রজব আলী
রজব আলী খান বৃটিশ ভারতের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন যিনি হাবিলদার রজব আলী নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সাথে সিপাহী বিপ্লবের সময় চট্টগামের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।[১][২] তারা ব্রিটিশ জেলখানায় আক্রমণ করে সকল বন্দীকে মুক্ত করে। সিপাহী জামাল খানকে সাথে নিয়ে[৩] ২, ৩ ও ৪ নম্বর কোম্পানীর বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এবং ব্যারাকে হামলা চালিয়ে হাতি, গোলাবারুদ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্ন রসদ নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে তবে বিভিন্ন স্থানে লড়াই করতে গিয়ে একসময় রসদের অভাবে বিদ্রোহীরা শক্তিহীন হয়ে পড়ে। শেষে ১৮৫৮ সালের ৯ জানুয়ারি সিলেটের মনিপুরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে এক লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে তিনি গহীন পার্বত্য জঙ্গলে আত্নগোপন করেন।[৪] পরে তার আর কোন সন্ধান আর পাওয়া যায়নি।[৫]
রজব আলী | |
---|---|
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত |
উপাধি | হাবিলদার |
আন্দোলন | ভারতের বিপ্লবী স্বাধীনতা আন্দোলন |
বৃত্তান্ত
সম্পাদনাহাবিলদার রজব আলীর পরিচয় কিছুটা অস্পস্ট। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা ধারণা করেছেন তিনি সন্দীপ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তরুন বয়সে সিপাই হিসেবে যোগ দেন এবং বিদ্রোহের পূর্বে তিনি ৪ নম্বর কোম্পানীর হাবিলদার পদে উত্তির্ন হন। ইংরেজ সেনাবাহিনীর ৩৪ নম্বর নেটিভ বেঙ্গল পদাতিক বাহিনীর ১২০ জন হাবিলদার ছিলেন। হাবিলদার রজব আলী তাদের একজন। ক্যাপ্টেন পিএইচকে ডিউলের অধীনে চট্টগ্রাম পাহাড়তলী সংলগ্ন প্যারেড গ্রাউন্ডের সেনানিবাসে তার বসবাস ছিলো।
চট্টগ্রামে সিপাহী বিপ্লব
সম্পাদনা১৮৫৭ সালের ১২ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৪শত সিপাহী ৩৪বেঙ্গল রেজিমেন্ট এদেশীয় সৈনিক বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। চট্টগ্রামের সিপাইদের মধ্যে ব্যারাকপুরের সিপাইদের একটা দলও ছিলো, ধারণা করা হয় তারাই সেখান থেকে তারা বিদ্রোহের অগ্নিমন্ত্র বহন করে নিয়ে এসেছিল। সিপাহীরা অস্ত্রাগার এবং ট্রেজারীতে হামলা করে অস্ত্র এবং রসদপাতি সংগ্রহ করে।[৬][৭] ঐ সময় বেশ কিছু অফিসার হতাহতের ঘটনা ঘটে।[৮] বৃটিশ সৈন্যরা আতংকে সমূদ্রে জাহাজে আশ্রয় নেয়।[৯] ঐদিন চট্টগ্রাম ৩০ ঘণ্টা বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল। বিদ্রোহীরা স্থির করেছিল যে, তারা ইংরাজের রাজত্ব ছেড়ে স্বাধীন ত্রিপুরার নিরাপদ অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেবে। বিদ্রোহী সিপাইদের পরিচালনার ভার এসে পড়ল হাবিলদার রজব আলী খাঁর উপরে। বেঙ্গর রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পি এইচ কে ডেওলের রিপোর্টে স্থানীয় সূত্রের বরাতে বলা হয় রজব আলী বিদ্রোহী বাহিনীকে নিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে ত্রিপুরা সীমানার দিকে যাত্রা করেছেন।[১০] তবে তার আগেই চট্টগ্রামের কমিশনার ত্রিপুরা রাজার কাছে সংবাদ পাঠালেন, বিদ্রোহী সিপাইদের প্রতিহত করার জন্য। ত্রিপুরার রাজা ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে বিদোহীদের ঠেকানোর জন্য প্রস্ততি নেয়।[১১] বিদ্রোহীরা সীতাকুন্ড হয়ে ২রা ডিসেম্বর তারিখে ‘স্বাধীন’ ত্রিপুরার প্রবেশদ্বারে গিয়ে পৌঁছল। গিয়ে দেখল, বহু সশস্ত্র সৈন্য সেখানে তাদের প্রতিহত করার জন্য অপেক্ষা করছে। বাধ্য হয়ে বিদ্রোহীরা কুমিল্লার পাহাড়ি এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।[১২] কিন্তু ত্রিপুরার সেনাবাহিনী তাদেরকে ধাওয়া করে।[১৩] অতপর বিদ্রোহীরা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মণিপুর রাজ্যের কাছাকাছি সিলেট পৌছে যায়। সীমান্তবর্তী এলাকায় সিলেট লাইট ইনফ্যান্ট্রির মেজর বাইং সেখানে বিদ্রোহীদের উপরে হামলা করে। তীব্র যুদ্ধে মেজর বাইং নিহত হন এবং তার অধীন ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হয়।[১৪] এরপরেও ইংরেজ ও স্থানীয় বাহিনীর সাথে সঙ্গে তাদের খন্ড খন্ড যুদ্ধ হয়। পর পর কয়েকটা যুদ্ধে তাদের পক্ষের অনেক লোক মারা যায়! যারা বেঁচে ছিলো আক্রমণের তীব্রতায় শেষ পর্যন্ত তাদের পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়।[১৫]
শেষ জীবন
সম্পাদনাহাবিলদার রজব আলী শেষ বারের মত যুদ্ধে অবতীর্ণ হন করিমগঞ্জের মালগ্রামে। বিদ্রোহী বাহিনী পার্বত্য এলাকা জেলা কাছাড়, হাইলাকান্দি ইত্যাদি পাড়ি দিয়ে মোহনপুর চা বাগানের নিকটবর্তী সাবাশপুরে অবস্থান নেয়। কিন্তু স্থানীয় জমিদারদের চরদের মাধ্যমে ইংরেজ বাহিনী সে খবর পেয়ে যায় এবং লেপটেন্যান্ট রসের নেতৃত্বে অতর্কিতে হামলা করে। হাবিরদার রজব আলী তার অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হন কিন্তু ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পরাজিত হন।[১৬] ৭০ জন বিদ্রোহী সিপাই মারা যায়। এরপরেও আহত হয়ে এবং ক্ষুধা যন্ত্রনায় মারা যায় আরো কিছু। হাবিলদার রজব আলী সহ তিন বা চারজন সিপাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ইংরেজ বাহিনীর অব্যাহত অনুসরনের মুখে তারা গহীন পাহাড়ী জঙ্গলে হারিয়ে যান।[১৭] ইংরেজ বাহিনীর ফাইনাল রিপোর্ট এ বলা হয় তাদেরকে আর খুজে পাওয়া যায়নি। লোকচক্ষুর অন্তরালেই একসময় হাবিলদার রজব আলীর জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ চট্টগ্রাম বিপ্লবের বহ্নিশিখা। চট্টগ্রাম পরিষদ। ১৯৭৪। অজানা প্যারামিটার
|1=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - ↑ "১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ: আমাদের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ও একজন"। দৈনিক সমকাল। ২৩ মার্চ ২০২০।
- ↑ "জেলার ইতিহাস - চট্টগ্রাম জেলা"। chittagong.gov.bd। ২৭ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুন ২০২০।
- ↑ সত্যেন সেন। মহাবিদ্রোহের কাহিনী। পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৯।
- ↑ "সিপাহী বিপ্লব ও হাবিলদার রজব আলীর চট্টগ্রাম"। দৈনিক সংগ্রাম। ১৮ নভেম্বর ২০১৭। ২২ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুন ২০২০।
- ↑ Rahman, Mahmudur (২০১৮-১০-২৯)। The Political History of Muslim Bengal: An Unfinished Battle of Faith (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge Scholars Publishing। পৃষ্ঠা ৪৬। আইএসবিএন 978-1-5275-2061-5।
- ↑ Further Papers (Number 9 in continuation of Number 7), Insurrection in the East Indies, Presented to both the Houses of Parliament, Enclosure in Number 5. BLOC; Special Narrative of Events Dated 5 December 1857, p. 326-27, WBSA.
- ↑ P, Jhimli Mukherjee; 2009; Ist, 05:55। "Rare 1857 reports on Bengal uprisings | Kolkata News - Times of India"। The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০২-০৪। Authors list-এ
|শেষাংশ2=
অনুপস্থিত (সাহায্য) - ↑ Judicial Proceedings Number 384, 17 September 1857, Government of Bengal, WBSA.
- ↑ Orlich, Leopold von (১৮৫৮)। The Military Mutiny in India: Its Origin and Its Results (ইংরেজি ভাষায়)। T. and W. Boone, 29, New Bond Street।
- ↑ admin (২০১৮-০১-০৯)। "১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, উপনিবেশবাদ এবং হাবিলদার রজব আলি"। Muktobuli | মুক্তবুলি। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০২-০৪।
- ↑ রায়, প্রকাশ (২০২১)। বিস্মৃত বিপ্লবী তৃতীয় খণ্ড। চেন্নাই: নোশনপ্রেস চেন্নাই তামিলনাড়ু। পৃষ্ঠা ৭০–৭৩।
- ↑ স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, পূর্নেন্দু দস্তিদার, বইঘর প্রকাশিনী, অক্টোবর ১৯৬৭
- ↑ Rethinking 1857, Sabyasachi Bhattacharya, Indian Council of Historical Research Orient Longman, 2007 - India
- ↑ (সত্যেন সেনঃ মহাবিদ্রোহের কাহিনী, পৃ ১৫৫-১৫৯)
- ↑ Indigenous People of Barak Valley, Ali haidar lascar and Atiqur Rahman Barbhuiya , January 27, 2020
- ↑ SEPOY MUTINY AND THE REVOLT OF 1857, RC Majumder, Calcutta, 1957, page-88