বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত, যেখানে হিন্দু জনতা মুসলিম পরিবারগুলিকে টার্গেট করেছিল। দাঙ্গাগুলি কলকাতা দাঙ্গার হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ঘটেছিল এবং সেই বছরের নোয়াখালী দাঙ্গার পরে সূত্রপাত হয়েছিল। মোহনদাস গান্ধী ঘোষণা করেছিলেন যে দাঙ্গা বন্ধ না হলে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত অনশন করবেন। দাঙ্গাগুলি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ধারাবাহিকতায় ঘটেছিল যা ভারত বিভাগের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল।[১][৩]

১৯৪৬ বিহার দাঙ্গা
তারিখ২৪ অক্টোবর ১৯৪৬ – ১১ নভেম্বর ১৯৪৬ [১]
অবস্থান
কারণপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস, নোয়াখালী দাঙ্গা[২]
ক্ষয়ক্ষতি
নিহত৫,০০০ – ১০,০০০

পটভূমি সম্পাদনা

১৯৪৬ সালের বিহার দাঙ্গা ছিল উত্তর ভারত জুড়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একাধিক ঘটনার অংশ।[৪] ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে এই জাতীয় দাঙ্গার পুনরাবৃত্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছিল; একমাত্র ১৯৪৫ সালে উত্তরপ্রদেশে ১,৮০৯ দাঙ্গা হয়েছিল এবং ১৯৪৬ সালে দেশজুড়ে ৩,১৭৬টি দাঙ্গা হয়েছিল।[৪] ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তাদের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবির অংশ হিসাবে কলকাতায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। শহরজুড়ে বড় ধরনের দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, যাতে ৪,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল।[৩] এই দাঙ্গাগুলি বিহার সহ সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সূত্রপাত করেছিল।[৩] ১০-২২ অক্টোবর নোয়াখালীর দাঙ্গা বিহারেও সহিংসতাকে প্ররোচিত করেছিল।[১]

জুনের দাঙ্গা সম্পাদনা

জুনে যে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল তা শুরু হয়েছিলো হিন্দুদের এই মিথ্যা অভিযোগের বিরোধ থেকে যে মুসলমানরা এক হিন্দু মহিলাকে অপহরণ করেছিল।[৫] অন্ধনা গ্রামে হিন্দুদের একদল দাবি করে যে মহিলাকে এগিয়ে এনে হিংস্রভাবে আক্রমণ করে মুসলমানরা তাকে গুলি করে হত্যা করে, যার ফলে দুটি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। হিন্দুরাও চারজন মুসলিমকে হত্যা করেছিল।[৫]

সেপ্টেম্বর দাঙ্গা সম্পাদনা

১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে আরও দাঙ্গা হয়েছিল, আগের কল্যাণী দেবী নামে খ্যাত নূর জাহানকে অপহরণের অভিযোগে আবারও বিরোধ দেখা দেয়।[৫] আর্য সমাজের সদস্যদের নেতৃত্বে ৩০,০০০ হিন্দুর একটি দল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের দাঙ্গায় কলকাতা থেকে তাকে অপহরণ করা হয়েছিল এই বিশ্বাসে নূরজাহানকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল। এই উদ্ধার প্রচেষ্টার ব্যর্থতা দাঙ্গায় পরিণত হয়েছিল, যেখানে ১৪৪টি মুসলিম পরিবারের ২০০ ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং ১৪ জন মারা গিয়েছিল।[৫]

অক্টোবর-নভেম্বর দাঙ্গা সম্পাদনা

বছরের সবচেয়ে বড় দাঙ্গা ২৭ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটেছিল, এই সময়ের মধ্যে নোয়াখালী দাঙ্গার[৬][১] প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হিন্দুরা প্রচুর সংখ্যক মুসলমানকে মাসের শুরুর দিকে হত্যা করেছিল।[৭] আনুমানিক হতাহতের সংখ্যার ক্ষেত্রে বিস্তর ভিন্নতা ছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে দেওয়া এক বিবৃতিতে নিহতের সংখ্যা ৫০০০ বলা হয়েছিল। দ্য স্টেটসম্যান ৭,৫০০ থেকে ১০,০০০ এর মধ্যে প্রাণহানীর সংখ্যা অনুমান করেছিলেন, যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এটিকে ২,০০০ এর মধ্যে রেখেছিল। মুসলিম লীগের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন যে ৩০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।[৮] ৮ নভেম্বরের একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে মুঙ্গের জেলার একটি গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে সমান করে দেয়া হয়েছিল যেই একটি ঘটনায় ৫০০ লোক মারা গিয়েছিলেন এবং জনতার উপর চালানো সেনাবাহিনীর গুলিতে আরো ১০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। অন্য একটি আনুমানিক হিসেবে বলা হয় যে ৩৫,০০০ মানুষ লড়াইয়ের সময়ে পালিয়ে গেছিল।[৯]

দাঙ্গাগুলি এতটাই মারাত্মক ছিল যে তৎকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান জওহরলাল নেহ্‌রু আকাশ থেকে দাঙ্গাকারীদের বোমা ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন।[৬] প্রদেশের রাজধানী পাটনা থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং তাদের উপর প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।[৯] কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন যে এই প্রদেশের হিন্দু প্রধানমন্ত্রী দাঙ্গায় কংগ্রেস দলের সংশ্লিষ্টতা উপেক্ষা করে ব্রিটিশ সেনাদের হিন্দু দাঙ্গাকারীদের উপর গুলি চালানোর অনুমতি দেয়নি।[১০] অন্যরা উল্লেখ করেছেন যে সরকার শেষ পর্যন্ত অন্যান্য অঞ্চলের মতো বিহারের সহিংসতা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল।[১]

৫ নভেম্বর, কলকাতায় থাকা মোহন দাস গান্ধী দাঙ্গা-জর্জরিত অঞ্চল পরিদর্শন করে বলেছিলেন যে বিহারে সহিংসতা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ না করা হলে তিনি আমরণ অনশন করবেন। তাঁর এই বক্তব্য কংগ্রেস নেতা রাজেন্দ্র প্রসাদ দেশব্যাপী প্রচার করেছিলেন।[১১] এ সময়, সরকারী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে, এবং মুসলিম লীগের নেতারা জানিয়েছেন যে আসলে হত্যা হয়েছে ৫,০০০-৮,০০০ লোকের। মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ ইউনূস মুসলমানদের ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বকর-ঈদ উৎসবটিকে শোকের দিন হিসাবে পালন করতে বলেছিলেন।[১১]

৫ নভেম্বর, জওহরলাল নেহেরু একটি বিবৃতি জারি করেছিলেন, "আমাদের অবশ্যই এই উন্মাদনার অবসান ঘটাতে হবে; আমরা পরে তর্ক করতে পারি," এবং যোগ করেন যে, "বিহার প্রদেশের কিছু অংশে যা ঘটেছে এবং যা ঘটছে তা ভয়াবহ এবং আমি বিশ্বাস করি না যে মানুষ এ জাতীয় আচরণ করতে পারে"।

ভবিষ্যৎ ফল সম্পাদনা

দাঙ্গার পরে, মুসলিম লীগ নেতারা বলেছিল যে দলের সদস্যদের কাছ থেকে প্রচুর অভিযোগ এসেছিল, তাতে বলা হয়েছিল যে তারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে ভয় পাচ্ছে।[৫] ১৭ নভেম্বর মুসলিম লীগ ভারতের ভাইসরয়কে বিহারের দাঙ্গার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে একটি রেজুলেশন বা প্রস্তাব পাস করে। রেজুলেশনে বলা হয়েছিল যে বিহারের মুসলমানরা এখনও "জীবন বা সম্পত্তির জন্য" হুমকি বোধ করছেন এবং এই দাঙ্গাহাঙ্গামার অবস্থা সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। রেজুলেশনে আরও বলা হয়, বিহারে হত্যার জন্য বিহারের গভর্নর এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দায়ী ছিল। মুসলিম লীগ জানিয়েছিল যে প্রদেশে হিন্দু জনতা ৩০,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে। সুরঞ্জন দাসের মতো ঐতিহাসিকরা ১৯৪৬ সালের কলকাতার মহা হত্যাকাণ্ডকে এই অঞ্চলে প্রথম স্পষ্টত রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে উল্লেখ করেছেন।

টীকা এবং তথ্যসূত্র সম্পাদনা

পাদটিকা সম্পাদনা

  1. Mitra 1990
  2. Ghosh, Papiya (জানুয়ারি ১৯৯৪)। "The Virile and the Chaste in Community and Nation Making: Bihar 1920's to 1940's"। Social Scientist22 (1): 86। জেস্টোর 3517853 
  3. Das 2000
  4. Kausar 2006
  5. Ghosh 1994
  6. Markovitz 2015
  7. Khan 2007, পৃ. 68।
  8. Stephens 1963, পৃ. 111।
  9. The Washington Post 1946
  10. Wilkinson 2006, পৃ. 5।
  11. The New York Times (a) 1946

উৎসসমূহ সম্পাদনা