রসু খাঁ

বাংলাদেশের প্রথম ধারাবাহিক খুনি

রসু খাঁ হল বাংলাদেশের প্রথম ধারাবাহিক খুনি।[১][২][৩] নারীদের হত্যা করার পূর্বে ধর্ষণ করত। সে ১১ জন নারীকে হত্যা করেছে বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল। রসু খাঁয়ের হত্যার শিকার নারীরা ছিলেন ১৭ থেকে ৩৫ বছর বয়সের পোশাক কর্মী।[২][৩][৪]

রসু খাঁ
জন্ম১৯৭৬/১৯৭৭
জাতীয়তাবাংলাদেশি
অপরাধের অভিযোগখুন
দণ্ডমৃত্যুদণ্ড
হত্যাকাণ্ড
হত্যা১১ (দাবিকৃত)
উদ্দিষ্ট তারিখ২০০৯

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

রসু মিয়ার আসল নাম রশিদ খাঁ।[২] তার বাবা আবুল হোসেন ওরফে মনু খাঁ ছিলেন একজন ক্ষেতমজুর। রসু খাঁর বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের মদনা গ্রামে।[৫]

অপরাধ জীবন সম্পাদনা

গ্রেফতার হবার পর রসু খাঁ পুলিশি জেরায় জানায় যে, বিয়ের আগে সে এক মেয়েকে ভালবাসত। এই ঘটনার জের ধরে ঐ মেয়ের ভাইয়েরা তার হাত ভেঙ্গে দেয়। এরপর সে তার এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।[৬] সে তার অপমানের প্রতিশোধ নিতে ১০১ টি খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে ১০১ টি খুন করার পর সন্ন্যাসী হয়ে মাজারে মাজারে ঘুরে ধার্মিক জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।[৫]

রসু খাঁ নারীদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলত। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার পর ধর্ষণ করে হত্যা করত তাদের। তার সিরিয়াল কিলিংয়ের সূত্রপাত ঘটে ২০০৭ সালে তার শ্যালক মান্নানের স্ত্রী রিনাকে হত্যার মাধ্যমে।[৫] মিথ্যা কথা বলে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার ভাটিয়ালপুরে এনে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে তাকে ফেলে দেন রসু খাঁ। এরপর একে একে আরো দশটি খুন করে সে। তিনি সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২০ জুলাই তার ভাগ্নে জহিরুল ও তাদের সহযোগী ইউনুছকে সাথে নিয়ে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার হাসা গ্রামের একটি খালপাড়ে ধর্ষণ শেষে খুন করে পারভীন নামের এক নারীকে।[৪][৭]

রসু খাঁ ঢাকাগাজীপুর এলাকায় সে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। খুন ছাড়া ছিনতাই, ডাকাতি, বাড়ি লুট, বোমাবাজিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত থাকলেও চুরিই ছিল তার প্রধান পেশা।[৬] অবশেষে ২০২২ সালে অপরহণ মামলায় মুক্তি পান রসু খাঁ।[৮]

গ্রেফতার সম্পাদনা

২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সালের পর্যন্ত চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার পুলিশ ছয়টি অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ উদ্ধার করে। এই লাশগুলোর প্রত্যেকটিই ছিল মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষণের শিকার হওয়া। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার পুলিশ পারভিন নামে এক নারী লাশ উদ্ধার করে। ঐ ঘটনার পর এক ব্যক্তি ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে একটি মোবাইল নাম্বার থেকে ফোন করে এবং জানায় যে, পারভীন নামের ঐ নারীকে সে রিকসায় করে বাসস্ট্যান্ড থেকে বহন করে এনেছে। সে দুই যুবকের নাম উল্লেখ করে জানায় যে, এরা ঐ নারীকে (পারভীন) ধর্ষণের পর হত্যা করেছে।[২][৫] ফোন করার সময় ঐ ব্যক্তি ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে নিজের নাম বাবুল বলে উল্লেখ করে।[৯]

ফোনে অভিযোগ পাবার পর পুলিশ ঔ দুই যুবককে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার করার পর পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, ঐ দুই ব্যক্তি পারভীনকে ধর্ষণের সাথে জড়িত নন। এরপর পুলিশ ঐ নাম্বারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে নাম্বারটি বন্ধ পায়। পুলিশ ঐ নাম্বারের হদিস বের কর‍তে এক নারী সোর্সকে কাজে লাগায়। একমাস পর ঐ নারী সোর্স পুলিশকে অবহিত করে যে, ঐ নাম্বারটি খোলা হয়েছে। পুলিশ ঐ নাম্বারে যোগাযোগ করে জানতে পারে ঐ সিমটি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের গাজীপুর বাজারের এক আখ ব্যবসায়ী তাজুলের নিকট থেকে কেনা হয়েছে।[৫] পরে পুলিশ তাজুলকে আটক করলে তাজুল জানায় যে, রসু খাঁ ও মিজান নামের দুই ব্যক্তি মসজিদ থেকে ফ্যান চুরি করতে গেলে সে ও নৈশপ্রহরী মিলে তাদের দুজনকে হাতেনাতে আটক করে। তখন সে রসু খাঁর কাছ থেকে সিমটি কেড়ে নেয় এবং পরে সেটি ১০০ টাকায় বিক্রি করে দেয়।[৫] ঐ ফ্যান চুরির ঘটনায় হাজতবাসের পর জামিনে বেরিয়ে এসেছিল রসু খাঁ।[২] পুলিশ তখন নিশ্চিত হয় যে, তাদের কাছে রসু খাঁ ফোন করেছিল। এরপর, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার মিশন হাতে নেয়। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর গাজীপুরের টঙ্গীর মিরাশপাড়া থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে।[২][৫][১০]

গ্রেফতারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। প্রথমদিকে কিছুতেই মুখ না খুললেও সে পরে পারভীনকে খুনের কথা শিকার করে সে। এরপর‍, একে একে আরো দশজন নারীকে হত্যা করার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে রসু খাঁ।[৫] তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ১১ টি মামলা।[৭][১১][১২]

গ্রেফতার হবার পর সে স্বীকার করে যে সে একজন পেশাদার অপরাধী ও সে বিভিন্ন রকম অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।[৬] গ্রেফতার হবার পর একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল রসু খাঁ।[১৩]

মামলা সম্পাদনা

পপি হত্যা মামলা সম্পাদনা

২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলার নয়ারহাটের একটি খাল থেকে পুলিশ পপি নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের কাছে পপি হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল রসু খাঁ। কিন্তু, আদালতের রায়ে নির্দোষ বলে প্রমাণিত হয় সে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক রবিউল হাসান তাকে পপি হত্যা মামলায় বেকসুর খালাস প্রদান করেন।[৭][৯][১৪][১৫][১৬]

শাহিদা হত্যা মামলা সম্পাদনা

২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর শাহিদাকে চাঁদপুর সদর উপজেলার সোবহানপুরে ডাকাতিয়া নদীর পারে শাহিদাকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি প্রদান করেছিল রসু খাঁ। আদালত ২০১৫ সালে ২২ এপ্রিল শাহিদা হত্যা মামলার আসামী রসু খাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুণাভ চক্রবর্তী।[৩][১০][১১][১২][১৭]

পারভীন হত্যা মামলা সম্পাদনা

২০১৮ সালের ৬ মার্চ পারভীন হত্যা মামলায় তাকে সহ তার ভাগ্নে জহিরুল ও তাদের সহযোগী ইউনুছকে ফাঁসির আদেশ দেন চাঁদপুরের নারী ও শিশু আদালতের বিচারক আবদুল মান্নান।[৪][১৮][১৯][২০][২১]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

রসু খাঁ দুই নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। প্রথম বিয়ের আগে তাকে কনে দেখতে দেয় নি বিয়ের ঘটক।[৩] তার প্রথম স্ত্রী মণির এক চোখ অন্ধ ছিল। প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে তার বোন রীনাকে বিয়ে করেছিল রসু।[৫] রীনার সাথে বিয়ে করার পর সে গাজীপুরের টঙ্গীতে বসবাস শুরু করেছিল।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "সেই রসু খাঁর ফাঁসি"জনকণ্ঠ। ২৭ এপ্রিল ২০১৫। ১৭ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  2. "যেভাবে রসু সিরিয়াল কিলার"যুগান্তর। ২৩ এপ্রিল ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  3. "সেই সিরিয়াল কিলার রসু খাঁর মৃত্যুদণ্ড"ইত্তেফাক। ২৩ এপ্রিল ২০১৫। ১৭ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  4. "ক্রমিক খুনি রসু খাঁসহ ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড"প্রথম আলো। ৬ মার্চ ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  5. "যেভাবে সিরিয়াল কিলার"বাংলাদেশ প্রতিদিন। ২৩ এপ্রিল ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  6. "অন্যের জন্যও খুন করেছেন রসু"প্রথম আলো। ১৩ অক্টোবর ২০০৯। ২০১৯-০৬-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  7. "একে একে উদ্ধার হলো ১১ নারীর লাশ"বাংলাদেশ প্রতিদিন। ১২ জানুয়ারি ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  8. প্রতিনিধি। "অপহরণ মামলায় খালাস পেলেন 'ক্রমিক খুনি' রসু খাঁ"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২৭ 
  9. "সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ বেকসুর খালাস"জনকণ্ঠ। ২২ আগস্ট ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  10. "এক ভয়ংকর সিরিয়াল কিলারের নাম রসু খাঁ"চ্যানেল আই। ২২ এপ্রিল ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  11. "সিরিয়াল কিলার রসু খাঁর ফাঁসির আদেশ"কালের কণ্ঠ। ২৩ এপ্রিল ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  12. "সেই রসু খাঁর মৃত্যুদণ্ড"বিডিনিউজ২৪.কম। ২২ এপ্রিল ২০১৫। ১৭ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  13. "ক্রমিক খুনি রসু খাঁ ফের তিন দিনের রিমান্ডে"প্রথম আলো। ১৬ অক্টোবর ২০০৯। ১৭ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  14. "এক মামলায় খালাস পেলেন সেই রসু খাঁ"প্রথম আলো। ২১ আগস্ট ২০১১। ২০১৯-০৬-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  15. "পপি হত্যা মামলায় খালাস পেলেন রসু খাঁ"বিডিনিউজ২৪.কম। ২১ আগস্ট ২০১১। ১৭ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  16. "প্রথম মামলায় খালাস সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ"বাংলানিউজ২৪.কম। ২১ আগস্ট ২০১১। ১৭ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  17. "সেই রসু খাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ"প্রথম আলো। ২৩ এপ্রিল ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  18. "সিরিয়াল কিলার রসু খাঁসহ ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড"সমকাল। ৬ মার্চ ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  19. "আরেক মামলায় সেই রসু খাঁর মৃত্যুদণ্ড"এনটিভি। ৬ মার্চ ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  20. "সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ সহ ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড"চ্যানেল আই। ৬ মার্চ ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯ 
  21. "আরেক মামলায় সেই রসু খাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ"কালের কণ্ঠ। ৭ মার্চ ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৯