মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড

(মরিচঝাঁপি গণহত্যা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড ছিলো ১৯৭৯ সালে রাজ্যপুলিশ দ্বারা রচিত ঘৃণ্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ড যেখানে দেশভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী বাঙালি হিন্দুদের সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি দ্বীপে গণহত্যার শিকার হতে হয়েছিলো।[]

মরিচঝাঁপি গণহত্যা
মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গ-এ অবস্থিত
মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড
স্থানমরিচঝাঁপি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
তারিখ১ - ৩১ শে জানুয়ারি, ১৯৭৯ (ইউটিসি+৬:০০)
লক্ষ্যবাঙালি হিন্দু
হামলার ধরনগণহত্যা
নিহত৫০ ~ ১০০০ জন
হামলাকারী দলপশ্চিমবঙ্গ পুলিশ

পটভূমি

সম্পাদনা

দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে বহু বাঙালি শরণার্থী হিন্দু তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। প্রথম সারির উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বাঙালী হিন্দু শরণার্থীরা সহজে কলকাতায় ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য এলাকায় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলেও পরবর্তী সারির বিশাল জনসংখ্যার দরিদ্র অমুসলিমদের পশ্চিমবঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় নি।[] বলপূর্বক তাদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দণ্ডকারণ্যের (বেশিরভাগই উড়িষ্যা এবং মধ্যপ্রদেশ রাজ্যভুক্ত) শিলাময় এবং আতিথেয়তাশূন্য অঞ্চলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।[][] যখন ১৯৭৭ সালে বাম-ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে, তখন তদানীন্তন রাজ্য মন্ত্রী (মার্ক্সিস্ট ফরওয়ার্ড ব্লকের) রাম চ্যাটার্জী দণ্ডকারণ্যের শরণার্থী ক্যাম্পে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং তাদের পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন।

ভিন রাজ্য হওয়ায় ভাষার বৈচিত্রতা এবং দণ্ডকারণ্যের ঘন জঙ্গল, খাবার জলের অপ্রতুলতা ও ম্যালেরিয়া ডায়রিয়াসহ অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে খাপ খেতে না পেরে ১৯৭৮ সালে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বাংলায় ফিরতে শুরু করে। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের রাজ্য-শাসনপ্রণালীতে পরিবর্তন আনে এবং শরণার্থীদের রাজ্যের নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে।[] প্রায় ১,৫০,০০০ মতো শরণার্থী দন্ডকারণ্য ছেড়ে আবার পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসলে উদ্বাস্তুদের কয়েকজনকে আটক ও বিতাড়িত করা হয়।[] কিন্তু অনেকেই পুলিশি বেষ্টনী উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে পেরেছিলো। আর যারা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে পারে নি, সেই ফেরত আসা শরণার্থীরাই মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নেয় এবং নিজ উদ্যোগে সেখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করে বন্যা থেকে বাঁচার জন্য বাঁধ নির্মাণ, মৎস্য চাষ ও চাষাবাদের ব্যবস্থা করে উক্ত দ্বীপে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু তদানীন্তন দ্বীপে শরণার্থীদের স্বীয় উদ্যোগে এই পূনর্বাসন মেনে নেয় নি এবং উক্ত এলাকাকে সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে তাদের এই বসবাসকে আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবৃতি দিয়েছিলেন।

জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার মরিচঝাঁপি দ্বীপের বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে। কোরানখালি নদীতে পুলিশি অবরোধ বসানো হয় যাতে করে মরিচঝাঁপি দ্বীপের শরণার্থীরা যেন নদী পার হয়ে পাশের কুমিরখালি গ্রামে ঔষধ,খাদ্যশস্য ও জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য কিনতে যেতে না পারে[] সেদিনগুলোর ঘটনা স্মৃতিচারণ করে পুলিশ ও কমিউনিস্টদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসাদের একজন নারায়ণ মন্ডল উল্লেখ করেন -

সেদিন ৩০ থেকে ৩৫ টি লঞ্চ সহকারে পুলিশ পুরো দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলে। কুমিরমারি থেকে খাবার জল আনতে যাবো, সেই পরিস্থিতিও ছিল না। আমাদের জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলার জন্য তারা উঠে-পরে লেগেছিল। অসহায়ভাবে খিদের জ্বালায় তাই আমরা নারকেলের পাতা ও ঘাস (যদু পালং) খেতে বাধ্য হই। বাচ্চাদের অনেকেই শুধু ডায়রিয়াতেই মারা যায়। ছোট শিশুদের ছুঁড়ে কুমিরের মুখে ফেলে দেওয়া হয় । পাশের কুমিরমারি গ্রাম থেকে খাবার জল, ঔষুধ এবং আহার-সামগ্রী যোগানের জন্য অবরোধের ১০ম দিনে আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। নারীদের দেখে অন্তত দয়া হবে এই আশায় আমরা একটা নৌকাতে ১৬ জন মহিলাকে পাঠায়। কিন্তু "ইন্দ্রজিৎ এমভি৭৯" নামের একটি লঞ্চ দ্রুত গতিতে নৌকাটির নিকট এগিয়ে আসে এবং নদীর মাঝপথে নৌকাটিকে বিধ্বস্ত করে। ১৪ জন নারীকে আমরা ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করি। আর পরবর্তীতে বাকি দুজন কে বাগনান জঙ্গল থেকে উদ্ধার করি, যাদের উপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল।

[]

১৯৭৯ সালের ৩১ শে জানুয়ারী দুপুরের দিকে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের পরিচালিত পুলিশ দলকে উদ্বাস্তুরা ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালালে পুলিশ লাগাতার গুলিবর্ষণ শুরু করে।[] ঘটনার শিকার আরেকজন শরণার্থী মুকুন্দ মন্ডল স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন -

দুপুর ৪টে নাগাদ পুলিশরা আমাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরা সে সময় একটা নৌকাতে করে দ্বীপ ছেড়ে পাশের কুমিরমারি গ্রামে পালাতে চাইছিলাম। চারদিক প্রবল আতঙ্ক ভর করেছিলো। সে সময় আমার নাতনির বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে একটা গুলি তার গায়ে এসে লাগে এবং নৌকাতেই তার মৃত্যু হয়। আমাদের তার মৃত দেহ নদীর জলে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমরা এতোটাই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম সেই সময়।

[]

হত্যার পর পুলিশ ও সিপিএমের দলীয় কর্মীরা মৃতদেহগুলোকে নদীতে ফেলে দেয়। আবার অনেকেরই নদী সাঁতরে পালাতে গিয়ে ডুবে মৃত্যু হয়।[]

ঘটনার পঞ্চদশ দিনে কোলকাতা হাই কোর্ট মরিচঝাঁপি দ্বীপে খাবার জল, প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং ডাক্তারদের প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে।[] শেষতক অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পেরে না উঠে তৎকালীন রাজ্যের সিপিআই(এম) মে মাসের দিকে জোরপূর্বক দ্বীপটিকে খালি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।[] সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের উক্ত দ্বীপে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পুলিশের সহায়তায় দলীয় ক্যাডাররা মে মাসের ১৬ তারিখ ৩০০ টি পরিবারের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। হত্যাকান্ডের ঘটনার পর দ্বীপে পরে থাকা অবশিষ্ট শরণার্থীদের পুনরায় মল্কানগিরি (উড়িষ্যা), মানা এবং কুরুত (মধ্যপ্রদেশ) এবং আদিলাবাদে (উত্তর প্রদেশে) জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার কিছু কিছু শরণার্থী পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পিয়ালী, তালদি, বাসন্তী, ঘুটিয়ারী শরিফ,[১০][১১] গোসাবা ও ক্যানিং-এ আশ্রয় গ্রহণ করে।[১২]

মৃত্য সংখ্যা

সম্পাদনা

এই গণহত্যার এত দশকের পরেও মৃতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে আজ‌ও দ্বিমত দেখা যায়। কমিউনিস্ট সরকার পুলিশের গুলিতে দু'জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করলেও, ঘটনার শিকার এবং স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন তথ্যসূত্র এই সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০০ ছিল বলে দাবী করে।[১৩]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে

সম্পাদনা

শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস ‘দণ্ডক থেকে মরিচঝাঁপি’ (১৯৮০-৮১) বঙ্গের (পূর্ববঙ্গসহ) নিম্নবর্গের বা সংখ্যালঘুদের প্রতি অবিচার ও রাজনীতির গুঁটি হিসেবে ব্যবহার হওয়ার করুণ কাহিনি নিয়ে একমাত্র উপন্যাস।[১৪]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Book Excerpt: 'Countless Were killed, Many Raped,' Say Eyewitnesses of Bengal's Marichjhapi Massacre"। সংগ্রহের তারিখ ২১ মে ২০১৯ 
  2. Asim Pramanik (২৩ মার্চ ২০১৪)। "1979 Marichjhapi killings revisited"। thestatesman.net। ৬ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ অক্টোবর ২০১৪ 
  3. Debdatta Chowdhury (২০১১)। "Space, identity, territory: Marichjhapi Massacre, 1979"। The International Journal of Human Rights15 (5): 664–682। ডিওআই:10.1080/13642987.2011.569333 
  4. Ross Mallick (২০০৭)। Development Policy of a Communist Government: West Bengal Since 1977। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 99। আইএসবিএন 9780521047852 
  5. "Refugee Resettlement in Forest Reserves: West Bengal Policy Reversal and the Marichjhapi Massacre"The Journal of Asian Studies। The Association for Asian Studies। 58 (1): 108। ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। ডিওআই:10.2307/2658391। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ৩, ২০০৯  অজানা প্যারামিটার |শেষাংশপ্রথমাংশ1= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  6. Kamalendu Bhadra। "Wound still raw for Marichjhapi survivors"। timesofindia.indiatimes.com। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  7. "Controversies that dogged the pragmatic chief minister"The Telegraph। জানুয়ারি ১৮, ২০১০। ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ২৯, ২০১২ 
  8. "The Tale of Marichjhapi :Review of the book "Marichjhapi chhinna desh, chhinna itihaash""radicalsocialist.in। ১২ মে ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ অক্টোবর ২০১৪ 
  9. Annu Jalais (এপ্রিল ২৩, ২০০৫)। "Dwelling on Morichjhanpi"Economic and Political Weekly: 1757–1962। 
  10. Mitra, Sukumar (জুলাই ৬, ২০১১)। "গণহত্যার সুবিচার হবে!"The Sunday Indian। জুন ২৩, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ২৯, ২০১২ 
  11. Jaideep Mazumdar। "Wound still raw for Marichjhapi survivors"https://swarajyamag.com। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ 
  12. Mitra, Shyamalendu (আগস্ট ৩, ২০১১)। "তিন দশক পরে মরিচঝাঁপির ফাইল ফের খুলল রাজ্য"Anandabazar Patrika। জানুয়ারি ১৬, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ২৯, ২০১২ 
  13. Bhattacharya,, Snigdhendu (২৫ এপ্রিল ২০১১)। "Ghost of Marichjhapi returns to haunt"The Hindustan Times। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০১৩ 
  14. "বরিশালের যোগেন মণ্ডল ও উপমহাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু"কালের কণ্ঠ। ৭ জানুয়ারি ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০২৪