ্রিল ২০১৩