মহান মহারাজ

ভারতীয় গণিতবিদ ও সন্ন্যাসব্রতী

স্বামী বিদ্যানাথানন্দ বা অধ্যাপক ড. মহান মহারাজ ( জন্ম: ৫ এপ্রিল ১৯৬৮ [১]) হলেন একজন ভারতীয় গণিতবিদ এবং রামকৃষ্ণ আদেশ তথা রামকৃষ্ণ মিশনের আধ্যাত্মিক সন্ন্যাসী মহারাজ। তার পূর্বাশ্রম তথা পিতৃদত্ত নাম ছিল মহান মিত্র। বর্তমানে তিনি মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এর গণিতের অধ্যাপক। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি গণিতে শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার [২] এবং ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে গাণিতিক বিজ্ঞানের জন্য 'ইনফোসিস পুরস্কার' লাভ করেন। [৩] তিনি মূলত, 'হাইপারবোলিক জিওমেট্রি', 'জিওমেট্রিক গ্রুপ থিওরি', 'লো ডাইমেনশন্যাল ট্রপোলজি' অ্যান্ড 'কমপ্লেক্স জিওমেট্রি'র জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

মহান মহারাজ
মহান মিত্র
জন্ম (1968-04-05) ৫ এপ্রিল ১৯৬৮ (বয়স ৫৫)
জাতীয়তাভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনসেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল,কলকাতা
আইআইটি, কানপুর
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলি
পুরস্কারশান্তি স্বরূপ ভটনাগর পুরস্কার (২০১১)
ইনফোসিস পুরস্কার (২০১৫)
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রগণিত
প্রতিষ্ঠানসমূহরামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট
টাট ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ
অভিসন্দর্ভের শিরোনামম্যাপস্ অন বাউন্ডারিজ অফ হাইপারবোলিক মেট্রিক স্পেসেস্ (১৯৯৭)
ডক্টরাল উপদেষ্টাঅ্যান্ড্রু ক্যাসন
ডক্টরেট শিক্ষার্থীঅধ্যাপক শুভব্রত দাস (প্রেসিডেন্সি কলেজ)

জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

মহান মিত্র ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল কলকাতার এক মিত্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার আইনজ্ঞ পিতা কলকাতার এক অফিসে ম্যানেজারের কাজ করতেন।[৪]মহানের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সঙ্গে মহান পরিচিত হন এবং তখন থেকেই তিনি মনের মধ্যে অনুভব করেন জ্যামিতির নকশা আর গণিতে সংখ্যাতত্ত্ব। এখানে তার শিক্ষক ছিলেন ফাদার বুশে। [৫] দ্বাদশ শ্রেণির পর তিনি সর্বভারতীয় জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অল ইন্ডিয়া র‍্যাঙ্ক (এআইআর) ৬৭ পেয়ে কানপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে প্রথমদিকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু আগাগোড়াই তার প্রিয় বিষয় ছিল গণিত। পড়াশোনার বিষয় গণিতে পরিবর্তন করে নেন। [৬]তিনি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে আইআইটি কানপুর থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। [৭] ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর মহান বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে যোগ দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। তাঁর গবেষণার উপদেষ্টা ছিলেন অ্যান্ড্রু ক্যাসন । তিনি ১৯৯২ - ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আর্লে সি. অ্যান্থনি ফেলোশিপ' এবং ১৯৯৬ - ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের জন্য মর্যাদাপূর্ণ স্লোন ফেলোশিপ লাভ করেন।[৬] ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'ম্যাপস্ অন বাউণ্ডারিজ অফ হাইপারবোলিক মেট্রিক স্পেসেস্' শীর্ষক গবেষণা পত্রের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

এর পর দেশে ফিরে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের অল্প কিছুদিন চেন্নাইয়ের ইনস্টিটিউট অফ ম্যাথামেটিক্যাল সায়েন্স-এ কাজ করেন। ওই বছরেই তিনি বেদান্তিক দার্শনিক রামকৃষ্ণ পরমহংসের চিন্তাধারার প্রবল আকর্ষণে যোগ দেন বেলুড়স্থিত রামকৃষ্ণ মিশনেরামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক এবং গবেষণার ডিন হন এবং ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পদে ছিলেন।[৮] বর্তমানে তিনি মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর গণিতের অধ্যাপক । [৯]

উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পাদনা

  • ড. মহান মিত্র ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে গাণিতিক বিজ্ঞান বিষয়ে 'লেমিনেশন স্পেস এবং হাইপারবোলিক ম্যানিফোল্ডের সমাপ্তির ক্ষেত্রে' এক অসামান্য নিবন্ধ রচনা করেন। "ক্যানন-থার্স্টন ম্যাপ"-এর অস্তিত্বের প্রমাণে রচিত নিবন্ধটি "জিওমেট্রিক অ্যান্ড ফাংশনাল অ্যানালিসিস" জার্নালে প্রকাশিত হয়।[১০]
  • একজন সত্যিকারের গণিতবিদ হওয়ায়, ড.মহান মহারাজ ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গণিত শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট নন বরং বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বিশ্বাস করেন গণিত শিক্ষায় উৎকর্ষের জন্য উদ্ভাবনী চিন্তার খুব প্রয়োজন। যেভাবে এখন গণিত পড়ানো হয় তার পরিবর্তনের চেষ্টায় আছেন তিনি। গাণিতিক বিজ্ঞানে উদ্ভাবনী ধারণা প্রচারের লক্ষ্যে তিনি তার সহপাঠী বন্ধু ও বেঙ্গালুরুর 'ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল সায়েন্সেস'-এর তাত্ত্বিক পদার্থবিদ গোপাকুমার ও দুই ছাত্রের সহযোগিতায় ফান্ডামেন্টাল সায়েন্স এডুকেশন ট্রাস্ট গঠন করছেন এবং তিনি এই ট্রাস্টের জন্য ইতিমধ্যে ইনফোসিস পুরস্কারে প্রাপ্ত ৬৫ লক্ষ টাকা দান করেছেন। [৬]

২০১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত গণিতবিদদের আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন ।

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

আমেরিকার বার্কলিতে অবস্থানকালে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের বেশ কিছু রচনা পড়ে অত্যন্ত প্রভাবিত হন। শেষে তিনি স্থির করেন দেশে ফিরে তিনি সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করবেন। তাই স্বল্প সময় চেন্নাইয়ে কাটিয়ে বেলুড়ে চলে আসেন।  

ড. মহান মিত্র ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বেলুড়ে অধ্যাপক থাকাকালীন সময়ে রামকৃষ্ণ আদেশের সন্ন্যাসী হতে চান।মাতাপিতার সম্মতি আদায়ে তিনি বেশ কিছুদিন সময় নেন। পরে অবশ্য তারা অনুমতি দেন। প্রথমে তার নাম রাখা হয়েছিল ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচৈতন্য। পরে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে দীক্ষান্তে নাম হয় স্বামী বিদ্যানাথানন্দ এবং গৈরিক বসন ধারন করেন।

পার্থিব সুখ বিসর্জন দিয়ে, তিনি কিন্তু ধর্মকে বিজ্ঞানে হস্তক্ষেপ করতে দেননি। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্রকৃত মহান ব্যক্তিত্বের কথায়—

(ইংরেজি)

«“I follow no organised religion. If you asked me one and put a gun to my head, I would probably say science.”..»

(বাংলা)

«"আমি কোনও সংগঠিত ধর্ম অনুসরণ করি না। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন এবং আমার মাথায় বন্দুক রাখেন, আমি সম্ভবত বিজ্ঞান বলব।..»

স্বামী বিদ্যানাথানন্দের ধর্মে বিশ্বাস থাকার পাশাপাশি বিজ্ঞানেও আস্থা আছে। তার জীবনে বিজ্ঞান ও ধর্ম এই দু’য়ের মধ্যে কোনও অসঙ্গতি নেই।

বিজ্ঞান এবং ধর্মের সঙ্গে কোন বিরোধ নেই, তারা যে একসাথেই চলতে পারে - তা যেমন দেখিয়েছেন প্রাচীন ভারতের আর্যভট্ট, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন। সাম্প্রতিক কালের রামকৃষ্ণ মিশনের এই অধ্যাপক সন্ন্যাসী মহান মহারাজের কাছে বিজ্ঞানই তার ধর্ম। তাই তিনি বলেন—

(ইংরেজি)

«"I am enjoying being a monk as much as I enjoy my mathematics"..»

(বাংলা)

«আমি আমার গণিতকে যতটা উপভোগ করি ততটাই আমি সন্ন্যাসী হয়ে উপভোগ করছি..»

[১১]

সম্মাননা ও পুরস্কার সম্পাদনা

  • ২০১০ খ্রিস্টাব্দে হায়দ্রাবাদে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথামেটিশিয়ানস তথা গণিতজ্ঞদের বিশ্বসম্মেলনে একবিংশ শতকে বিমূর্ত গণিতের ধারণা উপস্থাপনের জন্য, গেরুয়াবসন ধারী তরুণ গণিতবিদ অধ্যাপক ড.মহান মহারাজ প্রথম লাভ করেন সেরার সম্মান - ফিল্ডস মেডেল
  • ‘জিওম্যাট্রিক গ্রুপ থিওরি, লো-ডাইমেনশন্যাল টপোলজি অ্যান্ড কমপ্লেক্স জিওমেন্টি’ তে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ইনফোসিস ফাউন্ডেশন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রদান করে ইনফোসিস পুরস্কার [১৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Brief Profile of the Awardee, Shanti Swarup Bhatnagar Prize" 
  2. "11 scientists selected for Shanti Swarup Bhatnagar award"। New Delhi। IBN Live। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১১। ৪ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১১ 
  3. "Infosys Prize - Laureates 2015" 
  4. "At a larger level... asking questions is not encouraged'"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৩ 
  5. "Meet India's "Mathematician Monk" Who Believes That Science is His Religion"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৪ 
  6. "Prof Mahan Mitra"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৩ 
  7. "Being a mathematician is not that far removed from being a monk: Prof. Mahan Mj"। Mint। ৫ ডিসেম্বর ২০১৫। 
  8. "Vidyanathananda, the wizard who became a monk - Times of India"The Times of India। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৪-১৫ 
  9. "Faculty"math.tifr.res.in 
  10. মহারাজ, মহান (২০১৪)। "Ending Laminations and Cannon–Thurston Maps"। Geometric and Functional Analysis24: 297–321। arXiv:math/0701725 এসটুসিআইডি 9083637ডিওআই:10.1007/s00039-014-0263-x 
  11. Pandey, Jhimli Mukherjee (২৮ অক্টোবর ২০১১)। "RKM monk wins country's top math award"The Times of IndiaKolkata। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জানুয়ারি ২০১৩ 
  12. "Bhatnagar Awardees"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৩ 
  13. "বিজ্ঞানই আমার ধর্ম, জানালেন ৬৫ লাখ পুরস্কার জয়ী সাধু"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৩ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা