হরেন ঘোষ ( ৮ ডিসেম্বর ১৮৯৫ – ৯ জুলাই ১৯৪৭) ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ইম্প্রেসারিয়ো (Impresario) তথা প্রমোদ পরিবেশক।[১] ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করানো ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত।

হরেন ঘোষ
হরেন ঘোষ
জন্ম(১৮৯৫-১২-০৮)৮ ডিসেম্বর ১৮৯৫
মৃত্যু৯ জুলাই ১৯৪৭(1947-07-09) (বয়স ৫১)
জাতীয়তাভারতীয়
সন্তানঅশোক ঘোষ
পিতা-মাতাগিরীন্দ্রলাল ঘোষ (পিতা)

জন্ম ও শিক্ষা জীবন

সম্পাদনা

হরেন ঘোষের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার অধুনা বাংলাদেশের তৎকালীন যশোহর জেলার শ্রীপুর গ্রামে তার মাতুলালয়ে। পিতা গিরীন্দ্রলাল ঘোষ। তার বিদ্যালয়ের পাঠ কলকাতার হেয়ার স্কুলে। ১৯১০-১১ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রাবস্থায় তিনি নিজের সম্পাদনায় বিদ্যালয়ের পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশের পর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই সময়েই তিনি সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হন। তারই উদ্যোগে ইংরাজী অনুবাদে শকুন্তলা নাটক নিউ থিয়েটার্সে অভিনীত হয় এবং সমাজের তৎকালীন সম্ভ্রান্ত নারী পুরুষ যোগ দেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে হরেন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ কৌশল শিখতে ইংল্যান্ড যান।

কর্মজীবন

সম্পাদনা

দেশে ফিরে তিনি 'সেন্ট্রাল অটোমোবাইল স্টোর্স অ্যান্ড বিজনেস সেন্টার' নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল নানা কলার বিষয়টিই পেশা হিসাবে গ্রহণ করা। [২] তিনি কলকাতার ধর্মতলা স্ট্রিটে 'সিনেমা সংক্রান্ত লাইব্রেরি' পত্তন করেন এবং এটি বহু জ্ঞানী গুণীশিল্পীর আড্ডাস্থল হয়। বাঙালিদের মধ্যে চলচ্চিত্র প্রসারে ও আগ্রহ বৃদ্ধিতে হরেন ঘোষ ছিলেন পথিকৃৎ। ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিতে আর্য ফিল্মস্ নামে এক চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে নিজের লেখা বুকের বোঝা নামে একটি নির্বাক চলচ্চিত্র, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রমথেশ বড়ুয়াকে দিয়ে অপরাধী ও পরে সৈনিক নামে তিনটি ছবি তৈরি করেন। তিনি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে নিউ থিয়েটার্স প্রতিষ্ঠায় বন্ধু বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে পরামর্শদানে সাহায্য করেন।

ইম্প্রেসারিয়ো হিসাবে অবদান-

ইম্প্রেসারিয়ো হিসাবে হরেন ঘোষের প্রথম এবং প্রধান খ্যাতি এদেশে উদয়শঙ্করের প্রতিভাবিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করায়। [১]উদয়শঙ্কর লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ আর্টসে প্রশিক্ষণের পর আনা পাভলোভার ট্রুপে 'হিন্দু বিবাহ' এবং 'রাধা কৃষ্ণ'র উপর দশ মিনিটের দুটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। পরে তিনি পাভলোভার সাথে বেশ কয়েকটি পারফরম্যান্সে অংশ নেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ভারতে ফিরে আসেন, কিন্তু তারপর তার যথেষ্ট প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও বিশেষকিছু করে উঠতে পারছিলেন না।[২] হরেন ঘোষ যখন বিষয়টি জানাতে পারলেন, হেমেন্দ্রকুমার রায় এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তারই ব্যবস্থাপনায় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট নিউ এম্পায়ারে উদয়শঙ্করের প্রথম প্রকাশ্য নৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করান। সেই অনুষ্ঠানে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ উপস্থিত ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক ও প্রখ্যাত সরোদ শিল্পী তিমিরবরণ ভট্টাচার্য, শিল্প সমালোচক অর্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখেরা। উদয়শঙ্করের অনুষ্ঠান সবাইকে মুগ্ধ করে আর তখন থেকেই উদয়শঙ্কর ও তিমিরবরণের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে হরেন ঘোষ বিদেশে দুজনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বিশ্ব জুড়ে অভিনন্দিত হন উদয়শঙ্কর আর তিমিরবরণের জুটি।[৩] নৃত্যশিল্পীরূপে সাধনা বসু, নীলিমা দাসকেও তিনি কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য শহরে এমনকি বিদেশেও নানা মঞ্চে উপস্থাপন করেন। তারই চেষ্টায় শান্তা রাও, রুক্মিনী দেবী, বালাসরস্বতী, গোপীনাথ প্রমুখ অনেক শিল্পী কলকাতায় অনুষ্ঠান করার প্রথম সুযোগ পান। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে আদিবাসী লোকনৃত্য ছৌ নাচ সর্বপ্রথম বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব হরেন ঘোষের ই। অর্থকষ্টে বিপন্ন বিশ্বভারতীর সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি বোম্বাইয়ে 'রবীন্দ্র-সপ্তাহ' পালনের ব্যবস্থা করেন। বহু অপরিচিত প্রতিভার বিকাশলাভে তিনি নানা সুযোগ করে দিয়েছেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত নোয়াখালির দাঙ্গা পীড়িত দুর্গতদের সাহায্যের জন্য নিউ এম্পায়ারে ভারত-সিংহলি নাচের অনুষ্ঠান করেন। সমাজকর্ম, ব্যক্তি বিশেষের প্রতিভা বিকাশে, ভারতের সংস্কৃতির প্রসারে তিনি সদাই কাজ করেছেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্র ও নৃত্যকলা নিয়ে ফোর আর্টস্ অ্যানুয়াল নামের এক পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনা করতেন।[৪] আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, মহাত্মা গান্ধীসহ দেশ-বিদেশের বহু ব্যক্তির রচনা ও ছবি পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি হেমেন্দ্রকুমার রায় সম্পাদিত সাপ্তাহিক নাচঘর পত্রিকাটি প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলেন।

হরেন ঘোষ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে একটি ন্যাশনাল থিয়েটার ওয়ার্কশপ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সেই মত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তাও ঠিক করেছিলেন।[২]

জীবনাবসান

সম্পাদনা

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুন ও জুলাই মাসজুড়ে কলকাতায় দাঙ্গা চলছিল। সেই সাম্প্রদায়িক হত্যালীলার জেরে হরেন ঘোষ ৯ জুলাই ধর্মতলা স্ট্রিটে ওয়াছেল মোল্লার দোকানবাড়ির একটি ঘরে তার নিজের অফিসে খুন হন [১]এবং সন্ধ্যা ৬টার সময় পার্ক স্ট্রিট থানার কাছে রাউডন স্ট্রিটে তার টুকরো টুকরো লাশের একটি স্যুটকেস পাওয়া যায়।[২]

উত্তরাধিকার

সম্পাদনা

২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের শতবর্ষ পূর্তিতে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুনের এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হয় গৌতম বাগচি সম্পাদিত গ্রন্থ- অদ্বিতীয় ইম্প্রেসারিয়ো হরেন ঘোষ শীর্ষক একটি গ্রন্থ এবং স্মারক বক্তৃতা - The Legendary Haren Ghosh (1895-1947) 'বিস্মরণ থেকে পুনরুদ্ভাসিত' প্রদান করেন অধ্যাপক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। [৫]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮৫৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "The Connoisseur"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-২৮ 
  3. বাগচি, গৌতম (২০২২)। অদ্বিতীয় ইম্প্রেসারিয়ো হরেন ঘোষ। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। 
  4. "Four Arts Annual"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-২৮ 
  5. The Legendary HarenGhosh (পিডিএফ), সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-২৮