ব্রিটিশদের তিব্বত অভিযান
ব্রিটিশদের তিব্বত অভিযান (তিব্বতি লিপি ཤིང་འབྲུག་དམག) ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় এবং ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে শেষ হয়। তিব্বতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন ও সিক্কিম ও তিব্বতের মধ্যেকার সীমান্ত বিতর্ক নিরসনের উদ্দেশ্যে টিবেট ফ্রন্টিয়ার কমিশনের ছত্রচ্ছায়ায় পরিচালিত এই অভিযানের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী তিব্বত আক্রমণ করে।[৩] রুশদের মধ্য এশিয়া অঞ্চলে দৃষ্টিপ্রদানের ফলে ব্রিটিশ ভারতে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের চিন্তায় ভীত ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড কার্জনের উৎসাহে রুশদের পূর্বগামী প্রসারের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে এই অভিযান পরিচালিত হয়।[২]:১ ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা রুশদের নিকট হতে স্পষ্ট বার্তা লাভ করে যে তাদের তিব্বত সম্বন্ধে কোন রকম রাজনৈতিক উৎসাহ নেই। এতদসত্ত্বেও কার্জন একজন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ রাজনৈতিক আধিকারিকের নেতৃত্বে তিব্বতে একটি অভিযান পরিচালনার ওপর জোর দেন।[৪]:৬৬[৫]:৮০ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী লড়াই করে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে লাসা পৌছয়। ত্রয়োদশ দলাই লামা তিব্বত ছেড়ে প্রথমে মঙ্গোলিয়া ও পরে চীন পালিয়ে গেলেও সহস্রাধিক তিব্বতী তরবারি ও পুরাতন বন্দুক নিয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হন।[৬][৭] লাসা শহরে টিবেট ফ্রন্টিয়ার কমিশন অবশিষ্ট নিম্ন মর্যাদার তিব্বতী আধিকারিকদের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে সিক্কিম প্রত্যাবর্তন করে। এই চুক্তিতে ব্রিটিশরা চিং রাজসভা থেকে বাৎসরিক অর্থের বিনিময়ে তিব্বত অধিগ্রহণ না করার এবং তিব্বতের প্রশাসনে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অপর পক্ষে চীন তিব্বতের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অন্য কোন বিদেশী শক্তির হস্তক্ষপের অনুমতি না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।[৮] অভিযানটিকে ব্রিটিশ ভারত সরকার একটি সামরিক অভিযানের মর্যাদা দান করে এবং যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য পদকের ব্যবস্থা করে।[৪]:৬৮
ব্রিটিশদের তিব্বত অভিযান | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
ব্রিটিশদের সঙ্গে তিব্বতীদের মধ্যস্থতা | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
তিব্বত | |||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
জেমস রোনাল্ড লেসলি ম্যাকডোনাল্ড ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ড | ত্রয়োদশ দলাই লামা | ||||||
শক্তি | |||||||
৩,০০০ সৈন্য[১] ৭,০০০ সহায়ক দল | অজ্ঞাত, | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
২০২ জন নিহত ৪১১ জনের অন্যান্য মৃত্যু | আনুমানিক ২০০০-৩০০০ [২]:২৯৯ |
প্রেক্ষাপট
সম্পাদনাব্রিটিশদের সঙ্গে তিব্বতীদের দ্বন্দ্বের কারণটি স্পষ্ট নয়, বস্তুতঃ বহুলাংশে ভিত্তিহীন।[২]:১ কলকাতায় অবস্থিত ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে একটি উড়ো খবর ছড়িয়ে পড়ে যে চীনারা তিব্বতকে রুশদেরকে সমর্পণ করতে চলেছে, যারফলে রুশ ও ব্রিটিশ ভারত সাম্রাজ্যের মধ্যেকার আধা-স্বায়ত্ত্বশাসিত রাষ্ট্রগুলির অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে একটি যোগাযোগ স্থাপিত হতে চলেছে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ দলাই লামার প্রিয়পাত্র আগভান দোর্জিয়েভের পৃষ্ঠপোষকতায় লাসা শহরে আগত রুশ অভিযাত্রী গোম্বোজাব সাইবিকভের উপস্থিতি এই উড়ো খবরে ইন্ধন যোগায়। দলাই লামা ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে কোন রকম কূটনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপনে অনীহা প্রকাশ করে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে আগভান দোর্জিয়েভকে দূত হিসেবে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রেরণ করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুশদের সমর্থনের অনুরোধ জানান।[৯]
এই সকল ঘটনার ফলশ্রুতিতে ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড কার্জনের বিশ্বাস দৃঢ় করে যে, দলাই লামা তিব্বতকে তার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে রুশ প্রভাবাধীন অঞ্চলে পরিণত করতে চাইছেন।[২]:২ ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে কার্জন চীন ও তিব্বত সরকারকে সিক্কিমের উত্তরে খাম্স-পা-র্দ্জোং (ওয়াইলি: khams pa rdzong) নামক একটি স্থানে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক মধ্যস্থতার জন্য আমন্ত্রণ জানান। চিং সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ দলাই লামাকে এই সভায় যেতে বলা হলে দলাই লামা শুধু তা প্রত্যাখ্যান করেন তাই নয়, তিব্বতে চিং সাম্রাজ্যের রাজপ্রতিনিধি আম্বান ইয়ু তাইয়ের পরিবহনের ব্যবস্থা করতেও অরাজী হন। কার্জন এই ঘটনা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে তিব্বত সরকারের ওপর চীনের কোন রকম কর্তৃত্ব নেই। তিনি কর্ণেল ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ডের নেতৃত্বে টিবেট ফ্রন্টিয়ার কমিশন নামক একটি সামরিক কমিশনকে খাম্স-পা-র্দ্জোং পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।[৫]:৮০
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে জুলাই ইয়ংহাজব্যান্ড সিক্কিমের রাজধানী গ্যাংটক পৌঁছে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে দেন।[১০] আগস্ট মাস থেকে তিনি ও তার সেনাপতি লেফট্যানেন্ট কর্ণেল হার্বার্ট ব্র্যান্ডার তিব্বতীতে লড়াইয়ে নামতে উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন[২]:২৮ এবং ডিসেম্বর মাসে তিব্বতীদের শত্রুভাবাপন্নতার অজুহাতে তিব্বতে প্রবেশ করেন।[২]:৩১ আক্রমণকারী ব্রিটিশ সৈন্যে তিন হাজার গুর্খা ও পাঠান সৈনিক এবং সাত হাজার শেরপা, কুলি ও সহায়ক দল ছিল এবং তেইশতম শিখ পায়োনিয়র্সের ৬টি কোম্পানি ও অষ্টম গুর্খার চারটি কোম্পানিকে গ্যাংটক শহরে এবং দুইটি গুর্খা কোম্পানিকে খাম্স-পা-র্দ্জোং অঞ্চলে রেখে দেওয়া হয়েছিল। ইয়াদং অঞ্চলে উপস্থত তিব্বতী সেনাপতি এই অভিযান সম্বন্ধে অবহিত হয়ে ব্রিটিশদের নিকট বার্তা পাঠায় যে, ব্রিটিশরা তিব্বতীদের আক্রমণ না করলে তিব্বতীরা ব্রিটিশ সৈন্যকে আক্রমণ করবে না। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর এই বার্তার শর্ত মেনে নেন। কিন্তু এরপর ব্রিটিশদের সঙ্গে কোন চীনা বা তিব্বতী আধিকারিক সাক্ষাত না করায় ইয়ংহাজব্যান্ড ১১৫০ সৈন্য ও সহায়ক দল নিয়ে ৫০ মাইল অগ্রসর হয়ে টুনা নামক স্থানে অগ্রসর হয়ে কয়েক মাস অবস্থান করে। এরপরেও কোন মধ্যস্থতাকারী তার সঙ্গে সাক্ষাত না করায় ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সৈন্যকে লাসা শহরের দিকে যাত্রা করার আদেশ দেওয়া হয়।[৫]:৮০[১১]
ছুমিক শেনকোর বিপর্যয়
সম্পাদনা১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে মার্চ জেমস রোনাল্ড লেসলি ম্যাকডোনাল্ড দ্বারা প্রেরিত অগ্রসর বাহিনী তিন হাজার তিব্বতী সেনার সম্মুখীন হয়। তিব্বতীরা ৫-ফুট-উচ্চ (১.৫ মি) একটি পাথরের দেওয়ালের পেছনে পুরোনো যুগের ম্যাচলক বন্দুক নিয়ে অবস্থান করে রাস্তা অবরোধ করে থাকেন।[১২]:১৪৬ তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে না চাইলেও রাস্তা ছেড়ে দিতেও রাজী ছিলেন না। ইয়ংহাজব্যান্ড তার সৈন্যদেরকে তিব্বতীদের নিরস্ত্র করে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেন। তিব্বতীদের যুদ্ধ করার জন্য উস্কে দিতে একটি নকল আক্রমণ করা হয়।[১৩][১৪][১৫] এই আক্রমণে তিব্বতী সেনাপতির ছোড়া গুলিতে একজন শিখ সৈনিক আহত হলে ব্রিটিশ সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময় উপস্থিত রয়টার্সের সাংবাদিকের বর্ণনানুসারে তিব্বতীরা এরপর ব্রিটিশদের দিকে এগিয়ে গেলে তিন দিক থেকে ব্রিটিশ সেনা তাদের ম্যাক্সিম বন্দুক দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। একটি উচু দেওয়ালের পেছনে থাকায় কোন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হননি।[২]:১১১-১২০ প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ তিব্বতী নিহত হন এবং ১৬৮ জন আহত হন যাদের মধ্যে ১৪৮ জন ব্রিটিশদের ফিল্ড হাসপাতালে বন্দী হিসেবে চিকিৎসালাভ করে বেঁচে যান। এই লড়াইয়ে মাত্র বারো জন ব্রিটিশ সৈন্য আহত হন।[৫]:৮১
গ্যানৎসের যুদ্ধ
সম্পাদনাএই প্রথম বাধাকে সহজে পার করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এক সপ্তাহ পরে কাংমা অঞ্চলের পরিত্যক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি অধিকার করে ৯ই এপ্রিল একটি পার্বত্য নদী গর্জ পেরোনোর চেষ্টা করে। ম্যাকডোনাল্ড তার গুর্খা সৈন্যদের গর্জটির খাড়া পাহাড়গুলিতে আরোহণ করে ঐ পাহাড়গুলিতে ঘাটি গেঁড়ে থাকা তিব্বতী সৈন্যদের হঠিয়ে দিতে আদেশ করেন। প্রথমদিকে প্রচণ্ড তুষারঝড়ে তাদের সঙ্গে মূল বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও গুর্খারা তিব্বতীদের থেকে উচ্চ স্থানে ঘাটি তৈরী করতে সক্ষম হয়। ওপর থেকে গুর্খা এবং নীচ থেকে শিখ সেনারা আক্রমণ করলে তিব্বতীরা প্রায় দুইশত জন মৃতকে ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অন্যদিকে ব্রিটিশ শিবির হতাহতের সংখ্যা ছিল নগণ্য। তিব্বতী সেনারা গ্যানৎসে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ায় ব্রিটিশরা ১১ই এপ্রিল বাধায় শহর অধিকার করে। শহরের বৌদ্ধবিহারের মূল্যবান মূর্তি ও পুঁথিপত্র ব্রিটিশ সেনা আধিকারিকেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। ব্রিটিশ আধিকারিকেরা চাংলো নামক এক অভিজাতের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পাঁচ দিন পরে ম্যাকডোনাল্ডের আদেশে মূল বাহিনী সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য চুম্বি অঞ্চলে চলে যায়।[২]:১৪৯ ইয়ংহাজব্যান্ড লাসা পৌছোনোর জন্য ব্যগ্র ছিলেন এবং এই মর্মে অনুমতি চেয়ে তিনি লন্ডনে তারবার্তা পাঠান। কিন্তু ছুমিক শেনকোতে তিব্বতীদের বিপর্যয়ের খবর ইংল্যান্ডের জনগণের মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার করেছিল। দ্য স্পেক্টেটর এবং পাঞ্চের মতো বিখ্যাত সংবাদপত্রগুলি আধুনিক প্রযুক্তিবিজ্ঞানের দ্বারা নির্মিত অস্ত্র দ্বারা প্রায় নিরস্ত্র তিব্বতীদের হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রতি তীব্র সমালোচনা করে। এই সময় ইয়ংহাজব্যান্ডের নিকট খবর আসে যে, তিব্বতী সেনা গ্যানৎসে শহর থেকে ৪৫ মাইল পূর্বে কারো গিরিবর্ত্মে জড়ো হয়েছে।[২]:১৫৬ লেফট্যানেন্ট কর্ণেল হার্বার্ট ব্র্যান্ডার ইয়ংহাজব্যান্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে কারো গিরিবর্ত্মে তিব্বতীদের আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তার এই সিদ্ধান্ত যখন চুম্বিতে অবস্থিত ম্যাকডোনাল্ডের নিকট পৌঁছয় তখন তিনি তা রদ করার চেষ্টা করেন কন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।[২]:১৫৭-১৫৯ ৫-৬ই মের এই যুদ্ধে অষ্টম গুর্খা এবং বত্রিশতম শিখ পায়োনিয়র্সের জওয়ানেরা প্রায় ৫৭০০ মিটার উচ্চতার এই গিরিবর্ত্মে আরোহণ করে জয়লাভ করে।[২]:১৭৬ এই একই সময় প্রায় ৮০০ তিব্বতী সেনারা চাংলোর ভবন আক্রমণ করে ১৬৩ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে নিহত করতে সক্ষম হন। কারো গিরিবর্ত্ম থেকে বিজয়ী ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনী ফিরে এসে এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।[২]:১৮৬ এই আক্রমণের পর ব্রিটিশ সরকার লেবং থেকে রয়্যাল ফিউজিলিয়ার্সের প্রথম ব্যাটালিয়ন, চল্লিশতম পাঠান রেজিমেন্টের ছয়টি কোম্পানি এবং রয়্যাল আইরিশ রাইফেলসের একটি কোম্পানিকে তিব্বত প্রেরণ করেন। ২৪শে মে যাত্রা শুরু করে তারা চুম্বিতে ১লা জুন পৌঁছে ম্যাকডোনাল্ডের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়।[২]:১৮৫ ১৮ ও ১৯ শে মে প্রায় চাংলোর ভবনও বৌদ্ধবিহারের মাঝের বাড়িগুলি দখল করার লড়াইয়ে পঞ্চাশজন তিব্বতী নিহত হন। ২১শে মে ব্র্যান্ডারের যোদ্ধারা নাইনি নামে একটি গ্রামে অবস্থিত একটি ছোট তিব্বতী দুর্গ অধিকার করার জন্য যাত্রা করে। ২৪শে মে ক্যাপ্টেন সিমোর শেফার্ড গ্যানৎসে পৌঁছন এবং ২৮শে মে তার নেতৃত্বে একটি আক্রমণে ৪০০ জন তিব্বতী হতাহত হন।[১৬] এরপর ব্র্যান্ডার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার দিকে মনোযোগ দেন। ইয়ংহাজব্যান্ডকে ত্রয়োদশ দলাই লামার সাথে সংযোগ স্থাপনের আদেশ পাঠানো হয়। ২৬শে জুন নাইনি গ্রামের একটি সুরক্ষিত বিহার এবং ২৮শে জুন ৎসেচেন বিহার ও তৎসংলগ্ন দুর্গ অধিকার করে এওয়া হয়। বিহারগুলির প্রাচীন ও বহুমূল্য চিত্রপটগুলি লুঠ করে বিক্রি করে দেওয়া হয়।[২]:২০৯ ৩রা জুলাই ইয়ংহাজব্যান্ড তিব্বতী প্রতিনিধিদের ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে তিব্বতীদের মূল ঘাঁটি গ্যানৎসে শহরের বিহারটি খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিব্বতের সেরা যোদ্ধা ও গোলন্দাজ বাহিনী দ্বারা এই বিহারটির সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশরা নিকটবর্তী প্রাচীন ৎসেচেন বিহারটিতে অগ্নিসঙ্গোগ করে ধ্বংস করে দেয়। ৬ই জুলাই ম্যাকডোনাল্ড তিনটি ভাগে তার সৈন্যদেরকে বিভক্ত করে গ্যানৎসে বিহারের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ পশ্চিম দিকের দেওয়ালে আক্রমণের নির্দেশ দেন। প্রায় এগারো ঘণ্টা পরে দেওয়াল ভেদ করা সম্ভব হয়। এই লড়াইয়ে বেশ কয়েকজন গুর্খা সৈন্যের মৃত্যু হয়, কিন্তু তিব্বতীরা একসময় পিছু হঠতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য লেফট্যানেন্ট জন ডানকান গ্রান্টকে ভিক্টোরিয়া ক্রস পদক দেওয়া হয়।
লাসায় প্রবেশ ও চুক্তি স্বাক্ষর
সম্পাদনা১৪ই জুলাই ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী লাসা শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে। আড়াই মাসের পূর্বের রণভূমি কারো গিরিবর্ত্ম পার করার সময় গুর্খা সিপাহীদের সঙ্গে একদল তিব্বতী যোদ্ধার লড়াই ঘটে, কিন্তু তিব্বতীরা পিছু হটতে বাধ্য হলে তারা যাত্রাপথের সমস্ত গ্রামগুলিকে খালি করে খাবার ও গৃহপালিত পশু সরিয়ে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী য়ার-'ব্রোগ-গ্যু-ম্ত্শো (ওয়াইলি: yar-'brog g.yu-mtsho) হ্রদ পেরিয়ে নাকার্তসের দুর্গে উপস্থিত হলে লাসা থেকে একদল প্রতিনিধিদল মধ্যস্থতা করতে আসেন। ম্যাকডোনাল্ড এই মধ্যস্থতায় রাজী থাকলেও ইয়ংহাজব্যান্ড লাসায় মধ্যস্থতা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ৩রা আগস্ট তারা লাসা পৌঁছে খবর পান যে, ত্রয়োদশ দলাই লামা শহর ছেড়ে মঙ্গোলিয়া পলায়ন করেছেন। আম্বান ইয়ু তাই ব্রিটিশদের শহরে নিয়ে যান, কিন্তু তাদের জানান যে, তাকে মধ্যস্থতা করার কোন রকম অধিকার দেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে তিব্বত সরকারের মন্ত্রিপরিষদ মধ্যস্থতা করার জন্য নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ইয়ংহাজব্যান্ড স্বয়ং চুক্তিপত্র রচনা করেন এবং ৪ঠা সেপ্টেম্বর তিব্বতের রাজপ্রতিনিধি ব্লো-ব্জাং-র্গ্যাল-ম্ত্শান (ওয়াইলি: blo bzang rgyal mtshan) ও জাতীয় পরিষদ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।[২]:২৮৪
এই চুক্তি অনুসারে ব্রিটিশরা ইয়াদং, গ্যানৎসে ও গার্তোক অঞ্চলে বাণিজ্য করার অনুমতি লাভ করে, তিব্বত ও সিক্কিমের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়, তিব্বত সরকার প্রায় ৭,৫০০,০০০ টাকার সমপরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকে এবং তিব্বতের সঙ্গে অন্যান্য বৈদেশিক শক্তির সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়। ক্ষতিপূরণ লাভ না করা পর্যন্ত চুম্বি উপত্যকা ব্রিটিশদের শাসনাধীনে থাকার কথাও বলা হয়।[৫]:৮২ তিব্বতীদের পক্ষে বিশাল আর্থিক ক্ষতিপূরণ একটি কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে দরিদ্র তিব্বতীতের সামর্থ্যানুযায়ী ক্ষতিপূরণের কথা বলা হলেও ইয়ংহাজব্যান্ড নিজেই এই অঙ্ক অনেকটা বাড়িয়ে দেন। লাসা শহরে প্রবেশ করে তিব্বত সরকারকে রাজনৈতিক উপদেশ দেওয়ার অধিকার থাকবে, গ্যানৎসে শহরে এরূপ একটি ব্রিটিশ বাণিজ্য দপ্তর খোলার দাবীও তিনি করেন। ১৯০৪ থেকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গ্যানৎসে শহরে একটি ব্রিটিশ বাণিজ্য দপ্তর চালু থাকে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে লাসা শহরে এই দপ্তর থেকে একটি স্থায়ী পদ সৃষ্টি করা হয়।[১৭]:২৩০,২৩১ ইয়ংহাজব্যান্ড ৭৫ বছর ধরে বার্ষিক অর্থ শোধের কথা বলে চুম্বি উপত্যকাকে সমপরিমাণ সময় ব্রিটিশদের অধীনস্থ করার ব্যবস্থা করেন।[২]:২৮৪ কিন্তু আম্বান ইয়ু তাই সর্বসমক্ষে এই চুক্তির বিরোধিতা করলে ব্রিটিশরা তিব্বতের ওপর চীনের অধিকার স্বীকার করে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেওয়া হয়।
ফলাফল
সম্পাদনাব্রিটিশদের শর্তপূরণ করা তিব্বতীদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। তাদের সঙ্গে কোন বৈদেশিক বাণিজ্যব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। উপরন্তু ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশদের সঙ্গে চিং রাজবংশের চুক্তির দ্বারা ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতীদের সঙ্গে চুক্তির শর্তপূরণ নিশ্চিত করা হয়। এই চুক্তি অনুসারে চিং রাজসভা থেকে অর্থলাভের বিনিময়ে তিব্বতের প্রশাসনে হস্তক্ষেপ না করা ও তিব্বতের অংশ অধিকার না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অপরদিকে চিং সাম্রাজ্য তিব্বতের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে অন্য বৈদেশিক শক্তিকে হস্তক্ষেপ করার অনুমতি না দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।[২]:২৮৮[৮]
ব্রিটিশদের এই অভিযান ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের তিব্বতী বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়। এই বিদ্রোহের ফলে বিদেশী বিরোধী তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ফরাসী মিশনারি, মাঞ্চু ও চিং আধিকারিক এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ওপর চড়াও হয়।[১৮][১৯] ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে চিং সাম্রাজ্য তিব্বতে নিজেদের শাসন কায়েম করার জন্য সামরিক অভিযান প্রেরণ করে। যদিও ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চীনা সৈন্য তিব্বত থেকে সরে যায়, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লব সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত তিব্বতকে পশ্চিমী দুনিয়া থেকে পৃথক করে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Raugh, Harold E.; Raugh, Harold E. (২০০৪)। The Victorians at War, 1815-1914: An Encyclopedia of British Military History (ইংরেজি ভাষায়)। ABC-CLIO। আইএসবিএন 978-1-57607-925-6।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ Charles Allen (2004) Duel in the Snows:The True Story of the Younghusband Mission to Lhasa ; J.Murray
- ↑ Landon, P. (1905). The Opening of Tibet Doubleday, Page & Co., New York.
- ↑ ক খ Charles Bell (১৯৯২)। Tibet Past and Present। CUP Motilal Banarsidass Publ.। আইএসবিএন 81-208-1048-1। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৭-১৭।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ John Powers (2004) History as Propaganda: Tibetan exiles versus the People's Republic of China. Oxford University Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৫১৭৪২৬-৭
- ↑ Wang Jiawei; Nima Tenzan (১৯৯৭)। The Historical Status of Tibet in China (চীনা ভাষায়)। Wuzhou Communication Press। পৃষ্ঠা ৭৮। আইএসবিএন 978-7-80113-303-8।
- ↑ Shakabpa, Tsepon Wangchuk Deden (২০১০)। One Hundred Thousand Moons: An Advanced Political History of Tibet (ইংরেজি ভাষায়)। BRILL। আইএসবিএন 978-90-04-17732-1।
- ↑ ক খ "Convention Between Great Britain and China Respecting Tibet (1906)"। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ আগস্ট ২০০৯।
- ↑ "Britain's Two Armed Invasions of Tibet"। web.archive.org। ২০১৪-০২-০২। Archived from the original on ২০১৪-০২-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৫।
- ↑ French, Patrick (২০১৬-০৬-২১)। Younghusband: The Last Great Imperial Adventurer (ইংরেজি ভাষায়)। Knopf Doubleday Publishing Group। আইএসবিএন 978-1-101-97335-6।
- ↑ Goldstein, Melvyn C.; Rimpoche, Gelek (১৯৮৯)। A History of Modern Tibet, 1913-1951: The Demise of the Lamaist State (ইংরেজি ভাষায়)। University of California Press। পৃষ্ঠা ৭২। আইএসবিএন 978-0-520-06140-8।
- ↑ Fleming, Peter (1961) Bayonets to Lhasa London: Rupert Hart-Davis (reprinted by Oxford U.P., Hong Kong, 1984, আইএসবিএন ০-১৯-৫৮৩৮৬২-৯)
- ↑ Infantry Journal (ইংরেজি ভাষায়)। United States Infantry Association.। ১৯০৫।
- ↑ Fleming, Peter (২০১২-০৭-০৩)। Bayonets to Lhasa: The British Invasion of Tibet (ইংরেজি ভাষায়)। Bloomsbury USA। আইএসবিএন 978-1-84885-698-1।
- ↑ Allen, Charles (২০১৫-১১-১৯)। Duel in the Snows (ইংরেজি ভাষায়)। John Murray Press। আইএসবিএন 978-1-4736-2754-3।
- ↑ India. Army. Intelligence Branch; Paget, William Henry Record of the expeditions against the North-west frontier tribes (১৯০৭)। Frontier and overseas expeditions from India। University of California Libraries। Simla : Govt. Monotype Press।
- ↑ McKay, Alex (1997). Tibet and the British Raj: The Frontier Cadre 1904–1947. London: Curzon. আইএসবিএন ০-৭০০৭-০৬২৭-৫.
- ↑ Bray, John (২০১১)। "Sacred Words and Earthly Powers: Christian Missionary Engagement with Tibet"। The Transactions of the Asiatic Society of Japan। fifth series। Tokyo: John Bray & The Asian Society of Japan (3): 93–118। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুলাই ২০১৪।
- ↑ Tuttle, Gray (২০০৫)। Tibetan Buddhists in the Making of Modern China (illustrated, reprint সংস্করণ)। Columbia University Press। পৃষ্ঠা 45। আইএসবিএন 0231134460। সংগ্রহের তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০১৪।
আরো পড়ুন
সম্পাদনা- Candler, Edmund (1905) The Unveiling of Lhasa. New York; London: Longmans, Green, & Co; E. Arnold
- Carrington, Michael (2003) "Officers, Gentlemen and Thieves: the looting of monasteries during the 1903/4 Younghusband Mission to Tibet", in: Modern Asian Studies; 37, 1 (2003), pp. 81–109
- Patrick French (1994) Younghusband: the Last Great Imperial Adventurer. London: HarperCollins আইএসবিএন ০-০০-৬৩৭৬০১-০
- Herbert, Edwin (2003) Small Wars and Skirmishes, 1902-18: early twentieth-century colonial campaigns in Africa, Asia, and the Americas. Nottingham: Foundry Books আইএসবিএন ১-৯০১৫৪৩-০৫-৬
- Hopkirk, Peter (1990) The Great Game: on secret service in high Asia. London: Murray (Reprinted by Kodansha International, New York, 1992 আইএসবিএন ১-৫৬৮৩৬-০২২-৩; as: The Great Game: the struggle for empire in central Asia)
- Gordon T. Stewart (2009) Journeys to Empire . Enlightenment, Imperialism, and the British Encounter with Tibet 1774 - 1904, Cambridge University Press, Cambridge আইএসবিএন ৯৭৮-০-৫২১-৭৩৫৬৮-১
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- "নং. 27743"। দ্যা লন্ডন গেজেট (সম্পূরক) (ইংরেজি ভাষায়): 8529–8536। ১৩ ডিসেম্বর ১৯০৪। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০০৮। Macdonald's official report