শাহজালালের সফরসঙ্গী
শাহজালাল ও তার সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাদের কারণেই সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়। সিলেট বিজয়ের পরে শাহ জালালের সঙ্গী অনুসারী অনেক পীর দরবেশ সিলেটের আশ-পাশ শহর, জেলা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচার করেন।[১] সৈয়দ আলাউদ্দিনের মাজার কুইঘাটে নদীর তীরে ছিলো। নদী ভাঙনে তা বিলুপ্ত। তাঁর চার ছেলে। ১)সৈয়দ শাহ শামসুদ্দিন (র.), যার মাজার জগন্নাথপুরউপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে। ২) সৈয়দ তাজ উদ্দিন (র.), যার মাজার বালাগঞ্জের শেরপুরের তাজপুরে। ৩) সৈয়দ বাহা উদ্দিন (র), যার মাজার গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বরে। ৪) সৈয়দ রুকুন উদ্দিন, যার মাজার রজনগরের কদমহাটা
সফরসঙ্গীদের তালিকা
সম্পাদনামুফতি আজহারউদ্দীন সিদ্দিকী রচিত শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি নামক গ্রন্থানুসারে শাহজালালের সফরসঙ্গীদের নাম নিম্নরুপ:[১]
- সৈয়দ নাসির উদ্দীন মুড়ারবন্দ, হবিগঞ্জ।
- সৈয়দ ইয়াকুব শাহ কচুকাটা, বড়লেখা।
- আহমদ কবির, পাঠানটুলা, সিলেট।
- পীর গোরাচাঁদ
- হাজি ইউছুফ, শাহজালালের রওজার দক্ষিণ পার্শ্ব।
- আরিফ মুলতানি, পুরানলেন, সিলেট।
- শাহ আরেফিন
- শাহজাদা আলী ইয়ামেনি, শাহজালালের রওজার সন্নিকট পূর্বদিক।
- সৈয়দ আহমদ, রায়নগর, সিলেট।
- শেখ আব্দুল্লাহ, নাইওরপুল, সিলেট।
- কাজি ইলিয়াস উদ্দিন , কাজিটুলা, সিলেট।
- পীর হজরত বুড়া মিয়া ফকির (রঃ), বাইয়ারা, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা।
- সৈয়দ হামজা, ময়মনসিংহ।
- সৈয়দ ওমর সমরখন্দ, নাইওরপুল, সিলেট।
- শায়খ খিজির খাসদবির, চৌকিদেখি, সিলেট।
- শেখ খিজির, বারুতখানা, সিলেট।
- হাজি খলিল, শাহজালালের রওজার দক্ষিণ পার্শ্ব।
- খান্ডা ঝকমক, রায়নগর সিলেট।
- হাজি গাজি, শাহী ঈদগাহের পূর্ব পার্শ্ব, সিলেট।
- চশনি পীর, গোয়াইপাড়া, সিলেট
- তায়েফ সলিম, সিলাম (গোধরাইল)
- শেখ জকাই কাজিটুলা, সিলেট।
- জাকারিয়া আরাবী অজ্ঞাত।
- কাজী জাহান, জল্লারপার, সিলেট।
- সৈয়দ জিয়া উদ্দিন ও অন্য চার জন , পুরানলেন, পাঁচ পীরের মোকাম।
- শেখ পীর মজুমদারী, সিলেট।
- শাহ ফরিদ রওশন চেরাগ,মিলান দেউড়ি,শাহজালালের দরগার প্রাচীন সীমার উত্তর দিক।
- হাজী দরিয়া, শাহজালালের রওজার দক্ষিণ পাশে।
- খাজা নাসির উদ্দিন, (ওরফে শাহচট), গভর্মেন্ট হাইস্কুলের পরবর্তি নদীর তীরে।
- নূর উল্লাহ (ওরফে শাহনুর), বন্দর বাজার, দক্ষিণ দিক।
- পীর বুরহান উদ্দিন, কুশিরঘাট সাহেব বাজারের নিকট।
- পীর মানিক (ওরফে মানিকপীর), মানিক পীরের টিলা, সিলেট।
- মুখদুম হবিব (ওরফে মাখদুম সাহেব), দপ্তরী পাড়া, কানিহাটি পরগনা, কাউকাফন গ্রাম।
- মুখতার শহিদ মুখতার শহিদ মহল্লা।
- হাসান শহিদ, শহিদ মহল্লা, সিলেট।
- সৈয়দ আলাউদ্দিন, অজানা।
- সৈয়দ তাজ উদ্দিন (উপর্যুক্ত সৈয়দ আলাউদ্দিনের পুত্র) আওরঙ্গপুর পরগনা, গওহরপুর গ্রাম।
- সৈয়দ বাহাউদ্দিন, (উপর্যুক্ত সৈয়দ আলাউদ্দিনের পুত্র) ভাদেশ্বর।
- সৈয়দ রুকন উদ্দিন (উপর্যুক্ত সৈয়দ আলাউদ্দিনের পুত্র) কদমহাটা, রাজনগর ,মৌলভীবাজার।
- শাহ আলাউদ্দিন গহরপুর পরগনা, আলাজুর গ্রাম।
- খাজা আদিনা, চুড়খাই গ্রাম।
- সৈয়দ আফজল মিরগাও পরগনা, জালালপুর।
- খাজা আজীজ চিশতী, গহরপুর
- হাফিজ আতাউল্লাহ টিলাপাড়া মুক্তাপুর।
- শাহ কালা (ওরফে কালা মিয়া), গহরপুর পরগনা।
- শাহ শাহাবুদ্দীন,দরগাহ বাড়ী, বানিয়াচঙ।
- আঃ রহমান চাক্তাই (চাগতাই), পীরেরহাট, পীরগঞ্জ,রংপুর। (সম্ভবত)
- শাহ আদম খাকি, বদরপুর, করিমগঞ্জ, আসাম, ভারত ।
- সিরাজ উদ্দিন শাহ ইয়ামেনি, পূর্ব সরপুর (বর্তমান মখইভাঙ্গা), করিমগঞ্জ, আসাম, ভারত।
- শাহ তাকী-উদ-দীন, জালালপুর।
- সৈয়দ মাহমুদ চিন্তী শাহ,নবীগঞ্জ.সদর ঘাট.ফকির পাড়া.
- হযরত শাহ চেরাগ আলী (গ্রাম ধারন , গোবিন্দ গঞ্জ, ছাতক ,সুনামগন্জ) তথ্যসূত্র প্রয়োজন
- শাহ বদর বদরপুর, করিমগঞ্জ, আসাম, ভারত ।
- শাহ জিয়াউদ্দিন বুন্দাশিল বদরপুর, করিমগঞ্জ, আসাম, ভারত ।
- শাহ সিকন্দর বুন্দাশিল বদরপুর, করিমগঞ্জ, আসাম, ভারত ।
- সৈয়দ জাহান ওরফে জাঁহা পাথারকান্দি , প্রাচীন প্রতাপগড় রাজ্যের জঙ্গলে তাঁহার সমাধি অবস্থিত , করিমগঞ্জ , আসাম , ভারত ।
- দরিয়া পীর চন্দ্রপুর ,বড়লেখা , পাথারিয়া মৌলভীবাজার , বাংলাদেশ ।
- সৈয়দ বদরুউদ্দিন ওরফে শাহ বদর উদ্দিন বদরপট্টি , বখশীর হাট ,চট্টগ্রাম ,বাংলাদেশ।
- শাহ পরাণ খাদিম নগর , সিলেট , বাংলাদেশ।
- শাহরাস্তি বোগদাদি শ্রীপুর,শাহরাস্তি,চাঁদপুর, বাংলাদেশ।
- সৈয়দ শাহ মোস্তফা মোস্তফাপুর , মৌলভীবাজার , বাংলাদেশ।
- সৈয়দ শাহ গদাহাসান চুনারুঘাট , হবিগঞ্জ , বাংলাদেশ।
- ফতেহ গাজী বাগদাদী শাহজীবাজার , হবিগঞ্জ , বাংলাদেশ।
- জিন্দা পীর সিলেট , বাংলাদেশ।
- শাহ হামিদ ফারুকী মৌলভীবাজার বাংলাদেশ ।
- আরিফ মুলতানী সিলেট।
- রুকন উদ্দিন আনসারী ব্রাহ্মনবাড়িয়া।
- শাহ হামিদ ফারুকী মৌলভীবাজার।
- হেলিম উদ্দিন নূরনানি মৌলভীবাজার।
- গরীব খাকী
- আদম বাকী
- সোনা গাজী
- হাজী দরিয়া
- সৈয়দ কাসিম
- শেখ আলী ইয়ামেনি ২য়
- আরিফ ইয়ামেনি
- সৈয়দ বাহা উদ্দিন ভাদেশ্বর , গোলাপগঞ্জ , সিলেট।
- হযরত শাহ জকি উদ্দিন হোসাইনী (র:) , শ্যামপুর দায়রা শরীফ, রামগঞ্জ, লক্ষীপুর।
- শেখ ইলিয়াস শাহ রহঃ, বাদেদেউলী, ঘিলাছড়া , ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট ।
- হযরত শাফাই শাহ্ আউলিয়া( রহঃ) এর মাজার শরীফ, কিশোরগঞ্জ জেলা বাজিতপুর উপজেলা
সিলেট আগমনের প্রেক্ষাপট
সম্পাদনাবর্তমান সিলেট বিভাগ বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জনপদ। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পর জয়ন্তীয়া, লাউড় ও গৌড় নামে তিনটি স্বতন্ত্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। দশম শতাব্দিতে এ অঞ্চলের কিছু অংশ বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয় বলে জানা যায়। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চল মুসলমানদের দ্বারা অধিকৃত হয়। শাহজালাল ও তার সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার আগমন কাল পর্যন্ত ছোট বড় আরো কয়েকটি রাজ্যে সিলেট বিভক্ত ছিল। তখনকার সময়ে সিলেটের গৌড় রাজ্য (বর্তমান সিলেট জেলা) সৈন্য সামন্ত সহ সর্ব দিক দিয়ে শক্তিশালী ছিল। রাজা গৌবিন্দ ছিলো এর শাসক। গৌড়ের রাজা বিধায় গৌড় গোবিন্দ নামে অভিহিত হত। গোবিন্দের রাজ্য জড়িবটি ও জাদুটোনার জন্য বিখ্যাত ছিল। রাজা গৌড়-গোবিন্দ ছিল একজন অত্যাচারী রাজা। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলের জন্মোত্সব উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে, গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। বুরহান উদ্দিন বাংলার তৎকালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তার ভাগিনেয় সিকান্দর গাজীকে প্রকাণ্ড সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সিলেটের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ ভৌতিক শক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন। পরবর্তিতে বাংলা রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের দিল্লীর সম্রাটের আলাউদ্দীন খিলজীর মাধ্যমে আধ্যাতিক শক্তিসম্পন্ন মোসলমান সৈন্য প্রেরণ ধারা গৌড় গোবিন্দকে শায়েস্তা করা এবং সিলেট বিজয় নিশ্চিত হন। এরই প্রেক্ষিতে সম্রাটের আলাউদ্দীন খিলজী সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের মধ্যে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। এদিকে গাজী বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এসময় শাহজালালও তার সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহ জালালের সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন নিজের দুঃখময় কাহিনী তার নিকট বর্ণনা করেন। শাহ জালাল দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীন সহ ২৪০ জন সঙ্গীসহচর নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহ জালাল সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহ জালালের শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন ধর্মযোদ্ধা অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এভাবেই সিলেট পৌছা পর্যন্ত শাহজালালের সঙ্গী ৩৬০ জনে পরিণত হয়।[২] এবং পরবর্তীতে সংঘটিত যুুুুুদ্ধে শাহ জালাল (রহঃ) এর সৈন্যদলের নিকট গৌড় গোবিন্দের পরাজয় হয়।
শাহজালালের পরিচিতি
সম্পাদনাহযরত শাহজালাল ছিলেন একজন বিখ্যাত সুফি দরবেশ। তার রওজা হতে প্রাপ্ত ফলক-লিপি সুহেলি ইয়্যামনি অনুসারে ৬৭১ হিজরী মোতাবেক ১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে শাহ জালাল জন্মগ্রহণ করেছেন। তার পিতার নাম ছিল মাহমুদ। তিনি ছিলেন মক্কার প্রশিদ্ধ কোরায়েশ বংশের লোক। আর মাতা তার মা ছিলেন সৈয়দ বংশের। শাহ জালালের জন্মস্থান ছিল হেজাজ ভূমির দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তের ইয়েমেন প্রদেশের কুনিয়া নামক শহর। শাহ জালাল যখন তিন মাসের শিশুবালক, তখনই তার মাতার মৃত্যু হয় এবং পাঁচ বৎসর বয়স কালে তিনি পিতা হারা হন। শিশু শাহজালালকে প্রতিপালন করেন মামা সৈয়দ আহমদ কবীর। তিনিই শাহজালাল বয়ঃপ্রাপ্তির পর তার ধর্ম জীবনের গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলেনেন। কিছু দিনের মধ্যেই ধর্মগুরু বিভিন্ন কাজে তার প্রিয় শিষ্য শাহজালাল সিদ্ধিলাভের পরিমাণ বুঝতে পারেন। তারপর মামা শাহজালালকে পূর্বদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। [১][২] শাহজালাল তার পীরের কথা অনুযায়ী হাজী ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কিছু সঙ্গী সাথি নিয়ে পুর্বাদেশ (সিলেট) অভিমুখে সফর যাত্রা শুরু করেন।