মূত্র
মূত্র বা প্রস্রাব (ইংরেজি: Urine) নেফ্রন এর বিভিন্ন অংশের সক্রিয়তার ফলে দেহের পক্ষে ক্ষতিকারক অথবা অপ্রয়োজনীয় জৈব ও অজৈব পদার্থ দিয়ে তৈরী স্বল্প অম্লধর্মী ও সামান্য হলুদ বা বর্নহীন তরল তৈরী হয়ে ইউরেটার দিয়ে গিয়ে সাময়িকভাবে মূত্রাশয়ে সঞ্চিত হয় এবং পরে মূত্রনালী দিয়ে দেহের বাইরে নির্গত হয় তাকে মূত্র বলে। অন্যভাবে বললে নেফ্রনের গ্লোমেরুলাস হতে পরিস্রুত আল্ট্রাফিলট্রেট রেনাল টিউব্যুলের মধ্যে দিতে প্রবাহিত হওয়ার সময় কয়েক দফা শোষণ ও নিঃসরণের পর যে হালকা হলুদ বর্ণের তীব্র ঝাঁঝালো অম্লীয় গন্ধযুক্ত ও অম্লধর্মী তরল রেচন পদার্থ মূত্রথলিতে জমা হয় তাকে মূত্র বলে। একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ১.৫ লিটার মূত্র ত্যাগ করে। তবে কিছু কারণে এর পরিমাণ প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন-খাদ্যে তরল পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকলে মূত্রের মাত্র বৃদ্ধি পায় ও শরীরে ঘাম বেশি হলে মূত্রের পরিমাণ কমে যায়।খাদ্য প্রকৃতিও অনেক সময় মূত্রে পরিমাণে পার্থক্য ঘটায়।লবণাক্ত খাদ্য সাধারণত মূত্রের পরিমাণ বাড়ায়।বহুমূত্র (ডায়াবেটিস ),বৃক্কে প্রদাহ(নেফ্রাইটিস) প্রভৃতি রোগ প্রস্রাবের হার ও মাত্রা উভয়কে প্রভাবিত করে। কিছু দ্রব্য মূত্রের স্বাভাবিক প্রবাহের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এসব দ্রব্য ডাইইউরেটিকস (diauretics) বা মূত্রবর্ধক নামে পরিচিত। পানি,লবণাক্ত পানি, চা ও কফি এ ধরনের দ্রব্য।
মূত্র উৎপাদন
সম্পাদনাঅন্তর্মুখী সূক্ষ্মধমনী (Afferent arteriole) মারফৎ বিভিন্ন রেচন পদার্থ (প্রধানত ইউরিয়া) সমন্বিত রক্ত গ্লোমেরুলাসে প্রেরিত হয়। আমাদের যকৃতে ইউরিয়া উৎপাদনের কাজ চলে। গ্লোমেরুলাস বোম্যান্স ক্যাপস্যুল দিয়ে ঘেরা থাকে। উক্ত ক্যাপস্যুল পরিস্রবণের (Filter) কাজ করায় এবং উক্ত অংশে পরিস্রাবণ বা ছাঁকনের উপযোগী চাপ থাকায় প্লাজমার অ-কলয়েডীয় উপাদান পরিস্রাবণ-প্রক্রিয়ায় রেনাল টিউব্যুলে আসে।
রেনাল টিউব্যুলের প্রথম অংশে ইউরিয়ার সঙ্গে প্রোটিন, গ্লুকোজ, জল, ভিটামিন সোডিয়াম, পটাসিয়াম ইত্যাদি লবণ অর্থাৎ দেহের পক্ষে দরকারী উপাদানেরও প্রবেশ ঘটে। শোষণ ক্রিয়ায় মাইক্রোভিলাই অংশ নেয়। নেফ্রনের পরবর্তী অংশে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি রক্তের মধ্যে পুনরায় শোষিত হয়, কিন্তু দেহের পক্ষে ক্ষতিকারক অপ্রয়োজনীয় পদার্থ (যেমন, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড) শোষিত হয় না এবং অশোধিত পদার্থগুলি জলের সঙ্গে একসঙ্গে মূত্রের সৃষ্টি করে। রেনাল টিউব্যুল থেকে সংগ্রাহী নালীর মাধ্যমে ঐ মূত্র রেনাল পেলভিস (Renal Pelvis) অংশে আসে। সেখান থেকে ইউরেটার বা মূত্রনালীর মাধ্যমে মূত্র এসে মূত্রাশয়ে জমা হয়।
মূত্র ত্যাগ
সম্পাদনামূত্রত্যাগ (Micturition): মূত্রাশয় বা মূত্রথলিতে মূত্র সাময়িকভাবে জমা থাকে ও সময়ে সময়ে দেহের বাইরে নির্গত করা হয়। মূত্রথলিতে প্রায় ৪০০ মিলিলিটার মূত্র জমা হলে, মূত্র ত্যাগের তাগিদ অনুভূত হয়। তখন মূত্রাশয়ের পেশী সঙ্কুচিত করে মূত্র ত্যাগ করা যায়। মূত্রথলির মুখে যে স্ফিংকটার পেশী আছে তা শিথিল ও প্রসারিত হয়ে মূত্রথলির মুখ খুলে দেয় বলেই মূত্রত্যাগ সম্ভব হয়। অবশ্য মূত্র ত্যাগের ইচ্ছা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দমিয়ে রাখা যায়। মূত্রথলিকে যে প্রক্রিয়ায় মূত্রশূন্য করা হয়, তাকে মূত্রত্যাগ বলে। মূত্রত্যাগ একধরনের প্রতিবতী-প্রক্রিয়া (Reflex Process)। কয়েকরকম স্নায়ু মূত্রথলির প্রাচীরস্থ পেশীসমূহের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। স্নায়বিক উদ্দীপনার কারণ ঘটলে মূত্রত্যাগ দ্রুত সম্পন্ন হয়।[১]
মূত্রের বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনা১.পরিমানঃ প্রাপ্তবয়স্ক লোকের বৃক্কে দৈনিক ০.৫ থেকে ২.৫ লিটার মুত্র উৎপন্ন হয়।
২.বর্ণঃ মূত্রে ইউরোক্রোম নামক রঞ্জক পদার্থের কারণে এটি হলুদ বর্ণের হয়।
৩.গন্ধঃ মূত্রের গন্ধ অনেকটা ঝাঁঝালো।দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থের ইউরিনোড (C6H8O)- এর উপস্থিতির জন্য মূত্রে এরুপ গন্ধ হয়।
৪.রাসায়নিক ধর্মঃ মুত্র সামান্য অম্লীয় ; এর pH মান ৫.০—৬.৫। কিন্তু আমিষ জাতীয় খাবার খেলে মুত্রের অম্লত্ব বেড়ে যায়। আবার ফলমূল ও শাক সবজি খেলে মুত্র ক্ষারীয় হয়।
৫.আপেক্ষিক গুরুত্বঃ মূত্রের স্বাভাবিক আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০০৮—১.০৩০।
মূত্রের উপাদান
সম্পাদনামূত্রের রাসায়নিক উপাদানের মধ্য ৯০-৯৭% জল এবং ৩-৫% কঠিন পদার্থের। কঠিন পদার্থের মধ্যে জৈব অজৈব উপাদানের রয়েছে।নিচে ছোট আকারে জৈব অজৈব উপাদানগুলো দেখানো হল।
জৈব উপাদান | শতকরা হার | অজৈব উপাদান | শতকরা হার |
---|---|---|---|
ইউরিয়া | ২ | সোডিয়াম | ০.৩৫ |
ইউরিক এসিড | ০.০৫ | পটাশিয়াম | ০.৩৫ |
হিপপিউনিক এসিড | ০.০৫ | ক্যালসিয়াম | ০.০৩ |
ক্রিয়েটিনিন | ০.০৭ | অ্যামোনিয়া | ০.০৪ |
কিটোন বডিস | ০.০2 | ম্যাগনেসিয়াম | ০.০১ |
ক্রিয়েটিন | ০.০১ | ক্লোরাইড | ০.৬০ |
সালফেট | ০.১৮ | ||
ফসফেট | ০.২৭ |
এছাড়াও মূত্রে আয়োডিন,সিসা, আর্সেনিক সহ অন্যান্য উপাদান পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর:১৯৮৬, পৃঃ ১২৫
- ↑ Dorland's Medical Dictionary আইএসবিএন ৮১-৮১৪৭-৭১২-X
জীববিজ্ঞান ২য় পত্র, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেনী, লেখক গাজী আজমল ও গাজী আসমত