২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোররাতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের কারণে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় রায়হানের।[১] পুলিশ হেফাজতে রায়হানকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে মানব বন্ধন হয়।[২] ওই ঘটনায় নির্যাতনের অভিযোগ এনে রায়হানের স্ত্রী হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা দায়ের করেন।[৩]

রায়হান হত্যা
তারিখ২১ অক্টোবর ২০২০
অবস্থানসিলেট মেট্রোপলিটন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি
মৃতরায়হান
দোষী সাব্যস্তহত্যা, হামলা

ঘটনা সম্পাদনা

১১ অক্টোবর ভোরে ওসমানী হাসপাতালে গুরুতর আহতাবস্থায় রায়হানকে ভর্তি করেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেকে এলাহী। ভর্তির ঘণ্টাখানেক পর রায়হান হাসপাতালে মারা যান।[৪] পুলিশ প্রথমে দাবি করে, ছিনতাইয়ের দায়ে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে তিনি নিহত হন। তবে রায়হানের পরিবারের অভিযোগ, কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে নিহত হন রায়হান।[৫] নিহতের স্ত্রী কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ‘তার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে ‍পুলিশি হেফাজতে রেখে তার হাত-পায়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতব্যাপী নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা যান।’[২]

নিহতের সৎ বাবা হাবিবুল্লাহ চৌধুরীও বলেন, ‘সকালে ফাঁড়িতে যাওয়ার পর এক পুলিশ সদস্য আমার কাছে ১০ হাজার টাকা চান। এসময় পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এসআই আকবর। তখন তিনি সাদা পোশাকে ছিলেন ও মুখে মাস্ক পরা ছিল। তিনি আমাকে বলেন, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’[৫]

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, তাদের আড়াই মাস বয়সী একটি সন্তান রয়েছে। গত ১১ অক্টোবর ভোর ৪টা ৩৩ মিনিটের দিকে ০১৭৮৩৫৬১১১১ মোবাইল নম্বর থেকে নিহতের মায়ের নম্বরে ফোন যায়। ফোন রিসিভ করেন রায়হানের সৎ বাবা হাবিবুল্লাহ। ফোন রিসিভ করতেই রায়হান বলেন, আমাকে বাঁচাও, টাকা নিয়ে বন্দরফাঁড়িতে আসো। হাবিবুল্লাহ ভোর ৫টা ৩০ মিনেটের দিকে টাকা ফাঁড়িতে পৌছান।

তদন্ত কমিটির একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, এসআই হাসান উদ্দিন ও সাংবাদিক নোমান মিলে ১১ অক্টোবর বন্দরবাজার ফাঁড়ির সিসি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক পরিবর্তন করে নতুন হার্ডডিস্ক সংযোজন করে। সাংবাদিক নোমান গ্যালারিয়া শপিং সিটির ফ্রেন্ডস কম্পিউটার নামের এক দোকান থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় ৫০০ গিগাবাইটের একটি হার্ডডিস্ক ক্রয় করে, যার ইনভয়েস নম্বর ২৪৬০২। সেই মার্কেটের সিসি টিভির ফুটেজও সংগ্রহ করে তদন্ত কমিটি। এরপর সেই সাংবাদিক কম্পিউটারের দোকান থেকেই একজনকে নিয়ে যান সেই হার্ডডিস্ক পরিবর্তনের জন্য।[৬]

ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহত রায়হানের মরদেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এসব আঘাতের ৯৭টি ফোলা আঘাত ও ১৪টি ছিল গুরুতর জখমের চিহ্ন। এ আঘাতগুলো লাঠি দিয়েই করা হয়েছে। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।[৭]

রায়হান হত্যার আলামত সংগ্রহ করার দাবি জানিয়ে রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, ১০ অক্টোবর রাতে রায়হানকে যখন পুলিশ ধরে নেয় তখন তার পরনে ছিল নীল শার্ট। অথচ পরদিন ১১ অক্টোবর সকালে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পড়ে থাকা রায়হানের মরদেহে ছিল লাল শার্ট। এছাড়া লাশ হস্তান্তরের সময় তার মোবাইল ফোনও ফিরিয়ে দেয়নি পুলিশ। রায়হান মারা যাওয়ার একমাস পরও এর কোনটিই ফিরে পাইনি আমরা।[৮]

মামলা সম্পাদনা

পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের কারণে মৃত্যুর পর এসআই আকবরসহ চার পুলিশকে বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়।[৯] ঘটনার পর আকবর পালিয়ে যায়।[১০] নিহত রায়হানের স্ত্রী বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করলে মামলাটি পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে পিবিআইয়ের নিকট তদন্তের জন্য দেয়া হয়।[১১] সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জানান, ‘পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে তদন্তে গাফিলতি ও এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়ার পলায়নের কারণে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) সৌমেন মৈত্র এবং এসআই আব্দুল বাতেনকে প্রত্যাহার করা হয়।[১২] রায়হানকে নির্যাতনের মূল হোতা ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেনকে পালাতে সহযোগিতা ও তথ্য গোপনের অভিযোগে এসআই হাসান উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।[১৩] এমনকি বন্দর বাজার ফাঁড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নষ্ট করারও অভিযোগ রয়েছে হাসান উদ্দিন ও এক স্থানীয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।

গ্রেফতার সম্পাদনা

বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশ নির্যাতনে নিহত রায়হান হত্যা মামলায় সিলেট পুলিশ লাইন্স থেকে ২৪ অক্টোবর বহিষ্কৃত পুলিশ কনস্টেবল হারুনুর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়।[১৪] পরে গ্রেপ্তারকৃত কনস্টেবল হারুন রশিদকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।[১৫] পালিয়ে থাকার ২৮ দিনের মাথায় ভারতে পলায়নের সময় সিলেটের কানাইঘাটের ডনা সীমান্ত থেকে আটক করা হয় প্রধান আসামী আকবরকে গ্রেফতার করা হলেও আদালতের রায় এখনো আসেনি।[৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "রায়হান হত্যা: এসআই আকবরসহ ৬ জনের বিচার শুরু"চ্যানেল আই। ১৮ এপ্রিল ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  2. "সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে যুবকের মৃত্যু: বরখাস্ত ৪, প্রত্যাহার ৩"বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। অক্টোবর ১২, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  3. "পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যু: সাক্ষীদের জেরার আবেদন আসামিপক্ষের"। সমকাল। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ 
  4. "রায়হান হত্যাকাণ্ড: আরও এক পুলিশ সদস্য গ্রেফতার"বাংলা ট্রিবিউন। ২৪ অক্টোবর ২০২০। ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  5. "রায়হান হত্যাকাণ্ড: নায়ক থেকে 'ভিলেন' এসআই আকবর"। banglanews24। অক্টোবর ১৩, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  6. "এসআই হাসান ও এক সাংবাদিক মিলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাল্টায়"। jugantor। ২১ অক্টোবর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  7. "রায়হান হত্যাকাণ্ড: ৭ দিনের রিমান্ডে প্রধান আসামি এসআই আকবর"দৈনিক ইত্তেফাক। ১০ নভেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  8. "রায়হান হত্যাকাণ্ডের আলামত সংগ্রহ করার দাবি"দৈনিক জনকণ্ঠ। ১৫ নভেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  9. "রায়হান হত্যা: এসআই আকবরসহ ৬ জনের বিচার শুরু"। চ্যানেল আই। ১৮ এপ্রিল ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  10. "রায়হান হত্যাকাণ্ড: এএসআই আশেক এলাহীকে গ্রেপ্তার দেখালো পিবিআই"। চ্যানেল আই অনলাইন। ২৯ অক্টোবর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  11. "রায়হান হত্যা: রিমান্ড শেষে কারাগারে কনস্টেবল হারুন"। channelionline। ১ নভেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  12. "রায়হান হত্যা: আরও দুই পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার"। চ্যানেল আই। ২৫ নভেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  13. "এসআই আকবরকে পালাতে সহায়তা করায় এসআই হাসান বরখাস্ত"দৈনিক যুগান্তর। ২১ অক্টোবর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  14. "রায়হান হত্যা: গ্রেপ্তার এএসআই ৫ দিনের রিমান্ডে"। চ্যানেল আই অনলাইন। ২৯ অক্টোবর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  15. "রায়হান হত্যা: কনস্টেবল হারুন রশিদ ৫ দিনের রিমান্ডে"। চ্যানেল আই। ২৪ অক্টোবর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩