শামসুদ্দিন আহমদ (চিকিৎসক)

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত হাসপাতালের চিকিৎসক (১৯২০-১৯৭১)

শামসুদ্দিন আহমদ(জন্মঃ ১ আগস্ট,১৯২০; আম্বরখানা, সিলেট – মৃত্যুঃ ৯ এপ্রিল,১৯৭১; শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল) একজন চিকিৎসক, সমাজসেবী, শহীদ বুদ্ধিজীবী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় তিনি পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন।

শামসুদ্দিন আহমদ

পারিবারিক ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

শামসুদ্দিন আহমদের পিতা ইমানউদ্দিন আহমদ ছিলেন রেলওয়ে বিভাগের একজন কর্মকর্তা এবং মাতা রাশেদা বেগম। শামসুদ্দিন আহমদ ১৯৩৯ সালে সিলেট সরকারি হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করে সিলেট এম সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৪১ সালে আইএসসি পাস করেন। তিনি ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন এবং লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স থেকে ১৯৬২ সালে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সম্পাদনা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে শামসুদ্দিন আহমদ দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে আসা আহত রোগীদের চিকিৎসার জন্য বড় মাপের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংক খোলেন এবং আহত রুগীদের চিকিৎসার জন্য একটি ইমার্জেন্সি স্কোয়াড গঠন করেন। একইসাথে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় সহায়তা প্রদান করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করছেন এমন তরুণ চিকিৎসকদের ওষুধপত্রের যোগান সরবরাহ করেন। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল তামাবিল সীমান্ত পথে একটি ইতালীয় পর্যবেক্ষক দল সিলেটে পৌঁছে। এসময় ডাঃ শামসুদ্দিন এই দলটিকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত রুগীদের ঘুরে দেখান যাতে তারা বুঝতে পারেন যে, কীভাবে পাকবাহিনী নিরীহ জনগণের উপর নগ্ন হামলা চালাচ্ছিল। টিমের সদস্যরা পাকবাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য রেকর্ড করে নিয়ে গণ-মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করেন।

সামাজিক কার্যক্রম সম্পাদনা

শামসুদ্দিন আহমদ ছাত্র জীবনে একজন স্কাউট লীডার ছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৪৬ সালে নিজ উদ্যোগে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। তাদের সহায়তায় তিনি কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দাঙ্গা কবলিত লোকদের উদ্ধার ও আহতদের চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯৫৪-১৯৫৫ এর দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেসিডেন্ট সার্জন থাকাকালে তিনি পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স কোর এবং কয়েকটি ত্রাণ স্কোয়াড গঠন করেন যা বন্যাপীড়িত লোকদের সাহায্যের জন্য দেশের বিভিন্ন অংশে কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৫৮ সালে সারাদেশে মহামারী আকারে গুটি বসন্ত দেখা দিলে এর প্রতিরোধে তিনি নিজ উদ্যোগে চিকিৎসক ও মেডিক্যাল ছাত্রদের সমন্বয়ে কয়েকটি দল গঠন করেন। মহামারীর বিস্তাররোধে দলগুলো দেশজুড়ে কর্মসূচি পরিচালনা করে। শামসুদ্দিন আহমদ ছিলেন একাধারে জনহিতৈষী ব্যক্তিত্ব, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অনুরাগী। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আসাম মুসলিম স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সভাপতি। এছাড়াও শামসুদ্দিন আহমদ ইস্ট পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি, পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স কোর-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জালালাবাদ অন্ধ-কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, সিলেট আম্বরখানা গার্লস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, টিবি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা, সিলেটের কয়েকটি মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং রাইফেল ক্লাবের সদস্য ছিলেন।

শাহাদাত বরণ সম্পাদনা

সিলেট শহরে পাকবাহিনীর অত্যাচার ও গণহত্যা ব্যাপকতর হয়ে উঠে। ফলে মেডিকেল কলেজের ছাত্র, শিক্ষক ও চিকিৎসকরা শহর ছেড়ে শহরতলি এলাকায় আশ্রয় নেন। শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের মহিলা নার্সদের তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়ে দেন। কিন্তু তিনি তার সহকর্মী ডাঃ শ্যামল কান্তি লালা, নার্স মাহমুদুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী এবং জনকয়েক চিকিৎসা সহকারিকে নিয়ে হাসপাতালে রুগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকেন। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল তৎকালীন সিলেট মেডিকেল কলেজের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নিকটবর্তী পাহাড়ের উপরে অবস্থিত সিভিল সার্জনের বাংলো থেকে আক্রমণ পরিচালনা করে। গুলির আঘাতে পাকসেনাদের গাড়ি বহরের প্রথম জিপটি উল্টে যায়। ফলে তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা তাৎক্ষনিকভাবে হাসপাতাল এলাকা ঘিরে ফেলে। তারা হাসপাতাল ও এর আশপাশের এলাকা থেকে লোকজনকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। হাসপাতাল ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়া গেরিলা যোদ্ধারা তখন বিচ্ছিন্নভাবে সরে পড়ে।

হানাদার বাহিনীর মেজর রিয়াজের নেতৃত্বে একদল পাকসেনা হাসপাতালে প্রবেশ করে। ভেতরে কোনো মুক্তিযোদ্ধা না পেয়ে তারা ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ, ডাঃ শ্যামল কান্তি লালা, নার্স মাহমুদুর রহমান, পিয়ন মোঃ মুহিবুর রহমান ও মোখলেছুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী সহ মোট নয়জনকে হাসপাতাল থেকে বাইরে এনে চত্বরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। প্রথমে ডাঃ শামসুদ্দিনের বাম উরুতে গুলি করা হয়। দ্বিতীয় গুলিটি তার পেটের বা পাশে বিদ্ধ হয় এবং তৃতীয় গুলিটি তার বক্ষ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সাথে সাথে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর লাইনে দাঁড় করানো সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ডাঃ শামসুদ্দিন ও তার শহীদ সহকর্মীদের হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সমহিত করা হয়।

স্বীকৃতি সম্পাদনা

শামসুদ্দিন আহমদের নামে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ ছাত্রাবাস। বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ জাতির জন্য তার আত্মদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শামসুদ্দিন আহমদের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা