বর্মার আসাম আক্রমণ

বর্মার আসাম আক্রমণ বলতে ১৮১৭ সাল থেকে ১৮২৬ সালের মধ্যে ব্রহ্মদেশের (এখনকার মিয়ানমার) সৈন্যের আসামে তিনবার করা আক্রমণকে বোঝায়। এর ফলে ১৮২১ সাল থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত আহোম রাজ্য বর্মাদেশের অধীনে ছিল। অসমীয়া লোকেরা এই সময়কালকে মানের দিন এবং মণিপুরীরা Chahi-Taret Khuntakpa (ধ্বংসের সাত বছর) বলে অভিহিত করে। এই আক্রমণ আসামে আহোম রাজ্যের ৬০০ বছরের শাসনের ভিত্তি ভেঙে দেয়। গণহত্যা এবং ভয়ে প্রবজনের ফলে রাজ্যের গঠন ধ্বংস হয়ে পড়ে। আগে আসামে উপনিবেশ করতে মনস্থ না করা ব্রিটিশদের সাথে মিয়ানমারের যুদ্ধ হয়। প্রথম ইঙ্গো-বর্মী যুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা আসামের সাথে ব্রহ্মদেশও জুড়ে নেয়।

পার্শ্ব ঘটনাবলী সম্পাদনা

১৮শ শতকের শেষদিকে আসামের আহোম রাজ্য উপর্যুপরি বিদ্রোহ দুর্বল করেছিল। উজনি আসামে মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ এবং নামনিতে দন্দিয়া বিদ্রোহের ফলে প্রচুর জন-ধনের হানি হয়েছিল। মন্ত্রী পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোহাঁই আহোমের শাসন বজায় রাখতে অশেষ চেষ্টা করে শেষে বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হন। প্রশাসন ভালভাবে চালাতে বা নিজের প্রভাব বাড়াতে তিনি নিজের আত্মীয়-স্বজনকে আহোম রাজ্যের উচ্চ পদবীতে নিয়োগ করতে ধরেন। রাজার করে যাওয়া গুয়াহাটীর শাসক বদন চন্দ্র বরফুকন পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোহাঁইর বর্ধিত শক্তিতে সংশয়িত হন। প্রথমে তিনি পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোহাঁইর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চেষ্টা করেন। সেই সূত্রে তিনি কন্যা পিজৌ গাভরুকে পূর্ণানন্দের পুত্র উরেখানাথ ঢেকিয়াল ফুকন ঢের যৌতুকের সাথে বিয়ে দেন। কিন্তু এরপর বদন চন্দ্র‌ ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন বলে পূর্ণানন্দ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পূর্ণানন্দের এমন ব্যবহারে খং করে বদন চন্দ্র‌ রাজধানী যোরহাটের কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারীকে উপঢৌকন দিয়ে পূর্ণানন্দকে গোপনে হত্যা করতে পাঠান। পরে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং লোকদের শাস্তি হয়। ষড়যন্ত্রে বরফুকনের হাত আছে বলেও ফাঁস হয়। সেই সময়ে পশ্চিম আসামের মানুষ বদন চন্দ্র বরফুকন এবং তাঁর দুই পুত্র ও পিয়লির অত্যাচারের কথা বুঢ়াগোহাঁইকে জানায়। শেহত ১৮১৫ সালে পূর্ণানন্দ বদন চন্দ্র বরফুকনকে যোরহাটে ধরে আনতে মহেশ্বর পর্বতীয়া ফুকনকে গুয়াহাটীতে পাঠান। পূর্ণানন্দের বোয়ারি পিজৌ গাভরু বাবা বদন চন্দ্রকে আগেভাগে বিপদের সম্পর্কে জানায়। খবর পেয়ে বদন চন্দ্র বরফুকন দুই পুত্রের সাথে ব্রিটিশ শাসিত বঙ্গে পালিয়ে যান।[১] বুঢ়াগোহাঁইর সৈন্য তাঁকে বঙ্গের শিলমারিতে আটক করে, কিন্তু স্থানীয় আরক্ষীর সহায়তায় সেখান থেকে তিনি আবার পালান। তিনি কলকতায় গিয়ে গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংসকে বুঢ়াগোহাঁইকে উৎখাত করতে সহায়তা ভিক্ষা করেন। অন্য রাজ্যের মধ্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি (Non-intervention Policy) দেখিয়ে গভর্নর জেনারেল তাঁর অনুরোধ খারিজ করেন। সেই সময়ে কলকাতায় ব্রহ্মদেশের একজন কটকী এসেছিলেন; বদনচন্দ্র সেই কটকীজনের কাছে গিয়ে তাঁর কাছে অতিরঞ্জিত করে আসাম দেশের দুরবস্থার কথা জানান। কটকী বদনচন্দ্রকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতি দেন, এবং সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করে দেওয়ার নিমিত্তে তাঁকে সাথে ব্রহ্মদেশে নিয়ে যান[২][৩]

বর্মার প্রথম আক্রমণ সম্পাদনা

১৮১৬ সালে বদন চন্দ্র বরফুকন ব্রহ্মদেশের রাজা বদৌপায়ার রাজসভায় যান এবং পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোহাঁইকে পরাস্ত করতে সহায়তা চান। রাজা রাজি হন এবং ভামোর একজন সেনাপতির অধীনে একদল সৈন্য বদন বরফুকনের সাথে ১৮১৭ সালের জানুয়ারিতে আসামে প্রবেশ করে। ১৮১৭ সালের ২৭ মার্চ ঘিলাধারীতে আহোম এবং মিয়ানমারের প্রথম যুদ্ধ হয়। আসামের সৈন্যকে দমন গগিয়ে, হাও বরা এবং জামা খান নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একসপ্তাহ যুদ্ধ চলার পরে পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোহাঁইর প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু হয়।[৪] তখন আহোম প্রধানদের মধ্যে মনান্তর আরম্ভ হয় এবং নতুন করে রসদ না পাওয়া আহোম সৈন্য‌ আত্মসমর্পণ করে। পূর্ণানন্দর পুত্র রুচিনাথ বুঢ়াগোহাঁই পদে উঠে স্বর্গদেউকে পালিয়ে যাতে বলে কিন্তু রাজা তা মেনে নেন না। তেখনো স্বর্গদেউ চন্দ্রকান্ত সিংহ বদন বরফুকনের সাথে গোপন বোঝাবুঝি করেছেন বলে রুচিনাথ সন্দেহ করেন[৫] এবং রাজাকে ছেড়ে গুয়াহাটীতে যান। বর্মী সেনা আহোম রাজধানী যোরহাটে প্রবেশ করে। স্বর্গদেউ চন্দ্রকান্ত সিংহ বদন চন্দ্র বরফুকনকে এনে মন্ত্রী ফুকন করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Gohain Barooah 1937: 101
  2. E. A. Gait 1926: 224-225
  3. S.K. Bhuyan 1968 Tungkhungia Buranji or A History of Assam(1681-1826) : 197-199
  4. (Baruah 1993, পৃ. 216–218)
  5. "The new Burha Gohain endeavoured in vain to induce the king to retreat to Lower Assam, and then, perceiving that the latter intended to sacrifice him, in order to conciliate the Bar Phukan and his Burmese allies, fled westwards to Gauhati." (Gait 1906, পৃ. 222)