স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী

বাঙালি সাধক

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী ( ১২ আগস্ট, ১৮৮৭ ― ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২১), বিংশ শতকের সূচনায় ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যে সমস্ত ধর্মীয় নেতা বিপ্লবকর্মে অংশগ্রহণ করেছিলেন,তাঁদের অন্যতম ছিলেন। [১]

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী
জন্ম
সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

১২ আগস্ট ১৮৮৭
গলাচিপায় পটুয়াখালী বৃটিশ ভারত বর্তমানে বাংলাদেশ
মৃত্যু৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২১
জাতীয়তাভারতীয়
আন্দোলনব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

সতীশচন্দ্র তথা স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার গলাচিপায় পিতার কর্মস্থলে। পিতা ষষ্ঠীচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেখানকার এক দারোগা। তবে পৈতৃক বাড়ি ছিল বরিশাল জেলার উজিরপুরে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পাশ করে ঢাকায় এফ.এ পড়েন।

কর্মজীবন ও বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনা

পৈতৃক গ্রাম উজিরপুর স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে কাজ শুরু করলেও দু-বছর পর বঙ্গভঙ্গ-রোধ আন্দোলনে যুক্ত হন। এরপর চলে আসেন বরিশালে। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা করেন। স্বদেশী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য অশ্বিনী কুমার দত্ত যে স্বদেশবান্ধব সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন তার সহ-সম্পাদক হন। রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক সতীশ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই সমিতির সম্পাদক। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সতীশচন্দ্রের প্রচেষ্টায় বরিশালে যুগান্তর বিপ্লবী দলের এক ঘাঁটি তৈরি হয়। শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত হলেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ নম্বর ধারায় বাংলার নয়জন নেতার সাথে অশ্বিনীকুমার ও সতীশ চট্টোপাধ্যায়কে বৃটিশ শাসক বন্দী করলে, স্বদেশবান্ধব সমিতি-র দেড় শতাধিক শাখার পরিচালনভার তার উপর এসে পড়ে। কিন্তু ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে বেআইনি ঘোষণা করে। অতঃপর তিনি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ব্রজমোহন কলেজ ও রামকৃষ্ণ মিশনের কাছেই প্রতিষ্ঠা করেন শঙ্কর মঠ। তিনি তখন থেকেই যুগান্তর দলের কাজকর্ম তার প্রতিষ্ঠিত এই মঠের মাধ্যমে চালাতে থাকেন। প্রকাশ্যে তার আদর্শ ছিল বেদান্ত প্রচার। বিপ্লবীরা এই মঠে যেমন নিরাপদ আশ্রয় পান, তেমনই আবার মঠ থেকে অনেক তরুণ বিপ্লবীও তৈরি করেন সতীশচন্দ্র।[২] এই মঠ গড়ে তোলা এবং ব্রিটিশ-বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে তাকে বিশেষ সাহায্য করেন অগ্নিযুগের অপর এক বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ। তবে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে তার কাশীতে যাতায়াত ছিল এবং সেখানেও একটি বিপ্লবী ঘাঁটি গড়ে তোলেন। সেই সূত্রে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। সংস্কতজ্ঞ পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা ও পাঠ সমানভাবে চালাতেন। শেষে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে গয়াধামে শ্রীমৎ শঙ্করানন্দ সরস্বতীর কাছে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন এবং স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী নামে পরিচিত হন। তবে এর মাঝে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহে অবস্থান কালে তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা ও মত বিনিময় করতেন। এখানে যোগেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার শিষ্য হন। বিপ্লবী নেতারা কলকাতায় ও বরিশালে তার পরামর্শ নিতেন। তার জনপ্রিয়তা ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বেড়ে যায় কাশীতেও। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে স্বগ্রামে অন্তরীণ রাখে। পরে নিজে শঙ্কর মঠে বাস করার অনুমতি পান। এইসময় বিপ্লবী নেতা যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও নলিনী কর বরিশালে তার সাথে আলোচনা করতে আসতেন। এসব ভালোভাবে দেখতে না পেরে তাঁকে সরকার মেদিনীপুরের মহিষাদলে অন্তরীণ রাখেন। তবে কেবল বিপ্লবীরা নয়, গ্রামের সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মচারী এমনকি মহিষাদলের রাজাও তার ভক্ত ছিলেন। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলি হল -

  • বেদান্ত দর্শনের ইতিহাস
  • রাজনীতি
  • কর্মতত্ত্ব
  • সবলতা ও দুর্বলতা

মহিষাদলে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। অতঃপর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পেয়ে আসেন। কিন্তু মহিষাদলের শান্তি পরিবেশ ভালো লাগায় পুনরায় মহিষাদলে ফিরে যান। কিন্তু পুনরায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে কলকাতায় তার শিষ্য যোগেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গৃহে আসেন এবং ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন।[১] তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে দেহ বরিশালে নিয়ে গিয়ে শঙ্কর মঠে সমাধিস্থ করা হয়।।[২]

স্মৃতিরক্ষা সম্পাদনা

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর অনুগামীরা কলকাতায় তার নামে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সরস্বতী লাইব্রেরী এবং শৈলেন্দ্রনাথ গুহরায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সরস্বতী প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তার আর এক শিষ্য যোগেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে হাওড়ার শিবপুরে শিবপুর শ্রীমৎ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. প্রথম খণ্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (২০১৬)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৪৩২,৪৩৩। আইএসবিএন 978-81-7955-135-6 
  2. "ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পীঠস্থান বরিশালের শঙ্কর মঠ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-২৫