হেমলতা
হেমলতা (জন্ম ১৬ আগস্ট ১৯৫৪) হলেন একজন ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী। তিনি ১৯৭০-এর দশকের শেষভাগে বলিউডে নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁর কাজের জন্য সুপরিচিত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত হেমলতা চলচ্চিত্র, কনসার্ট, টেলিভিশন ও সঙ্গীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। তিনি ৩৮টি ভাষায় ৫০০০-এর অধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।[১]
হেমলতা | |
---|---|
জন্ম নাম | লতা ভাট |
আরও যে নামে পরিচিত | হেমলতা বালি |
জন্ম | হায়দ্রাবাদ, রাজস্থান, ভারত | ১৬ আগস্ট ১৯৫৪
ধরন | চলচ্চিত্রের সঙ্গীত, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত, ভজন |
পেশা | নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী |
বাদ্যযন্ত্র | কণ্ঠ |
কার্যকাল | ১৯৬৮–বর্তমান |
তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত পাঁচবার শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেন, তন্মধ্যে চিতচোর (১৯৭৬) চলচ্চিত্রের শাস্ত্রীয় ধারার "তু জো মেরে সুর মেঁ" গানে কণ্ঠ প্রদান করে এই পুরস্কার অর্জন করেন। মনোনয়ন প্রাপ্ত তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্রের গানগুলি হল ফকিরা (১৯৭৬) চলচ্চিত্রের "সুন কে তেরি পুকার", আঁখিওঁ কে ঝরখোঁ সে (১৯৭৮) চলচ্চিত্রের শীর্ষ গান, সুনয়না (১৯৭৯) চলচ্চিত্রের "মেঘা, ও রে মেঘা", আপ তো অ্যায়সে না থে (১৯৮০) চলচ্চিত্রের "তু ইস তারা সে"।
প্রারম্ভিক জীবনসম্পাদনা
হেমলতা ১৯৫৪ সালের ১৬ই আগস্ট হায়দ্রাবাদের এক কট্টর মাড়োয়ারি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মনাম ছিল লতা ভাট।[২] তাঁর পিতা পি টি জয়চন্দ ভাট একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ও লাহোরের কিরণ ঘরনার প্রতিনিধি[১] এবং মাতা অম্বিকা ভাট। হেমলতার বয়স যখন সাত, তখন তাঁর পিতার শিষ্য গোপাল মালিক তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার সন্ধান পান এবং তাঁকে কলকাতার রবীন্দ্র স্টেডিয়ামে একটি কনসার্টে বিপুল পরিমাণ দর্শকের সামনে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন। তাঁর পিতাও তার তাঁর গান গাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন এবং তাঁকে বম্বে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বম্বে যাওয়ার পূর্বে রবীন্দ্র জৈন কলকাতায় সঙ্গীতে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে আসেন এবং নিয়মিত তাঁর গুরু জয়চন্দ ভাটের বাড়িতে সঙ্গীত শিখতে যেতেন। পাঠ শেষ করে তিনি বাংলায় তাঁর সুরকৃত গানগুলি হারমোনিয়ামে বাজাতেন এবং ১২ বছর বয়সী কিশোরী হেমলতা সেগুলো গাইতেন।
কর্মজীবনসম্পাদনা
প্রারম্ভিক কর্মজীবনসম্পাদনা
১৯৬৬ সালে তাঁর পরিবার বম্বে আসেন এবং দক্ষিণ বম্বের গিরগাঁওয়ে বসবাস শুরু করেন। বম্বে থাকাকালীন তাঁরা আল্লা রাখা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরে তাঁর পরিবার বম্বের মাহিমে স্থানান্তরিত হন। এখানে তিনি ওস্তাদ রইস খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর নিকট গজল শেখেন।
হেমলতা সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ আলীর আমন্ত্রণ পান এবং আলী তাঁকে গান গাইতে বলেন। চলচ্চিত্রের বাইরের গাওয়া একটি গানে তাঁর কণ্ঠ শুনে আলী বিমোহিত হন এবং মুগ্ধ আলী তাঁকে চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু তাঁকে কণ্ঠের পরিপক্কতা অর্জন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। পরে হেমলতা নওশাদ আলীর সাথে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আলীর অধীনে তিনি নেপথ্য গান গাওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক তালিম গ্রহণ করেন। নওশাদ আলী তাঁকে নেপথ্য সঙ্গীতের জগতে পরিচয় করিয়ে দিলে গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে বিপুল সাড়া পড়ে যায়।
প্রথম দিনেই তিনি সঙ্গীত পরিচালক রোশনের নিমন্ত্রণ লাভ করেন, যার মাধ্যমে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথমবারের মত বম্বের সম্মুখানন্দ হলে রোশন নাইট কনসার্টে গান পরিবেশনের সুযোগ পান। একই সপ্তাহে তিনি তাঁর প্রথম গান রেকর্ড করেন, সেটি ছিল ঊষা খান্নার সুরে রূপ রুপাইয়া চলচ্চিত্রের জন্য "তু খামোশ ম্যাঁয় পুর্যোশ"। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গান ছিল এক ফুল এক ভুল (১৯৬৮) চলচ্চিত্রের "দশ পয়সে মেঁ রাম লে লো"।
১৪ বছর বয়সে তিনি সঙ্গীত পরিচালক খৈয়ামের সুরে একটি গজল ইপি রেকর্ডের সুযোগ পান। ১৯৭০ সালে এইচএমভি হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত ইতিহাসে প্রথমবারের মত কভার সংস্করণ প্রকাশ করে, যাতে দ্য ট্রেইন, মেরা গাঁও মেরা দেশ, সাচা ঝুটা, জনি মেরা নাম, এক নজর, এক বার মুস্কুরা দো ও জওয়ানি দিওয়ানি চলচ্চিত্রের এবং হেমলতা, অম্বর কুমার ও অন্যান্য সঙ্গীতশিল্পীদের গান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কর্মজীবনে সাফল্যসম্পাদনা
১৯৭০-এর দশকের শুরুতে রবীন্দ্র জৈন বম্বে আসেন। জৈনের আগমনের পূর্বেই হেমলতা বলিউডে শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। জৈন তাঁর সুরারোপিত প্রথম চলচ্চিত্র কাঁচ অউর হীরা (১৯৭২)-এ হেমলতার কণ্ঠ ব্যবহার করেন এবং পরবর্তী কালে রাখ অউর চিঙ্গারি (১৯৭৪), গীত গাতা চল (১৯৭৫), সালাখেঁ (১৯৭৫), ও তপস্যা (১৯৭৫) চলচ্চিত্রেও তাঁকে সুযোগ দেন, কিন্তু এই চলচ্চিত্রের গানগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। তবে হেমলতা, জৈনের সুরে, ফকিরা (১৯৭৬) চলচ্চিত্রের সুন কে তেরি পুকার গানে কণ্ঠ দিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। একই বছর তিনি জৈনের সুরে রাজশ্রী প্রডাকশন্সের ব্যানারে চিতচোর চলচ্চিত্রে "তু জো মেরি সুর মেঁ" গানে কে জে যসুদাসের সাথে কণ্ঠ দেন।[২] এই দুটি গানের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন এবং দ্বিতীয় গানটির জন্য এই পুরস্কার অর্জন করেন।[৩][৪] তিনি পরবর্তী কালে রাজশ্রীর একাধিক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন, সেগুলো হল পহেলি (১৯৭৭), দুলহান ওহি জো পিয়া মান ভায়ে (১৯৭৭), আঁখিওঁ কে ঝরখোঁ সে (১৯৭৮), সুনয়না (১৯৭৯), নাইয়া (১৯৭৯), গোপাল কৃষ্ণ (১৯৭৯), রাধা অউর সীতা (১৯৭৯), মান অভিমান (১৯৮০), নদীয়া কে পার (১৯৮২), অবোধ (১৯৮৪), ও বাবুল (১৯৮৬)।
জৈনের সুরে তিনি আঁখিওঁ কে ঝরখোঁ সে (১৯৭৮) চলচ্চিত্রর শিরোনাম গানে কণ্ঠ দেন। বিনাকা গীতমালা বেতার অনুষ্ঠান অনুসারে এটি ১৯৭৮ সালের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান।[৫] এই গানের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।[৬] এই বছরে তিনি প্রথমবারের মত আনন্দজী-কল্যাণজীর সুরে মুকাদ্দর কা সিকান্দর চলচ্চিত্রে "ওয়াফা জো না কি" গানে তাঁর প্রতিভা প্রদর্শন করেন।[৭]
সুনয়না (১৯৭৯) চলচ্চিত্রের "মেঘা, ও রে মেঘা" গানে কণ্ঠ দিয়ে পুনরায় ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।[৮] আপ তো অ্যায়সে না থে (১৯৮০) চলচ্চিত্রের "তু ইস তরহা সে" গানের জন্য তিনি টানা তৃতীয়বারের মত শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।[৯] ১৯৮১ সালে গুজরাতি চলচ্চিত্র অমর রহে তারো চান্দলো-এ তাঁর গাওয়া "শঙ্কর তারি জাতামা" ও "ওম নম শিবায়" গানগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে।[১০]
হেমলতা শ্রী মাতাজী নির্মলা দেবীকে উৎসর্গীকৃত জৈনের ক্যাসেট অ্যালবাম সহজ ধারা (১৯৯১)-এর গানে কণ্ঠ দেন এবং ১৯৯২ সালের জুলাইয়ে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে দুটি কনসার্টে এই অ্যালবামের গান পরিবেশন করেন।[১১][১২] ১৯৯০-এর দশকে তিনি দূরদর্শন থেকে নিমন্ত্রণ পান। রবীন্দ্র জৈনের সুরে তাঁর ও কে জে যেসুদাসের দ্বৈতকন্ঠে "তিস্তা নদী সি তু চঞ্চলা"[১৩] এবং একক "সাথ জো তেরা ইউঁ পায়া" গান দুটি প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী সময়ে দূরদর্শনে প্রচারিত হত।
পুরস্কার ও মনোনয়নসম্পাদনা
পুরস্কার | বছর | গান | চলচ্চিত্র | ফলাফল |
---|---|---|---|---|
শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার | ১৯৭৭ | "তু জো মেরে সুর মেঁ" | চিতচোর | বিজয়ী |
"সুন কে তেরি পুকার" | ফকিরা | মনোনীত | ||
১৯৭৯ | "আঁখিওঁ কে ঝাড়কো সে" | আঁখিওঁ কে ঝাড়কো সে | ||
১৯৮০ | "মেঘা, ও রে মেঘা" | সুনয়না | ||
১৯৮১ | "তু ইস তারা সে" | আপ তো অ্যায়সে না থে |
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ ক খ "Gurbani fascinates me, says Hemlata"। দ্য ট্রিবিউন। ১৬ এপ্রিল ১৯৯৯। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ ক খ রাও, গায়ত্রী (১৫ আগস্ট ২০১৮)। "Singer Hemlata's Birthday"। লেমনওয়্যার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ "The Filmfare Awards Nominations – 1976"। দ্য টাইমস গ্রুপ। ২৯ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "The Filmfare Awards Winners – 1976"। দ্য টাইমস গ্রুপ। ২৮ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ খান, শাহিদ। "Music Review - Ankhiyon Ke Jharokhon Se"। প্ল্যানেট বলিউড। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ "The Filmfare Awards Nominations – 1978"। দ্য টাইমস গ্রুপ। ২৯ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ বুধু, রাকেশ। "Music Review - Muqaddar Ka Sikandar"। প্ল্যানেট বলিউড। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ "The Filmfare Awards Nominations – 1979"। দ্য টাইমস গ্রুপ। ২৯ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "The Filmfare Awards Nominations – 1980"। দ্য টাইমস গ্রুপ। ২৯ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "Hemlata - Legendary Bollywood playback singers who sang for Gujarati films"। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ "1992-0703 Sahaja Yoga public program, Brussels. Part 1: Music by Hemlata"। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ "1992-0704 Sahaja Yoga public program, Brussels. Music by Hemlata"। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ "Tista Nadi Si Tu Chanchala – Yasudas & Hemlata Nonfilmi Song Aired on Doordarshan"। ইউটিউব। ২ জুলাই ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
বহিঃসংযোগসম্পাদনা
- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে হেমলতা (ইংরেজি)