মহিলা কল্যাণ সমিতি (আফগানিস্তান)
মুয়াস্যাসা-ই খায়রাইয়া-ই জানান ('মহিলা কল্যাণ সমিতি') বা (ডাব্লিউ ডাব্লিউ এ), বা 'উইমেনস সোসাইটি' এবং ১৯৭৫ সাল থেকে '(আফগান) উইমেনস ইনস্টিটিউট (ডাব্লিউ আই)' নামে পরিচিত সমিতিটি হল ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আফগানিস্তানের একটি মহিলা কল্যাণমূলক সংস্থা।[১] এটি দা মীরমানেচ তুলানেহ বা দা মারমেনো তোলানা ('দ্য উইমেনস সোসাইটি') (ডিএমটি) নামেও পরিচিত। এটি ১৯৭৫ সালে সরকারী নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয় এবং "(আফগান) উইমেনস ইনস্টিটিউট" বা ডাব্লিউআই নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৫৩ সাল থেকে এই সমিতি তাদের নিজস্ব প্রকাশনা "মীরমান" প্রকাশ করা শুরু করে।
ইতিহাস
সম্পাদনাপ্রেক্ষাপট
সম্পাদনারাজা আমানউল্লাহ খান এবং রানী সোরায়া তারজি ১৯২০-এর দশকে সংস্কার কর্মসূচিতে মহিলাদের অধিকারের প্রচার করার সাথে প্রথম মহিলা সমিতি (আঞ্জুমান-ই হিমায়াত-ই-নিসওয়ান) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যদিও ১৯২৯ সালে তাদের পদচ্যুত করার পর তাদের এই সংস্কারগুলি বাতিল করা হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশীয় সরকার আফগান সমাজের সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করে নারীমুক্তিকে তার নীতির অংশীভূত করেছিলেন।
নারী অধিকারের সংস্কারের সময় প্রতিষ্ঠা পায় ডাব্লিউডাব্লিউএ। এর ফলে ১৯৫০ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের অধ্যয়ন করার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সেই সময় থেকেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মহিলারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তথা ব্যাঙ্ক, লাইব্রেরি এবং প্রধান শহরগুলির মধ্যে বিমান যোগাযোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হওয়া শুরু করেন।[২] একটি নির্দিষ্ট সমিতিকে ব্যবহার করে তখনকার সরকারের এই পরিবর্তনগুলিকে সমর্থন পাওয়ার প্রয়োজন ছিল।
প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনাসংস্থাটি মূলত ১৯৪৬ সালে কাবুল শহরে মাদাম আসিন নামের এক ফরাসি মহিলা তথা আফগানি বিবাহিত স্ত্রীর হাত ধরে দা মীরমানেচ তুলানেহ বা দা মারমেনো তোলানা ('দ্য উইমেনস সোসাইটি') (ডিএমটি) নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যদিও প্রতিষ্ঠার পর শীঘ্রই দেশের অর্থ মন্ত্রণালয় এটি দখল করে নেয় ও ১৯৪৭ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনমতো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া শুরু করেন।[৩] ১৯৫০ সাল অবধি এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল।
এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জয়নাব ইনায়েত সিরাজ এবং বিবি জান সহ রাজপরিবারের মহিলারা আবার জনসাধারণ ও সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রীরা এর কর্মী ও সদস্য হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। রানী হুমাইরা বেগম এর প্রথম মহামান্য সচিব এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছিলেন,[৪] যেখানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন রাজা আমানউল্লাহ খানের খুড়তুতো ভাই, জয়নাব ইনায়েত সিরাজ বা জয়নাব এনায়েত সারাজ।[৫] সারাজ ইরানে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছিলেন এবং এইভাবে শাহের অধীনে দেশটির চলমান আধুনিকায়নের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।
এই সমিতির অনেক উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হালিমা রাফাত এবং নাফিসা শায়েক।
কার্যকলাপ
সম্পাদনাডাব্লিউ ডাব্লিউ এ সরকারের আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার সাথে সহযোগিতামূলক ভাবে নারী সংস্কারের জন্য কাজ করেছে এবং মূলত নারী অধিকারের জন্য সরকারের অঙ্গ হিসেবে থেকেছে। ডাব্লিউ ডাব্লিউ এ-এর পরিচালক কুবরা নুরজাই ১৯৬৪ সালের নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজে অংশ নিয়ে নারীদের ভোটাধিকার প্রবর্তন করেছিল, তিনিই সংসদের প্রথম নির্বাচিত কোনও নারী ছিলেন।
ডাব্লিউ ডাব্লিউ এ-এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা। তারা নারী অবগুণ্ঠন উন্মোচনকে উৎসাহিত করেছে, নারীদের বিভিন্ন কাজে নিযুক্তি, সাক্ষরতা, পরিবার পরিকল্পনা এবং বৃত্তিমূলক ক্লাসের প্রচারের মাধ্যমে তারা লিঙ্গ বৈষম্য থেকে নারীর মুক্তির প্রচার করেছে। তারা দাতব্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং সারাদেশে থাকা ডাব্লিউ ডাব্লিউ এ-এর অফিসে মেয়েদের জন্য স্কুল এবং প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে অনুশীলনের আয়োজন করে নারী শিক্ষা ও পেশাগত কাজের মাধ্যমে সমাজে নারীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে।[৬]
ডাব্লিউডাব্লিউএ পর্দাপ্রথার স্বেচ্ছা বিলুপ্তিকে সমর্থন করেছিল। সামাজিকভাবে ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে জেশিনের উৎসবের দ্বিতীয় দিনে এটি বাস্তবায়িত হয়েছিল যখন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী জামিনা বেগমের সাথে সামরিক কুচকাওয়াজের রাজকীয় মঞ্চে রানী হুমাইরা এবং রাজকুমারী বিলকিস বেগম বেপর্দা হয়ে উপস্থিত হন।[৭] এর সাথে ওই বছর তথা ১৯৫৯ সালে ডাব্লিউডাব্লিউএ দ্বারা মহিলাদের পোষাক সংস্কারের সাথে সম্পর্কিত একটি প্রকল্পও ছিল। বোরখা ঐচ্ছিক হয়ে গেছে তা পর্যবেক্ষণ করার পর, বিদেশী নারীদের একটি দল বিশেষ করে আমেরিকান জিন বীচার ভোগ প্যাটার্ন সার্ভিস থেকে সহায়তা পাওয়ার পর কাবুলের মহিলা কল্যাণ সমিতির স্কুল ফর গার্লস-এ শিক্ষাদানের অভিপ্রায়ে সেলাই ক্লাসের আয়োজন করে। তাদের অভিসন্ধি ছিল আফগান নারীদের পশ্চিমা আদব কায়দায় পোশাক তৈরি করতে শেখানো।[৮] সাধারণত তখনও পর্দানসিন থাকা আফগান উচ্চবিত্ত ঘরের মহিলারা সেলাইয়ের কাজে নিজেদের নিযুক্ত করেছিলেন। পরে কাবুলের ইউনাইটেড স্টেটস ইনফর্মেশন সেন্টার অডিটোরিয়ামে পশ্চিমা পোশাক পড়ে একটি ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়,[৯] এরপর থেকে উচ্চবিত্ত ঘরের মহিলারা কাবুলের রাস্তায় খোলাখুলি ভাবে পশ্চিমা পোশাকের ব্যবহার শুরু করেন।
ডাব্লিউডাব্লিউএ শুধু আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সরকারের নারী নীতির মুখপাত্র হিসেবেই কাজ করে নি, বরং এটি আফগান পররাষ্ট্র নীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বের কাছে আফগানিস্তানের একটি আধুনিক চিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা আকর্ষণ করা এই নীতির একটি অংশ ছিল এবং শিক্ষিত এবং পেশাদার শহুরে অভিজাত নারীদের সমন্বয়ে গঠিত ডাব্লিউডাব্লিউএ বহির্বিশ্বে আফগান আধুনিকতা এবং অগ্রগতির একটি চিত্র প্রদান করেছিল।[১০] ১৯৫০-এর দশকে পোলিশ রিপোর্টার আন্দ্রেজ বিঙ্কোস্কি কাবুলে গিয়ে ডাব্লিউডাব্লিউএ উচ্চবিত্ত সদস্যাদের সাথে সাধারণ আফগান মহিলার মধ্যে বিরাট বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করেছিলেন। একদিকে তারা ছিলেন পশ্চিমা ফ্যাশনে সজ্জিত একজন আধুনিক মহিলা ছিলেন আবার অপর দিকে কাবুলের বেশিরভাগ সাধারণ মহিলারা তখনও পর্দানসিন থাকতেন, শুধুমাত্র বোরখা পরিহিত হয়েই বাড়ী থেকে বের হতেন বা দরজার আড়াল ছাড়া কোনো সম্পর্কহীন পুরুষের সাথে কথা বলতেন না।[১১] ১৯৫৭ সালে, আফগানিস্তান এশীয় মহিলা সম্মেলনে তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। ১৯৬২ সালে ডাব্লিউডাব্লিউএ থেকে একটি প্রতিনিধি দল সোভিয়েত ইউনিয়ন যায় এবং মস্কোতে আয়োজিত মহিলাদের আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের পঞ্চম বিশ্ব কংগ্রেসে (২৪-২৯ জুন, ১৯৬৩) সদস্য পাঠানো হয়।
ডাব্লিউডাব্লিউএ এর শাখা হীরাট, কান্দাহার এবং মাজার-ই-শরীফেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে মোট দশটি শহরে এর শাখা অফিস প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে আট হাজার সদস্যাও ছিলেন। স্থানীয় অফিস স্থাপনে তাদের কাজ এবং গ্রামীণ মহিলাদের সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ডব্লিউডাব্লিউএ কখনই শহুরে অভিজাত মহিলাদের বৃত্তের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Julie Billaud: Kabul Carnival: Gender Politics in Postwar Afghanistan
- ↑ Timothy Nunan Humanitarian Invasion: Global Development in Cold War Afghanistan
- ↑ Timothy Nunan Humanitarian Invasion: Global Development in Cold War Afghanistan
- ↑ Rahimi, Wali Mohammad: Status of women: Afghanistan, UNESCO Principal Regional Office for Asia and the Pacific (Thailand). Regional Unit for the Social and Human Sciences in Asia and the Pacific (1991) BKSS/91/277.1000
- ↑ Timothy Nunan Humanitarian Invasion: Global Development in Cold War Afghanistan
- ↑ Timothy Nunan Humanitarian Invasion: Global Development in Cold War Afghanistan
- ↑ Tamim Ansary (2012) Games without Rules: The Often-Interrupted History of Afghanistan
- ↑ Jenifer Van Vleck : Empire of the Air: Aviation and the American Ascendancy
- ↑ Jenifer Van Vleck : Empire of the Air: Aviation and the American Ascendancy
- ↑ Timothy Nunan Humanitarian Invasion: Global Development in Cold War Afghanistan
- ↑ Timothy Nunan Humanitarian Invasion: Global Development in Cold War Afghanistan