আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক মহিলা সংস্থা
আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক মহিলা সংস্থা বা ডেমোক্রেটিক উইমেনস অর্গানাইজেশন অফ আফগানিস্তান (ডিওএডাব্লিউ) (সাজমান-এ জানান-এ ডিমুক্রাটিক-এ আফগানিস্তান) ছিল ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আফগানিস্তানের একটি মহিলা সংস্থা। এটি ছিল আফগানিস্তানের পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপিএ) অংশ।[১] এটি আফগানিস্তানের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের কমিউনিস্ট যুগে আফগান নারী আন্দোলনের প্রভাবশালী সংগঠন হিসেবে নারী কল্যাণ সমিতিকে প্রতিস্থাপন করে। কমিউনিস্ট যুগে, এটি ছিল সরকারের উগ্র নারী অধিকার নীতির অঙ্গ তথা মুখপাত্র।
প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনা১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে কাবুলে ডিওএডাব্লিউ প্রতিষ্ঠিত হয় এর প্রতিষ্ঠা সদস্যারা ছিলেন অনাহিতা রাতেবজাদ, সোরায়া পারলিকা,[২] কোবরা আলি, হামিদেহ শেরজাই, মোমেনেহ বাসির এবং জামিলেহ কিশ্তমান্দ। অনাহিতা রাতেবজাদ ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৬ সালের অবধি এই সংস্থার সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ সালের আগে
সম্পাদনাডিওএডাব্লিউ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মহিলা কল্যাণ সমিতি আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় মহিলা সংগঠন ছিল, কিন্তু ডিওএডাব্লিউ ধীরে ধীরে তুলনামূলক বেশি উগ্র কার্যসূচী নিয়ে এটিকে প্রতিস্থাপন করা শুরু করে।
ডিওএডাব্লিউ মহিলাদের অধিকারের সমর্থন ও প্রতিরক্ষায় মহিলাদের সংগঠিত করতে সক্ষম হয়, যার ফলে নারী অধিকার ১৯৬৪ সালের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ তারা মহিলাদের অধিকারের সমর্থনে আফগানিস্তানে প্রথমবারের মতো মহিলাদের বিক্ষোভেরও আয়োজন করে।
১৯৬৮ সালে সংসদের রক্ষণশীল সদস্যরা মহিলাদের বিদেশে পড়াশোনা নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দিলে ডিওএডাব্লিউ এই পরামর্শকে সংবিধানের পরিপন্থী দাগিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আয়োজন করে। তাদের প্রতিবাদের ফলে প্রস্তাবিত আইনটি সংসদ প্রত্যাহার করে নেয়।
১৯৭০ সালে কাবুলে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে, মৌলবাদী মুসলিমরি আধুনিক পশ্চিমা পোশাক পরে রাস্তায় চলাফেরা করা মহিলাদের ভর্ৎসনা করতেন এবং হাফপ্যান্ট এবং মিনি স্কার্ট পরা মহিলারা পুরুষদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটে, কেউ কেউ তাদের দিকে অ্যাসিড হামলাও করে। ডিওএডাব্লিউ তদন্ত এবং দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ৫,০০০ মহিলা নিয়ে একটি গণবিক্ষোভ সংগঠিত করে, ফলে এই হামলার গ্রেপ্তারি এবং তদন্ত উভয়ই হয়।
কমিউনিস্ট যুগ
সম্পাদনা১৯৭৮ সালের সাওর বিপ্লবের পর পিডিপিএ ক্ষমতা গ্রহণ করলে ডিওএডাব্লিউ গণতান্ত্রিক আফগানিস্তানে (ডিআরএ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনাহিতা রাতেবজাদ ঘোষণা করেছিলেন যে ডিওএডাব্লিউ-এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল "সাওর বিপ্লবের" নীতির প্রতিরক্ষায় সামন্তবাদ এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। ১৯৭৯ এবং ১৯৮০ সালের সময়কালে এটিকে পিপলস অর্গানাইজেশন অফ আফগান উইমেন (কেওএডাব্লিউ) বলা হত।
এটি তার নিজস্ব মাসিক জার্নাল, জানান-ই-আফগানিস্তান (আফগানিস্তানের নারী) প্রকাশ করা শুরু করে। এটি গ্রামীণ ও শহুরে সকল বয়সের এবং সকল শ্রেণির মহিলাদের জন্য শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে এবং সাওর বিপ্লবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের অবগত করার জন্য একটি সাক্ষরতা অভিযান শুরু করে।
১৯৮১ সালে ডিওএডাব্লিউ-এর ১৯টি জেলায় স্থানীয় কার্যালয়, সাতটি পৌর কমিটি এবং ২০৯টি প্রাথমিক সংস্থা ছিল, যাদের প্রধান কাজ ছিল বিপ্লবের সমর্থনে সংগঠনের মাধ্যমে মহিলাদেরকে দলে আকৃষ্ট করা।
কমিউনিস্ট যুগে আফগান সরকার এবং তাদের সমর্থক সোভিয়েত উভয়েই নারী অধিকারকে সমর্থন করেছিল। রাজতন্ত্রের সময়ের অবস্থার বিপরীতে শহুরে অভিজাত মহিলাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা নারীর অধিকার বোধকে কমিউনিস্টরা সমাজের সকল শ্রেণী, গ্রামীণ নারী ও মেয়েদের জন্য প্রসারিত করার চেষ্টা করে।[৩]
গ্রামীণ এলাকায় নারীমুক্তির জন্য কমিউনিস্ট সরকারের আদর্শগত প্রয়োগ ছিল নারীদের জন্য সাক্ষরতা অভিযান এবং মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক স্কুলে শিক্ষা, যার ফলে বিশেষ করে পাশতুন উপজাতীয় এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ তৈরি হয়।[৪] গ্রামীণ আফগানিস্তানে লিঙ্গ নির্জনতা বহন ছিল স্থানীয় সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী অংশ। স্কুলে যাওয়ার জন্য মেয়েদের বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়, এবং তাই স্কুলকে তারা বেশ অসম্মানজনক জিনিস হিসাবে দেখত। মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের জন্য বাধ্যতামূলক স্কুলে শিক্ষার নীতি রক্ষণশীল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দ্বারা তীব্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয় এবং মুজাহিদীন নামক ইসলামী গেরিলারা সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অবদান রাখে।[৩] রক্ষণশীল গ্রামীণ লোকজন শহুরে লোকজনকে নারীমুক্তির নীতির কারণে আংশিকভাবে অধঃপতিত হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ শহুরে নারীরা পুরুষদের সাথে মিলেমিশে থাকত এবং প্রকাশ্যে জনজীবনে একসাথে অংশগ্রহণ করতে পারত[৫] এছাড়াও নারীদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাধারণভাবে নারীর অধিকার সম্প্রসারণকে তারা কমিউনিজম এবং নাস্তিকতার সাথে যুক্ত করেছিলেন।
কমিউনিস্ট শাসনকালে হাজার হাজার শহুরে অগ্রবর্তী নারীদেরকে পিডিপিএ পার্টি এবং আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র মহিলা সংস্থার ক্যাডার এবং মিলিশিয়াতে নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের মুজাহিদীন নামক ইসলামী গেরিলাদের বিরুদ্ধে সামরিক যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। শহুরে মহিলাদের মধ্যে একটি উদ্বেগ ছিল যে, প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরা কমিউনিস্ট শাসন এবং একটি সুরক্ষিত নারী অধিকারকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।[৬]
বিগঠন
সম্পাদনা১৯৮৬ সালে নাজিবউল্লাহ যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি পিডিপিএ শাসন বজায় রাখতে এবং নারীদের অধিকারের প্রতি রক্ষণশীল ইসলামী বিরোধিতা কমানোর জন্য ডিওএডাব্লিউ-এর মার্কসবাদী বক্তব্যকে নির্মূল করেন এবং সংগঠনের নামটি সাজমান-ই-ডেমোক্রেটিক-ই-জানান-ই-আফগানিস্তান (আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক সংগঠন) থেকে পরিবর্তন করে শুরা-ই-সারাসারি-জানান-ই-আফগানিস্তান (নিখিল আফগানিস্তান মহিলা পরিষদ) রাখা হয়। রাতেবজাদকে সরিয়ে ফিরোজা ওয়ারদাককে সংস্থার সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।[৭]
১৯৯০ সালে নাজিবউল্লাহ আফগানিস্তানের ডেমোক্রেটিক উইমেনস অর্গানাইজেশনকে বিলুপ্ত করেন এবং এটিকে অপর একটি অরাজনৈতিক সংগঠন আফগান মহিলা পরিষদ বা আফগান উইমেনস কাউন্সিলের সাথে প্রতিস্থাপিত করেন।[৮]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Moghadam, Valentine M. Modernizing Women: Gender and Social Change in the Middle East. Boulder, CO: Lynne Rienner Publishers, 1993.
- ↑ AAN Obituary: Unfaltering women’s rights activist Soraya Parlika (1944-2019)
- ↑ ক খ Timothy Nunan: Humanitarian Invasion: Global Development in Cold War Afghanistan
- ↑ Diasporas and Diplomacy: Cosmopolitan Contact Zones at the BBC World Service
- ↑ War at the Top of the World: The Struggle for Afghanistan, Kashmir and Tibet
- ↑ Afghanistan under Soviet Domination, 1964–91
- ↑ From Patriarchy to Empowerment: Women’s Participation, Movements, and Rights
- ↑ Valentine Moghadam: From Patriarchy to Empowerment: Women’s Participation, Movements, and Rights