হার্মাদ (পর্তুগিজ: আর্মাডা শব্দের অপভ্রংশ) বলতে ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্তে উপদ্রুত পর্তুগিজ বণিক ও মগ জলদস্যুদের বোঝায়। মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে শত্রুতার কারণে আরাকানের মগ দস্যুরা পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৎকালীন মোগল-শাসনাধীন বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন, অপহরণ ও নির্বিচারে নারীদের উপর অত্যাচার চালাত।[১]

বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

বঙ্গীয় বিভিন্ন পল্লীগীতিকার বিবরণ অনুযায়ী, এদের গায়ে লাল কুর্তা, মাথায় নানা রঙের পাগড়ি (সম্ভবত মগদস্যুদের ব্যবহার্য) এবং হাতে দূরবীন থাকত। দূরবীন দিয়ে বাণিজ্যদ্রব্য বোঝাই সমুদ্রগামী জাহাজ লক্ষ্য করে হার্মাদরা অতর্কিতভাবে তা আক্রমণ করে লুণ্ঠন করত (এজন্য চট্টগ্রাম উপকূলের বাণিজ্য-তরীগুলি একত্রে দল বেঁধে যেত; সঙ্গে যুদ্ধের বিষাক্ত অস্ত্রসস্ত্র থাকত এবং রণকৌশলীর নির্দেশমত জাহাজের গতিবিধি ও নোঙর নিয়ন্ত্রিত হত)।

ছোট ছোট দ্রুতগামী জলযানে চড়ে শুধু উপকূল বা সমুদ্রেই নয়, কখনও কখনও শতাধিক মাইল দূরের স্থলভূমিতে গিয়ে হার্মাদ দস্যুগণ উৎসব-অনুষ্ঠানের সময় ব্যাপক লুঠতরাজ ও অকথ্য অত্যাচার করত; এমনকি, বন্দী নরনারীদের নৃশংসভাবে নিপীড়ন করে জাহাজে তুলে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন বন্দরে বিদেশি বণিকদের কাছে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিত। অনেক জায়গায় এদের স্পর্শদোষে হিন্দু ব্রাহ্মণরা পরিবারসমেত বংশানুক্রমে সমাজে পতিত হতেন ( মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের ঔরসজাত ব্রাহ্মণ-সন্তানদের মগব্রাহ্মণ বলা হত)। এই দস্যুদের ভয়ে বাংলার সমুদ্রতীরবর্তী দ্বীপ ও নগরীসমূহ জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল।[১]

ইতিহাস সম্পাদনা

সুলতান হুসেন শাহের রাজত্বকালে বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম পর্তুগিজ হার্মাদ বণিকদের আবির্ভাব ঘটে। ক্রমে চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রামহুগলি এদের বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। এরা তখন বিচ্ছিন্নভাবে বাংলার নানা স্থানে ঘাঁটি বানিয়ে লুঠপাট চালাত। ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ অধিনায়ক মেলো বাণিজ্যের ছলে এসব স্থানে অত্যাচার শুরু করায় তাকে অনেকদিন গৌড়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম এদের সম্পূর্ণ অধিকৃত হয়। প্রথমে এদের সাথে আরাকান-রাজের যুদ্ধ সংঘটিত হলেও পরে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা একত্রে মিলে যায়। সন্দ্বীপের মোগল-শাসনকর্তা এই দস্যুদের হাতে নিহত হওয়ার পর সেখানকার পরবর্তী মোগল-শাসক ফতে খাঁ হার্মাদদের চূড়ান্ত ধ্বংস করতে যুদ্ধ-জাহাজ নিয়ে অভিযান চালান। নৌযুদ্ধে পারদর্শী পর্তুগীজগণ তাকে সৈন্যসহ পরাস্ত করে নিহত করে। এদের দস্যুনেতা সিবাশ্চিয়ান গন্জালিস সন্দ্বীপ দখল করে সেখানকার মুসলমানদের নির্মূল করে।

এরপর গন্জালিস ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আরাকান অধিকারে ব্যর্থ হয়ে আরাকান-রাজের সঙ্গে মিলে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত দখল করে নেয়। মোগলরা এক প্রকাণ্ড বাহিনী এনে এদের পরাস্ত করে। তারপর গন্জালিস গোয়ার পর্তুগিজ শাসকের অধীনতা স্বীকার করে ডন ফ্রান্সিস নামক সেনাপতি সহ একদলসৈন্য এনে আরাকানের প্রান্তভাগ লুন্ঠন করে। আরাকান-রাজ ওলন্দাজদের সাহায্যে পর্তুগিজদের সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপ দখল করে নেন।

১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ সেনাপতি হুসেনবেগের সহায়তায় আরাকান-রাজকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে মোগলদের হৃত-ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন; ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তার সেনাপতি ওমেদ খাঁ ও হুসেনবেগ চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ দখল করে। এর বহু আগে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য সন্দ্বীপের পর্তুগিজ-শাসক কার্ডালোকে তার জমিদারি ধূমঘাটে এনে নিহত করেছিলেন; এতে অনেক পর্তুগিজ পাদ্রি আতঙ্কে বঙ্গদেশ ত্যাগ করেছিল।

আরাকান-রাজের সৈন্যদলের মধ্যে অনেক মগ ও অবৈতনিক পর্তুগিজ সৈন্য ছিল। এরা বছরে বারোমাস লুণ্ঠন, অপহরণ ও অত্যাচার চালাত। শায়েস্তা খাঁর এই দুর্ধর্ষ অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগিজ ও মগেরা অতি ক্ষিপ্রকারিতায় পালানোর (স্থানীয়ভাবে এই ঘটনা 'মগ-ধাওনি' নামে খ্যাত ছিল) সময় ১,২২৩টি কামান ফেলে যায়, কিন্তু অধিকাংশ ধনসম্পদ ঘড়ায় করে মাটিতে পুঁতে রেখে যায় (পরবর্তীকালে, মগ-পুরোহিতরা সাঙ্কেতিক মানচিত্রের সাহায্যে গোপনে এইসব স্থানে এসে ঘড়াগুলি উঠিয়ে নিয়ে যেতেন)। এইভাবে গোটা বাংলায় "মগের মুল্লুক"-এর অবসান ঘটে।

তবে ইংরেজ শাসনেও পর্তুগিজ হার্মাদদের দস্যুতার কথা শোনা যেত; ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দেও কলকাতায় মগ দস্যুর ভয় ছিল জনসমাজে। ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সরকার হাওড়ার শিবপুরে (এখনকার বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে) গঙ্গার একটা বাঁধ তৈরি করে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের আগমন পথ বন্ধ করে দেন।[১]

বিভিন্ন রচনায় উল্লেখ সম্পাদনা

কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ষোড়শ শতকে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে হার্মাদ জলদস্যুদের কথা উল্লেখ করেছেন; শ্রীমন্ত সদাগরের নাবিকেরা "রাত্রিদিন বাহি যায় হার্ম্মাদের ডরে"। বিভিন্ন পল্লীগীতিকায় উল্লেখ আছে, সমুদ্রতীরবর্তী জেলেরা একত্র হয়ে বৃদ্ধ দলপতির পরামর্শক্রমে হঠাৎ পেছন থেকে এসে হার্মাদদের প্রত্যেকের চোখে মুঠো মুঠো লঙ্কার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে পালাতে বাধ্য হত। পর্যটক বার্নিয়ারের ভ্রমণবৃত্তান্তে এই জলদস্যুদের অত্যাচার ও লুঠপাটের বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায়।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Dinesh Chandra Sen, Brihat Banga, 2nd volume, Dey's publishing: Jan 1993, Kolkata: 700073, page: 811-815, ISBN 81-7079-186-3

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা