শেরশাবাদিয়া ভাষা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যের একটি আঞ্চলিক কথ্য ভাষা

শেরশাবাদিয়া উপভাষা হলো বাংলা ভাষার বরেন্দ্রী-বাংলা উপভাষার একটি আঞ্চলিক কথ্যরূপ। এই ভাষাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্যতম কথ্যভাষা ।[১]

ভৌগোলিক বিস্তার সম্পাদনা

শেরশাবাদিয়া উপভাষাভাষী বাঙ্গালীরা মূলত পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে বসবাস করে। এই জেলাগুলি হল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তরদক্ষিণ দিনাজপুর এবং বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়া, কাটিহারকিসানগঞ্জ। এছাড়া ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পাকুড়সাহেবগঞ্জ জেলাতেও এই ভাষাটি প্রচলিত। এটি বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রচলিত প্রধান ভাষা।[২]

বর্তমান স্থিতি সম্পাদনা

এই উপভাষাটি বড়ো একটা ভৌগোলিক এলাকার মানুষের কথ্য বাংলা উপভাষা হলেও ধীরে ধীরে ভাষাটির প্রচলন কমে যাচ্ছে। আধুনিক প্রজন্মের শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে মান্য বাংলা ভাষার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে, ফলে উপভাষাটি ক্রমশ অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে। যদিও খুব সম্প্রতি নতুন প্রজন্মের কিছু সংখ্যক শিক্ষিত যুবকদের উদ্যোগে সামাজিক মাধ্যমে এই উপভাষার ব্যবহার ও সাহিত্য চর্চা বেড়েছে।

শব্দভাণ্ডার সম্পাদনা

শেরশাবাদিয়া উপভাষা বাংলা ভাষারই একটি আঞ্চলিক রূপভেদ। তবে এই ভাষার শব্দভাণ্ডারে অনেক নিজস্ব শব্দ বিদ্যমান। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বিহারী ভাষাসমূহের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। এই উপভাষায় বহুল প্রচলিত কিছু শব্দ হলো:

হামি- আমি, হামার- আমার, হামরা- আমরা, হামারঘে- আমাদের, উ- সে, অর- তার, অরা- তারা, অরঘে- তাদের, তোরঘে- তোদের, তোমারঘে- তোমাদের।

অ্যাজ- আজ, অ্যাঙ্গনা- আঙিনা, অ্যাকখানা- একখানা/একটা, ওসরা- উঠান, কপাট/দুয়ার- দরজা, আখা/চুল্হা- চুলা/উনুন, আচাক্কা- আচমকা/হঠাৎ, আঞ্ঝাট্টা- আন্দাজে, ইন্দারা/কুহাঁ- কুয়া, কম্মর/মাঁজা- কোমর, কবিতর- কবুতর/পায়রা, কাউয়া- কাক, কাঞ্জুস- কৃপণ, কান্ধা/পাটাল- কিনারা/পাড়, কেহু- কেউ, কুণ্ঠে- কোথায়, কেনে/কী গোনে- কেন, ক্যাল- কাল, কোনাগুজরা- ঘরকুনো, কোর্যা- করে, ক্যাইচ্যা- কাস্তে, ক্যাউচা- কেঁচো, ক্যাজিয়া- কাজিয়া/ঝগড়া, ক্যাল্ল্যাই- কেন্নো, খাট্টা- টক, খাদ্দোল- গভীর, খাম্বা- স্তম্ভ, খিঁচ্চা/জালি- কচি, খোরা- বাটি, গোঢ়্যা- ডোবা, গোহিল- গোয়ালঘর,  গড়ান- ঢাল, গতর- গা/দেহ, গহম- গম, গুদাম- বোতাম, গুষ্টি- বংশ, গুট্ঠি- আঁটি, ঘাঁটা/সরান- রাস্তা, ঘিনাহা- নোংরা, ঘিন্না- ঘৃণা, ঘ্যান- দুর্গন্ধ, চিকনা- পরিস্কার, চ্যাংড়া- যুবক, চ্যাতন- জাগ্রত, চ্যাল- চাল, ছিল্কা- খোসা, ছূট্টি- সজিনা, ছেঁচকি- খুন্তি, ছ্যাইহ্যা- ছায়া, জায়োঁই- জামাই, জাফত- নিমন্ত্রণ, টামাটুল/বিলাতি- টমেটো, টুঁটি- গলা, ট্যাং- পা/ঠ্যাং, ঠ্যাউনা- হাঁটু, ডেরেন/লালি- নালা, ডেরেস/পিন্হ্যান- পোশাক, ড্যাড়মা/মোটাহুঁশ- কাণ্ডজ্ঞানহীন, ড্যাল- ডাল, ড্যাহুর- প্রায়, ঢাকুন- ঢাকনা, তুরুন- জলদি, তোঁতড়া- তোতলা, ত্যালকাট্টা- আরশোলা, ত্যাল- তেল, থালি- থালা, থুতনি- চিবুক, দিরম- দেরি, দুপ্পহার- দুপুর, ধলো- সাদা, ধাদস- বোধবুদ্ধি, ধাপি- সিঁড়ি, নাড্ঢা- ন্যাড়্যা, নিন- ঘুম, নেইখো- নেই, ন্যাংটা- উলঙ্গ, পঁহাত- সকাল, পছিন্দ- পছন্দ, পাঁজরে- পাশে, প্যাইট- শ্রমিক, পাত- পাতা, পিপাহা- পেঁপে, পোখর- পুকুর, বতক- হাঁস, বল- বলদ, বহর্যা- বধির, বহু- বউ, বাঢ়ুন- ঝাড়ু, বিচ্চি- বীজ, বিল্যাই- বিড়াল, বেহুদ্দা- বদমাশ, বিহ্যা- বিয়ে, ব্যাটা- ছেলে, বেটি- মেয়ে, বেলে- নাকি, ব্যাগোইর- ছাড়া, ব্যারাম- অসুখ, ব্যায়গুন- বেগুন, ভক কোর্যা- জলদি, ভানি- ভাবি, ভুঁটি- ভুঁড়ি, ভুঁই- জমি, ভুঁষ- মহিষ, ভোক- খিদে, মাঁজা- কোমর, মিট্ঠা- মিষ্টি, ম্যাঁইয়া- স্ত্রী, ম্যাল্ল্যাই- অনেক, য্যানে- যেন, রৈদ- রোদ, লক কোর্যা- চুপিচুপি,  লদ্দি- নদী, লয়্যা/লতুন- নতুন, লসুন- রসুন, লা- ডিঙি নৌকা, লাঢ়ি- নাড়ি, লাত- লাথি, লাপিত- নাপিত, লাহারি- নাস্তা পানি, লাভি- নাভি, লিখাট্টু- নিষ্কর্মা, লিচ্ছাক্কা/ লিল্ল্যা- কেবলমাত্র, লিয়্যা- নিয়ে, লুল্হা- খোড়া, ল্যাগ্যা- জন্য, সভ্যাই- সবাই, সাঁঝ- সন্ধ্যা, সালুন- তরকারি, সোঁতে- সাথে, হলে- আস্তে, হাঁকাবাকি- তাড়াতাড়ি, হাড্ডি- হাড়, হ্যাণ্ঠা- একগুঁয়ে, হোবে- হবে।

• বিশেষ কিছু ক্রিয়াসমূহ

কহা- বলা, ঢুড়্যা- খোঁজা, লাড়া- নাড়া, লাচা- নাচা, গাহা- গাওয়া, লাহা- নাওয়া, বান্হা/বান্ধা- বাঁধা (বেঁধে দেওয়া), রান্হা, রান্ধা- রাঁধা (রান্না করা), পিন্হা/পিন্ধা- পরা (পরিধান করা), সান্হা/সান্ধা- ঢোকা (সেঁধিয়ে যাওয়া)।

খাঁড়িয়্যা থাকা- দাঁড়িয়ে থাকা, খ্যাস্ত্যা যাওয়া/ অ্যাল্যা যাওয়া- ক্লান্ত হয়ে পড়া, খ্যাঙ্গ্যা যাওয়া- কমে যাওয়া, ঘিনিয়ে রাখা- অপরিচ্ছন্ন রাখা, টেস করা- পরখ করা, ধপ, পড়া/কুদা- লাফ দেওয়া, পিন মারা- উস্কে দেওয়া, ব্যাঁড় দেওয়া- চাগিয়ে, ভকভক করা- বকবক করা, লক কোর্যা থাকা- চুপচাপ থাকা, লিঝিয়্যা দেখা- পর্যবেক্ষণ করা, শুত্যা থাকা- শুয়ে থাকা, নিন যাওয়া- ঘুমিয়ে পড়া, সিঝানো- সিদ্ধ করা, হাল বাহা- জমি কর্ষণ করা, হ্যালা- সাঁতার কাটা, ফুর্তি আয়- জলদি আয়।

গেলছিল- গিয়েছিল, চ্যাহ্যাছি- চেয়েছি, প্যাঠালছি- পাঠিয়েছি, অ্যাসছি- আসছি, য্যাচ্ছি- যাচ্ছি, করতোক- করতো, কহিতোক- বলতো, খ্যাতোক- খেতো

নমুনা বাক্যসমূহ সম্পাদনা

শেরশাবাদিয়া মান্য বাংলা
তোমারঘে বাড়ি কুণ্ঠে জী? তোমাদের বাড়ি কোথায় (গো)?
হামারঘে/হাঁরঘে বাড়ি জঙ্গিপুর জী, কেনে শোধ্যাইছো/পুছ করছো? আমাদের বাড়ি জঙ্গিপুর (গো), কেনো জিজ্ঞেস করছো?
তোমাকে কহনু বাটিখান লিয়্যা এইসো। তোমাকে বললাম বাটিটা নিয়ে এসো।
হামরা/হাঁরা ছুটুব্যালায় কত্ত লুক্কাচুন্নি খেলতুম! আমরা ছোটবেলায় কত লুকোচুরি খেলতাম!
হামি গেল পরশুদিন কোলকাত্তা গিয়্যাছিনু/গেলছিনু। আমি গত পরশুদিন কলকাতা গিয়েছিলাম।
তোরা অ্যাত্তটি লেচু খ্যায়্যা লিয়্যাছিস! তোরা এতটা লিচু খেয়ে নিয়েছিস!
তুই ক্যাল পঁহাতে বাগান থ্যাক্যা আম লিয়্যা আসবি। তুই কাল সকালে বাগান থেকে আম নিয়ে আসবি।
হামি লদ্দির দিকে গেলছিনু, বাজারে য্যাই নি খো। আমি নদীর দিকে গিয়েছিলাম, বাজারে যাই নি (কো)।
অ্যাজি, হামার/হাঁর ভ্যাইয়ের বিহাতে তোমারঘে জাফত রহিল। (ও গো,) আমার ভাইয়ের বিয়েতে তোমাদের নিমন্ত্রণ থাকল।
আপনারা ম্যাল্যাই পঢ়াশুনা জানা মানুষ, ভ্যাব্যা দ্যাখেন। আপনারা অনেক পড়াশোনা জানা মানুষ, ভেবে দেখেন।
হামি আগিই মাফ চাহাছি ছোট মুখে বড় কথা কহার ল্যাগ্যা। আমি আগেই মাফ চাইছি ছোট মুখে বড় কথা বলার জন্য।
অ্যাখন আর কেহু চুল্হাতে রান্ধে না, সভ্যাই গ্যাস লিচ্ছে। এখন আর কেউ চুলাতে/উনুনে রান্না করে না, সবাই গ্যাস নিচ্ছে।
অর বহিন হেলতে জানে না, স্যাই ল্যাগ্যা গোঢ়্যাতে লাহে(নাহে) না। ওর বোন সাঁতার জানে না, তাই পুকুরে স্নান করে না।

সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদনা

শেরশাবাদিয়া উপভাষা হল বাংলার ভাষারই একটি আঞ্চলিক উপভাষা। কিন্তু শেরশাবাদিয়া মানুষের কথ্য উপভাষার একটা নিজস্বতা ও স্বকীয়তা রয়েছে। যার কারণে সাহিত্যের বাংলা থেকে অনেকটা আলাদা এই উপভাষা। এই উপভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতি খুব একটা রচিত হয়নি; তবে নতুন প্রজন্মের কিছু যুবকদের মধ্যে এই উপভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সাহিত্য-সংস্কৃতি অপ্রতুল হলেও তাদের লোকসংস্কৃতির অংশ হিসাবে বিশেষ ধরনের গীত ও ফস্টি প্রচলিত আছে, যদিও সেগুলো বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।

• শেরশাবাদিয়া গীত

বিয়ে উপলক্ষে গাওয়া বিশেষ ধরনের গান বা গীতি, যা মহিলারা কোরাস আকারে আবৃত্তি করেন। এসব গানের রচনাশৈলী খুবই অনন্য এবং আকর্ষণীয়। বৈবাহিক জীবনের নানা দিক এই সমস্ত গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ:

কাঁখে কলস করয়্যা বেহুলা...

অ্যাঙনা ঝুম ঝুম জোড় কবিতর বাজে...

নওদাপাড়ার ছোড়াগ্যালা সভ্যাই কুকুর...

আইটে সহি খেলতে যাব কদম বাগানে...

হামার মনটা সরে না গে মা সসুরের সঙ্গে য্যাইতে...

• শেরশাবাদিয়া ফস্টি

জীবনের মূল্যবান নীতির উপর ভিত্তি করে প্রচলিত প্রবাদ বা প্রবচন, যা সাম্প্রতিক অতীতে সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল। বয়স্ক লোকেরা এখনও স্থান কাল পাত্র বিবেচনা করে এগুলি ব্যবহার করে। উদাহরণ স্বরূপ:

প্যাইট, ফের আঁচার! (একে তো মজুর তার ওপর আবার আচারের বাসনা)

অ্যাঁড়্যার মরণ বাঁশতলায়।

চোরের মন পুলিশ পুলিশ।

তোমার বেলায় রস, হামার বেলায় তাড়ি।

লাজ নাই হায়ালিয়াকে, লাজ নাই যায়ালিয়াকে।

এমন জায়গায় বাঁধো ঘর, কেহু আপন কেহু পর।

কয়লার ইল্লত যায় না ধুইল্যা, মানুষের খাসলত যায় না মইল্যা।

আসরে ঘশর মশর মগ্রিবে ঢিল, এশারে খাওন দাওন ফজরে নিন।

আরও দেখুন সম্পাদনা

খোট্টা ভাষা

শেরশাবাদিয়া জনগোষ্ঠী


তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. """West Bengal Commission for Backward Classes Report on Shershabadia""" (পিডিএফ)www.wbcbc.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০২১ 
  2. Hoque, Md Akramul (July, 2015)। "Sher Shah Abadi Community: A Study From Historical Perspective" (পিডিএফ)International Journal of Humanities & Social Science Studies (IJHSSS)। Volume II, Issue I। সংগ্রহের তারিখ 04-10-22  line feed character in |শিরোনাম= at position 27 (সাহায্য); এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)