মোহাম্মদ ফরহাদ

বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ

মোহাম্মদ ফরহাদ (৫ জুলাই ১৯৩৮ - ৯ অক্টোবর ১৯৮৭) একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্য ছিলেন। তিনি কমরেড ফরহাদ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন।[২]

মোহাম্মদ ফরহাদ
জন্ম৫ জুলাই, ১৯৩৮[১]
বোদা, পঞ্চগড়, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যু৯ অক্টোবর, ১৯৮৭
জাতীয়তাবাংলাদেশি
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণরাজনীতিবিদ
রাজনৈতিক দলবাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
দাম্পত্য সঙ্গীরাশেদা খানম রীনা

জন্ম সম্পাদনা

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের জন্ম পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার জমাদারপাড়া গ্রামে। তাঁর ডাকনাম ছিল বাদল । রাজনৈতিক ছদ্মনাম ছিল কমরেড কবির। তাঁর পিতা আহমেদ সাফাকাত আল বারি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। পড়াশোনা করেছেন দিনাজপুর শহরে। ইংরেজি, আরবি, ফার্সিউর্দু প্রভৃতি ভাষায় তার দখল ছিল। তার পূর্বপুরুষ শাহ্ বংশীয় পীরে কামেল কদম আলী শাহ্ জলপাইগুড়ি থেকে আগমন করেন । কমরেড ফরহাদরা মোট ৬ ভাই- বোন। তিনি পিতা মাতার মধ্যম পুত্র ও পঞ্চম সন্তান।[৩]

শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

চল্লিশের দশকের শুরুতে দিনাজপুর জিলা স্কুল সংলগ্ন একটি প্রাইমারী স্কুলে মোহাম্মদ ফরহাদ এর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি ও প্রশংসিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দিনাজপুরের তদানিন্তন একমাত্র কলেজ দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে আই.এ পাস করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে বি.এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি এম.এ পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান লাভ করেন। ১৯৬২ সালে আইন অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ুব খান ফরহাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে।

ছাত্র আন্দোলন সম্পাদনা

মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৫২ সালে মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে দিনাজপুর জেলা স্কুলের ছাত্র হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পরপরই এদেশের ছাত্র সমাজের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন' ঢাকায় গঠিত হলে দিনাজপুর জেলায় ঐ সংগঠনের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৫৩-৫৪ সালে বোদা-পঞ্চগড় প্রভৃতি এলাকায় তিনি প্রথম ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য (কোষাধ্যক্ষ) নির্বাচিত হন। কমরেড ফরহাদ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পার্টির নির্দেশে কোষাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। কেননা পার্টি মনে করেছিল একেবারে উপরের পদে গেলে পার্টির গোপন কাজ করতে অসুবিধা হবে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে যে জঙ্গি ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন সেই আন্দোলনের মূল নেতা। তাকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের 'মস্তিষ্ক' বলে অভিহিত করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একজন প্রধান বিপ্লবী ছাত্রনেতা হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র সমাজের সমাদর লাভ করেন। এই সময় হতেই তদান্তিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (তখন অসংগঠিত ও অবলুপ্ত অবস্থায় ছিল) কর্মী ও নেতৃবৃন্দ তার সংস্পর্শে আসেন। তার সাথে পরামর্শ করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন কমরেড ফরহাদের সামান্য জুনিয়র। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুবের বিরুদ্ধে ঢাকার রাজপথে প্রথম মিছিল বের করতে গিয়ে তাকে পুলিশের সাথে হাতাহাতি করতে হয়েছিল। '৬০ হতে '৮০ দশক পর্যন্ত মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু। '৬৯ এর ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের তিনি ছিলেন নেপথ্য কারিগর এবং প্রকৃত পরামর্শদাতা।[৩]

রাজনৈতিক জীবন সম্পাদনা

চল্লিশ দশকের বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ভারতের স্বাধীনতা, চীনের বিপ্লব এবং ১৯৪৮ সালের দিকে দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলন তার রাজনৈতিক মতাদর্শ তৈরীতে প্রভাব রাখে। এই সময়ে মোহাম্মদ ফরহাদ রাজনীতিতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং ঐ সময় হতেই সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষিত হয়ে দিনাজপুর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৫ সালে কমরেড মণি সিংহের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। ঐ বছরই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। দিনাজপুর জেলা পার্টি ১৭ বছর বয়সে বিশেষ বিবেচনায় তাকে পার্টির সদস্য পদ দেয়। ১৯৫৮ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মূল ভূমিকা পালন করেন তিনি। কিশোর বয়সে ১৯৫১ সালে মোহাম্মদ ফরহাদ দিনাজপুরের কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতৃবর্গের সংস্পর্শে আসেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মির্জা নুরুল হুদা কাদের বক্স ( ছোটি), অনিল রায়, দীপেন রায়, আসলেউদ্দিন, গুরুদাস তালুকদার, কম্পরাম সিং, ইন্দ্রমোহন, মির্জা আব্দুস সামাদ প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন তিনি। ৩০ জানুয়ারি মোহাম্মদ ফরহাদ ঢাকা স্টেডিয়ামে এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর অস্ত্র বঙ্গবন্ধুর নিকট সমর্পণ করেন। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৩৫ বছর বয়সে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।[৪] ১৯৭৫ সালে জুন মাসে তদান্তিন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পার্টি বাকশাল গঠন করলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন এবং তাকে ঐ সংগঠনের দলীয় রাজনৈতিক প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার রাজনৈতিক ছদ্ম নাম ছিল 'কবির'। তাকে বলা হত 'বাংলার লেনিন'। তার শাণিত ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিল। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার নিপুণ কারিগর। 'ঐক্য ও সংগ্রাম' ছিল তার একটি বড় কৌশল। তার ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা ও সময়োপযোগী নির্ভুল ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। রাজনৈতিক কর্ম-কৌশল নির্ধারণে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পেরে ছিলেন। সিপিবি অফিসে মোহাম্মদ ফরহাদের রুমটি ছিল স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক শক্তির তীর্থ স্থানের মত। '৭০ এর নির্বাচনের পর তিনি এই বাণী দিয়েছিলেন যে, 'স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময় আসন্ন। '৮৬ নির্বাচনের আগে স্বৈরাচারকে পরাস্ত করার কৌশল হিসেবে তিনি দিয়েছিলেন দুই নেত্রীর ১৫০-১৫০ আসনে নির্বাচন করার ফর্মূলা। ভীত হয়ে এরশাদ অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন যে কোন প্রার্থী ৫টির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারবেন না। অনেকে তাকে 'এরশাদের যম' বলে অভিহিত করেছিল। ফরহাদ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন '২০০০ সালের মধ্যে বিপ্লব সংগঠিত করার'। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পঞ্চগড়-২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।[৩]

হুলিয়া এবং নির্যাতন সম্পাদনা

১৯৫৪ সালের ১০ জুন দিনাজপুর শহরে রাজনৈতিক কারণে তিনি প্রথমবারের মত গ্রেফতার হন এবং বিনা বিচারে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে আটক রাখা হয়। এই সময় তার বয়স ১৫/১৬ বছর ছিল। ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি মুক্তি লাভ করেন। ঐ বছরই ২৫ জানুয়ারি তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হলে পুলিশের হাত হতে পালিয়ে তিনি আত্মগোপন অবস্থায় থাকেন এবং দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেচে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার উপর হতে হুলিয়া ওঠে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান পুনরায় তার উপর হুলিয়া বাহির করেন। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে অনেক টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে সরকার ঘোষণা করে। ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে তার উপর হতে মাত্র তিন মাসের জন্য হুলিয়া প্রত্যাহার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬২ সাল হতে স্বাধীনতা পর্যন্ত জনাব ফরহাদের হুলিয়া থাকে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং বিনা বিচারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখে। তার আটকাদেশের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ রায় দেন যে, 'মোহাম্মদ ফরহাদকে বিনা বিচারে আটক রাখা অন্যায় এবং সরকার বেআইনিভাবে তাকে আটক রেখেছে। সরকারপক্ষ মামলায় হেরে যায়। ১৯৮০ সালে তাকে আবার রাজদ্রোহের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। 'বিপ্লব' ও 'সরকারকে শক্তি বলে উৎখাতের' মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। ১৯৮১ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক সরকার আবার তাকে গ্রেফতার করে এবং ক্যান্টনমেন্ট জেলে অন্ধকার কক্ষে ১৪ দিন আটক রাখে।[৩]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

মোহাম্মদ ফরহাদ ব্যক্তিগত জীবনে তৎকালীন ছাত্রী আন্দোলনের নেত্রী রাশেদা খানম রীনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান '।

মৃত্যু সম্পাদনা

মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৮৭ সালের ৯ই অক্টোবর রাশিয়ার মস্কো শহরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।[৫]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. আকাশ, এম এম। "একজন বিপ্লবীর উত্থান ও অকালমৃত্যু"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-০৯ 
  2. প্রতিবেদক, নিজস্ব। "চিরঞ্জীব কমরেড ফরহাদ"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-২৪ 
  3. সাপ্তাহিক একতা; বর্ষ - ৪৩, সংখ্যা ১০; ১৩ অক্টোবর ২০১৩
  4. "বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন"। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৩ 
  5. "কমরেড ফরহাদের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী"Banglanews24.com। Archived from the original on ২৫ অক্টোবর ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ০৮ অক্টোবর ২০১২  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)