ঔপনিবেশিক আসাম
১৮২৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইয়াণ্ডাবু সন্ধির ফলে আসাম ইংরেজদের হাতে চলে যায়৷ আসাম অধিকার করার পর আসাম উপত্যকা সর্বপ্রথমে বঙ্গের কমিশনার ডেভিড স্কটের কাছে আসে। তার হাত থেকে আসাম উদ্ধার করে দেশে শান্তি স্থাপন করার সময় পর্যন্ত ডেভিড স্কটের হাতেই আসামের শাসনভার ছিল। ১৮২৭ এবং ১৮২৮ সালে আসাম উপত্যকাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়; উজানি আসাম এবং নিম্ন আসাম। দুটি ভাগে দুজন করে আসিস্টেন্ট কমিশনার রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ডেভিড স্কটের আসামে বন্দী-বেটা রাখার নিয়ম বন্ধ করা হয় এবং জমির বন্দোবস্ত করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়; রূপিত, বস্তি এবং ফরিঙ্গতি[১]।
প্রথম অবস্থায় অসমীয়া মানুষেরা ইংরেজদের আপন করে নিয়েছিল যদিও পরে স্বাধীনচেতা অসমীয়া মানুষের ইংরেজদের শাসনের প্রতি মোহভঙ্গ হয় এবং ইংরেজ-বিরোধী মনোভাবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ১৮২৮ সালে আহোম আমলা ধনঞ্জয় বরগোহাঁই এবং গমধর কোঁবরের নেতৃত্বে আহোম রাজতন্ত্রের পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্রোহ হয়৷ কিন্তু এই বিদ্রোহ সফল হয়নি৷ এরপরে কয়েকজন আহোম ব্যক্তি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে৷ ফলে ইংরেজরা ১৮৩৩ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখে একটি চুক্তিযোগে পুরন্দর সিংহকে শদিয়া এবং মটক রাজ্যর বাইরে ধনশিরি নদীর পূর্বে থাকা সমস্ত উজনি খন্ডের রাজা হন। চুক্তিমতে পুরন্দর সিংহ ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। কিন্তু ১৮৩৮ সালে ইংরেজরা পুরন্দর সিংহকে রাজ্যচ্যুত করে সমগ্র আসামকেই তাদের স্থায়ী দখলে আনে।
এর পরে ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতে জ্বলে ওঠা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের দাবানল আসামকে স্পর্শ করে৷ আসামে ইংরেজদের কার্যকলাপে বিতুষ্ট হয়ে একাংশ প্রজার নেতৃত্বে আসামে সিপাহী বিদ্রোহ আরম্ভ হয়৷ সেই সশস্ত্র বিপ্লবে মণিরাম দেওয়ান, পিয়ালি বরুয়া ইত্যাদির ফাঁসি হয়৷ সিপাহী বিদ্রোহের পরে আসামের শাসনভার একজন কমিশনারের হাতে যায়৷ সিপাহী বিদ্রোহ অসমীয়া মানুষের মনে পুনরায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি অনুপ্রাণিত করে৷ শেষে ১৯১৯-২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে আসামে যোগদান করে। এরপরে ক্রমে ক্রমে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন-এ আসাম যোগদান করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ভারত স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে আসামের থেকেও ইংরেজদের শাসনের অন্ত হয়।
কমিশনারের অধীনে আসামসম্পাদনা
ডেভিড স্কটের পর কয়েকজন কমিশনার আসাম শাসন করেন।[১]।
মিস্টার রবার্টসনসম্পাদনা
ডেভিড স্কটের মৃত্যুর পর ১৮৩১ সালে মিস্টার রবার্টসন আসামের কমিশনার হয়ে আসেন। মিস্টার রবার্টসন নিম্ন আসামকে ইংরেজদের সম্পূর্ণ দখলে রেখে উজনি খন্ড বছরে ৫০০০০ টাকার কর বাবদ পুরন্দর সিংহকে দেন।
জেনারেল জেন্কিন্সসম্পাদনা
জেনারেল জেন্কিন্স ১৮৩৪ সালে আসামের কমিশনার হয়ে আসেন। এর সময়েই কাছাড় এবং জয়ন্তীয়া ইংরেজদের দখলে আসে। ১৮৩৮এ উজনি আসামও পুরন্দর সিংহের হাত থেকে ইংরেজদের সম্পূর্ণ দখলে আনা হয়।
কর্নেল হপকিন্সনসম্পাদনা
কর্নেল হপকিন্সন ১৮৬১ সালে আসামের কমিশনার হন।। ১৮৬৬ সালে তার সময়েই আসামে বৈদ্যুতিক ডাকের প্রচলন আরম্ভ হয়। তার সময়েই ১৮৭১ সালে আসামে বাংলা ভাষা উঠিয়ে দিয়ে পুনরায় অসমীয়া ভাষা প্রয়োগের নিয়ম আরম্ভ হয়।
চীফ কমিশনারের অধীনে আসামসম্পাদনা
কর্নেল হপকিন্সন ১৮৬৪ সালে আসাম থেকে বিদায় নেন। সেই সময় আসামকে বঙ্গদেশ থেকে আলাদা করা হয় এবং চীফ কমিশনার কর্নেল কিটিংর অধীনে রাখা হয়। এই চীফ কমিশনারের সময়েই কাছাড় এবং সিলেট জেলা বঙ্গদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়[১]।
মি: জে ডব্লিউ কুইন্টনসম্পাদনা
মি. জে ডব্লিউ কুইন্টন ছিলেন ষষ্ঠ চীফ কমিশনার। তার সময়কালেই নাগা রাজ্য ইংরেজদের দখলে আসে। ১৮৯০ সালে হওয়া মণিপুরের বিদ্রোহে তার মৃত্যু হয়।
ডব্লিউ ই ওয়ার্ডসম্পাদনা
মি. জে ডব্লিউ কুইন্টনের পর ১৮৯১ সালে ডব্লিউ ই ওয়ার্ড আসামের চীফ কমিশনার হয়ে আসে। তার সময়ে জমির খাজনা বাড়ানো হয় যার ফলে বহু আন্দোলন হয়েছিল। তার সময়ে বিভিন্ন স্থানে বহু প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল।
স্যার হেনরি কটনসম্পাদনা
ডব্লিউ ই ওয়ার্ডের পর ১৮৯৬ সালে আসামের চীফ কমিশনার হন স্যার হেনরি কটন। স্যার হেনরি কটন কলেজ স্থাপন করেছিলেন সঙ্গে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজও।
লেফ্টেন্যান্ট গভর্ণরের শাসনসম্পাদনা
স্যার হেনরি কটনের পর ১৯০২ স্যার বেমফিল্ড ফুলার আসামের চীফ কমিশনার হন। তার সময়ে জমির কুড়ি-বছরের বন্দোবস্ত হয়। ১৯০৫ সালে তার সময়েই বঙ্গদেশের পূর্বখন্ড পৃথক করে আসামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। স্যার বেমফিল্ড ফুলারই হন এই নতুন প্রদেশের প্রথম লেফ্টেনাণ্ট গভর্নর। শিলং থেকে রাজধানী ঢাকায় তুলে আনা হয় কিন্তু শিলং তখনও জায়গাটির রাজধানী হয়ে থাকে। এই সময়ই অসমীয়া ভাষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি. এ. পাঠক্রমে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়[১]।
স্যার লেঞ্চলেট হেয়ারসম্পাদনা
স্যার হেনরি কটনের পর স্যার লেঞ্চলেট হেয়ার 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম'-এর লেফ্টেনাণ্ট গভর্নর হন। তার সময়েই আমিনগাঁও-কলকাতা রেলপথ তৈরী করা হয় এবং রঙিয়া-টংলা রেলপথ খোলা হয়। তার সময়ে আবরদের সঙ্গে বৃটিশদের যুদ্ধ হয় এবং ফলস্বরূপ উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ভূভাগ নামে স্থানখন্ড আসামের ভিতর আসে।