মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ

মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ (১৭৬৯–১৮০৫) ছিল মায়ামরা সত্রের ভক্ত মরাণ এবং আহোম রাজাদের মধ্যে ১৮শ শতকে হওয়া সংঘাত। এর ফলে আহোম রাজা এবং রাজবাড়ির বিরুদ্ধে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল এবং দুবার আহোম রাজা রাজধানীর অধিকার হারিয়েছিলেন। পরে রাজধানী পুনরায় অধিকার করায় বহু প্রজার মৃত্যু ঘটেছিল। আহোম রাজা সমগ্র রাজ্য ফিরে পাননি। উত্তর-পূর্বের বেংমরা নামের অঞ্চল প্রায় স্বাধীন হয়ে যায়।

মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ
তারিখ২৫ নভেম্বর ১৭৬৯ (1769-11-25) – ১৮০৫
অবস্থান
ফলাফল

আহোম রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে

  • পাইক ব্যবস্থার সমাপ্তি
  • আহোম পাইকভিত্তিক সামরিক বাহিনীকে প্রতিস্থাপনের জন্য বেশিরভাগ হিন্দুস্তানি বেতনভুক্ত সিপাহী দ্বারা স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরি করা
  • রাজ্যের জনসংখ্যার অর্ধেকের মৃত্যু
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
স্বাধীন মোটাক এলাকা তৈরির উপক্রম হয়
বিবাদমান পক্ষ
মোয়ামরীয়া আহোম রাজ্য
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
  • রাঘ নিওগ
  • নাহারখোড়া শৈইকিয়া
  • গোবিন্দ গাওবুরহা
  • হরিহর তান্তি

বিদ্রোহের পরে আহোম রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজ্যের প্রায় আধা প্রজা সর্বস্বান্ত হয় এবং অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।[১] দুর্বল আহোম রাজ্য বর্মীরা আক্রমণ করে এবং পরে ব্রিটিশরাও আসামে উপনিবেশ স্থাপন করে।

বিদ্রোহর কারণসম্পাদনা

আহোম রাজ্যে প্রচলিত পাইক প্রথা পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির সাথে খাপ না খাওয়া হয়ে এসেছিল। কয়েকটি সত্রের উত্থান হওয়াতে পাইকদের জন্য মানুষ কমে এসেছিল এবং আহোম রাজবাড়ির জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। মরাণ জনগোষ্ঠীর লোকদের অনুসরণ করা কাল-সংহতির মায়ামরা বা মোয়ামরীয়া সত্র অন্য রাজসত্রসমূহের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। আহোম রাজা এই কথা ভাল মনে না করে মোয়ামরীয়াদের উপরে অত্যাচার আরম্ভ করেন। মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ স্বর্গদেও লক্ষ্মী সিংহর সময়ে আরম্ভ হয় এবং স্বর্গদেও কমলেশ্বর সিংহর সময়ে শেষ হয়। ১৭৬৯ সাল থেকে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত ৩৬ বছর জুড়ে এই বিদ্রোহ চলেছিল। পরে মোয়ামরীয়া নেতারা আহোম রাজার সাথে মিট-মাট করেন।[২]

সত্র-আহোমের সংঘাতসম্পাদনা

শ্রীমন্ত শংকরদেব ১৬শ শতকে মহাপুরুষীয়া ধর্ম স্থাপন করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে যুক্ত করেন। সাধারণ লোকের জন্য এই ধর্ম‌ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ দেয়; অন্যদিকে পাইক প্রথার থেকে সরে আসতে সত্রগুলি নিরাপদ স্থানস্বরূপ হয়ে ওঠে।

আহোম রাজা এর প্রতিকার চান। শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে স্বর্গদেও চুক্লেংমুঙের সময়ে শংকরদেব নিজেই কোচরাজ্যে পালিয়ে যান। পরের রাজা প্রতাপ সিংহ কলাবাড়ি এবং কুরুয়াবাহী সত্র ধ্বংস করেন। জয়ধ্বজ সিংহ‌ এই নীতির পরিবর্তন করেন এবং চুলিক্‌ফা ডেকা রাজা পর্যন্ত তাঁর উত্তরসূরীরা সত্রের সাথে বোঝাবুঝিতে উপনীত হতে চেষ্টা করেন। গদাধর সিংহ পুনরায় সত্রের দমন আরম্ভ করেন। তাঁর পুত্র রুদ্র সিংহ ব্রাহ্মণ সত্রসমূহকে প্রাধান্য দিয়ে অ-ব্রাহ্মণ তথা আহোম রাজ্যের জন্য ভীতিস্বরূপ সত্রগুলিকে একফলীয়া করতে চান। এই নীতি কাজ না দেয়ায় তিনি সত্রের প্রভাব কমিয়ে আনতে শাক্ত ধর্মের প্রচারে সহায়তা করতে থাকেন। এর ফলে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। শিবসিংহের রাজত্বে বর রাজা ফুলেশ্বরী কুঁওরী সত্রসমূহের উপরে অমানুষিক অত্যাচার চালান। শেষে এই সংঘাতের ফলে ১৮শ শতকে মোয়ামরীয়া বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়।

প্রথম বিদ্রোহসম্পাদনা

১৭৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মায়ামরা সত্রের একজন প্রধান শিষ্য রাঘ নেওগকে প্রচুর সংখ্যক হাতি যোগান না দেয়ার জন্য আহোম প্রধান শাস্তি প্রদান করেন। রাঘ নেওগ তিনজন আহোম রাজকুমারকে (লক্ষ্মী সিংহের একজন ভাই মোহনমালা এবং দুজন ভাগ্নে) সিংহাসনের প্রলোভন দেখান। তাঁদের সহায়তায় নভেম্বরে রাঘ নেওগ, নাহরখরা শ‌ইকীয়া এবং তাঁর দুই পত্নী রাধা ও রুক্মিণীর নেতৃত্বে মরাণরা বুঢ়ীদিহিঙের উত্তরপারের অঞ্চল নিজেদের হাতে আনে। ২১ নভেম্বরে বিদ্রোহীরা আহোম রাজধানী অধিকার করে নাহরখরার রমানন্দকে সিংহাসনত বসায়। আহোম রাজা লক্ষ্মী সিংহকে বন্দী করা হয়। সকল উচ্চ প্রধানকে বধ করে তিনজন সাধারণ মরাণ লোককে প্রধান গোহাঁইর পদ তিনটি দেওয়া হয়। রাঘ নেওগ নিজে বরবরুয়া পদ নেন।

রাজ্য চালানোতে অনভিজ্ঞ বিদ্রোহীরা পূর্বের নেতার পথই অনুসরণ করতে থাকে। রাঘ নেওগ বহু উচ্চ পরিবারের মহিলাকে জোর করে নিজের হারেমে রেখেছিলেন। এমন কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট অসম বিদ্রোহী গোউইন্দ গাঁওবুঢ়ার নেতৃত্বে এবং মণিপুরের আহোম রমণী কুরঙ্গনয়নীর সহায়তায় ১৭৭০ সালের ১১ এপ্রিল রাঘকে হত্যা করে রাজধানী উদ্ধার করেন। এরপর রমানন্দ, নাহরখরা, রাধা, রুক্মিণী, মায়ামরা সত্রাধিকার অষ্টভুজদেব এবং তাঁর পুত্র সপ্তভুজ ইত্যাদি সকলকে হত্যা করা হয়।

রাজধানী পুনরুদ্ধারের পর সাগুনমুরিতে থাকা বাকি বিদ্রোহীরা গোউইন্দ গাঁওবুঢ়ার নেতৃত্বে পুনরায় রাজাকে বদলাতে চেষ্টা চালায়। উপজাগরণের চিহ্ন থাকা এই বিদ্রোহে ব্যবহার হওয়া প্রধান অস্ত্র ছিল বাঁশের লাঠী। তাঁদের শ্লোগান ছিল "প্রজা-ঐ জরৈরোবা, চেকনী-ঐ চাপৈ ধরা"। এই বিদ্রোহকে সেইজন্য "চেকনী কোবোবা যুদ্ধ" বলা হয়। একটি যুদ্ধে বরপাত্রগোহাঁই এবং ঢেকিয়াল ফুকনের মৃত্যু হয় এবং বরগোহাঁই কোনোমতে বাঁচেন। বিদ্রোহীরা রংপুরের দিকে অগ্রসর হওয়াতে থাওরাত বুঢ়াগোহাঁই, নতুন বরপাত্রগোহাঁই, বরগোহাঁই এবং মণিপুরী রাজার কিছু সৈন্য‌ তাঁদের বাধা দেয়। বিদ্রোহীরা পরাস্ত হয় এবং গোউইন্দ গাঁওবুঢ়াকে ধরে মৃত্যুদণ্ড গেওয়া হয়।[৩]

কিছুসংখ্যক বিদ্রোহী লেফেরা, পরমানন্দ ইত্যাদির নেতৃত্বে অরণ্যে লুকিয়ে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যায়। ন-ফুকন এবং ডেকা-ফুকনের বাহিনী তাঁদের হাতে পরাস্ত হলেও পরে বরপাত্রগোহাঁইর সৈন্যরা তাঁদের নিশ্চিহ্ন করে। বুঢ়াগোহাঁই গাঁওগুলি ধ্বংস করতে আরম্ভ করেন এবং বাকি থাকা নেতা-বিদ্রোহীকে হত্যা করেন। অবশিষ্ট লোকরা পালিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকতে শুরু করে। শেষে নোমল নামের অন্তিম নেতাকে ধরে শূলে দেওয়া হয়।[৪] এখানে প্রথম মোয়ামরীয়া বিদ্রোহের অন্ত হয়।

দ্বিতীয় বিদ্রোহ (১৭৮২)সম্পাদনা

প্রথম মোয়ামরীয়া বিদ্রোহের এক দশক পরে রংপুর, গড়গাঁও এবং দাতিকাছেরীয়া অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কীর্তন বা অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর অছিলা নিয়ে মিলিত হতে আরম্ভ করে। আসামের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গোপন দল গঠিত হয় এবং তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা চলে। ১৭৮২ সালের এপ্রিলে বহাগ বিহুর সময় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একদল বিদ্রোহী স্বর্গদেও এবং সঙ্গীবৃন্দকে আক্রমণ করে। রাজা কোনোমতে পালিয়ে আসেন। বিদ্রোহীরা রংপুর এবং গড়গাঁওয়ে প্রবেশ করে বহু প্রধানকে বন্দী করেন। অবশ্য আহোম বাহিনীর পরের প্রত্যাক্রমণগুলিতে বিদ্রোহীরা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। এরপর প্রায় দেড় মাস মরাণদের হত্যালীলা চালানো হয়। হাজার-হাজার সাধারণ পাইকের মৃত্যু হয় এবং কিছু কাছের রাজ্যে পালিয়ে যায়। ফলে আহোম রাজ্যের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে।[৫]

তৃতীয় বিদ্রোহসম্পাদনা

প্রথম দুবার বিদ্রোহর পরে আহোম প্রশাসন ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এইবার মরাণদের সাথে বড়ো-কাছাড়িরাও যোগদান করেন। ১৭৮৬ সালে হরিহর তাঁতি মোয়ামরীয়া এবং দফলা-বহতীয়া লোকের একদল সৈন্য তৈরি করেন। তাঁরা মাজুলীর আউনীআটী সত্রে থাকা মৃত মায়ামরা সত্রাধিকারের নাতি পীতাম্বরকে উদ্ধার করেন। সাথে আউনীআটী সত্র, গড়মূর সত্র এবং দক্ষিণপাট সত্রে যুদ্ধ লাগিয়ে দেন। তাঁরা রংপুর আগুড়ি ধরাতে ১৭৮৮ সালের ১৯ জানুয়ারিতে রাজা গৌরীনাথ সিংহ এবং প্রধান পলায়ন করেন। উদ্ধার করা অঞ্চলের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পারে হরিহর তাঁতী, মাজুলী হৌহ‌ই এবং বেংমরা (বর্তবর্মার তিনিসুকীয়া) সর্বানন্দ‌ শাসন করতে থাকেন। ভরতকে রাজা ঘোষণা করা হয়। ভরত এবং সর্বানন্দের নামে নিয়মিতভাবে মোহর তৈরি হত। পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোহাঁই তাঁদের নির্মূল করার চেষ্টা কিছুকাল পরে বাদ দিয়ে যোরহাটে স্থায়ী হন। অন্য আহোম প্রধান দরঙে স্থায়ী হন। গৌরীনাথ সিংহ‌ প্রথমে নগাঁওয়ে বাসর করে ১৭৯২ সালের ১১ জুনে গুয়াহাটীতে যান।

অবশেষে আহোম প্রধান এবং আসামে ব্যবসা করা ইংরাজরা কলকাতার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বিদ্রোহ দমনের জন্য অনুরোধ করেন। ১৭৯২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ গভর্নর কর্নওয়ালিসের নির্দেশে থমাস ওয়েল্‌স ৫৫০ জনের একটি সুসজ্জিত দল নিয়ে আসামে আসেন। তাঁরা ১৭৯২ সালের ২৪ নভেম্বর গুয়াহাটী অধিকার করেন এবং ১৭৯৪ সালের ১৮ মার্চে রংপুর অধিকার করেন। গোরীনাথ সিংহের থেকে বিপুল পরিমাণের ধন লাভ করে ২৫ মে'তে ব্রিটিশ সৈন্য কলকাতায় ফিরে যায়। ১৭৯৪ সালে যোরহাটে গৌরীনাথ সিংহের মৃত্যু হয় এবং তাঁর স্থানে কমলেশ্বর সিংহ রাজা হন।

বিদ্রোহের সমাপ্তিসম্পাদনা

ইংরাজ সৈন্যের পরাক্রম দেখে আহোম প্রশাসন "পাইক" সৈন্যের স্থানে দর্মহা দিয়ে বেশিরভাগ হিন্দুস্তানী সৈন্যের বাহিনী গঠন করে। ১৭৯৬ সালে বিদ্রোহী ফোপাইকে এবং ১৭৯৯ সালে ভরতকে ধরে হত্যা করা হয়। ১৮০২ এবং ১৮০৬ সালে বহু চেষ্টার শেষে বেংমরা অঞ্চল সর্বানন্দ‌ সুরক্ষিত করে রাখেন। তাঁকে বরসেনাপতি উপাধি দিয়ে মটক অঞ্চল ছেড়ে দেওয়া হয়।

পাদটিকাসম্পাদনা

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  • Baruah, S. L. (১৯৯৩), Last Days of Ahom Monarchy, New Delhi 
  • Gait, Edward A. (১৯০৬), A History of Assam, Calcutta 
  • Guha, Amalendu (১৯৯১), Medieval and Early Colonial Assam, Calcutta: K P Bagchi 
  • Sharma, Chandan Kumar (১৯৯৬), Socio-Economic Structure and Peasant Revolt : The Case of Moamoria Upsurge in the Eighteenth Century Assam, Delhi  অজানা প্যারামিটার |1= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)