ব্যুত্থান (অর্থ ‘স্বতন্ত্রের সাথে প্রতিরোধ’ অথবা ‘উত্থান লাভ করা’) একটি বাংলাদেশী মার্শাল আর্ট এবং কমব্যাট স্পোর্টস। এটি 'আত্মরক্ষা ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের পদ্ধতিগত কলাকৌশল' যার শেকড় দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্যে প্রোথিত।[১] সুপারহিউম্যান ম্যাক ইউরী, একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মার্শাল আর্ট গ্র্যান্ড মাস্টার ও ‘ব্যুত্থানের’ স্থপতি। ব্যুত্থানকে বলা হয় সংঘাত রহিতকরণ ও জীবন ক্ষমতায়নের পথ যা শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক ভারসাম্য তৈরি করে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশের একটি জাতীয় ক্রীড়া হিসেবে ব্যুত্থান অনুমোদন লাভ করে। আন্তর্জাতিক ব্যুত্থান ফেডারেশনের নির্দেশনায় এই মার্শাল আর্ট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি কমব্যাট স্পোর্টস হিসেবে অনুশীলিত হয়ে আসছে।[২]

ব্যুত্থান
ব্যুত্থান মার্শাল আর্টের লোগো
লক্ষ্যসঙ্কর
কঠোরতাদৃঢ় ও নমনীয়তার সম্মিলন
উৎপত্তির দেশবাংলাদেশ বাংলাদেশ
উদ্ভাবকম্যাক ইউরী
পূর্ববর্তী আর্টবর্মা কালাই, বান্দো, বজ্র-মুষ্টি, চৈনিক মার্শাল আর্ট
দাপ্তরিক ওয়েবসাইটআন্তর্জাতিক ব্যুত্থান ফেডারেশন

ইতিহাস সম্পাদনা

ব্যুত্থান মূলত একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ‘স্বতন্ত্রের সাথে প্রতিরোধ’ অথবা ‘উত্থান লাভ করা ‘। দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য ভিত্তিক একটি মার্শাল আর্ট হিসেবে ব্যুত্থানের গোড়াপত্তন করেন গ্র্যান্ড মাস্টার ম্যাক ইউরি। পশুপতি শিলাচিত্র, যা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন মনোদৈহিক প্রশিক্ষণের প্রমাণ,আবিষ্কৃত হয়েছে মহেঞ্জোদাড়োর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে।[৩][৪]

ঐতিহাসিক ভাবে ভারত উপমহাদেশ হচ্ছে আত্মরক্ষার প্রাচীনতম পদ্ধতিগত কৌশল তথা মার্শাল আর্টের উৎপত্তি স্থল। ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু বোধিধরমা ৫২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কাঞ্চিপুরাম থেকে চীনের শাওলিন টেম্পলে গমন করেন । পরবর্তীতে এই পদ্ধতিগত আত্ম রক্ষার কলাকৌশলগুলো উৎকর্ষ লাভ করে শাওলিন টেম্পলে। অতঃপর তিনি সেখানকার ভিক্ষুদের কাছে সমৃদ্ধ মনো দৈহিক প্রশিক্ষণ উপস্থাপন করেন যা মানবদেহের সকল অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গসমূহকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক হাজার বছরের মাঝে সিন্ধু সভ্যতার মার্শাল আর্টের প্রসারমান শিল্প কালক্রমে তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পরে এসেছেন বিশ্ব রেকর্ডধারী সুপারহিউম্যান গ্র্যান্ড মাস্টার আচার্য ইউরি বজ্রমুনি। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যুত্থানের গৌরবময় পতাকা উত্তোলন পূর্বক বিশ্বব্যপি মার্শাল আর্টের হারানো ঐতিহ্য পুনুরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।[৫] বাংলাদেশের রাজশাহীতে ১৯৮১ সালে ব্যুত্থানের পথচলা শুরু হয় । ১৮৮৫ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজে ম্যাক ইউরির নির্দেশনায় ব্যুত্থানের প্রথম জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ম্যাক ইউরির চল্লিশ ধরনের বিভিন্ন মার্শাল আর্টে দক্ষতা অর্জন এবং উন্নয়নমূলক গবেষণার মাধ্যমে ব্যুত্থান বিবর্তিত হয়েছে। ব্যুত্থান বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন ও অনুশীলনের দ্বারা প্রসার লাভ করে। ১৯৯০ সালের শুরুতে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেমন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব, কোস্ট গার্ড, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যুত্থানকে গ্রহণ করে। ১৯৯১ সালে বার্মিজ গ্র্যান্ড মাস্টার খিং মং জি তাকে ঢাকায় বার্মিজ মার্শাল আর্ট বানডোর একটি ঐতিহ্য ভিত্তিক প্রমাণপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী মার্শাল আর্টিস্টদের দ্বারা ব্যুত্থান প্রদর্শিত হয় এবং দেশের তৎকালীন শীর্ষ প্রচারমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়। ১৯৯২ সালে আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা ফ্রাঙ্ক হোয়াইট ব্যুত্থান কে বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরে প্রসারের উদ্যোগ নেন।[৬]

১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সকল ক্যাডেট কলেজগুলিতে শারীরিক শিক্ষার অংশ হিসেবে ব্যুত্থান বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যুক্ত হয়। আমেরিকার টেক্সাসে অবস্থিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাকাডেমির (এন এস এ) একজন প্রশিক্ষক অ্যান্ডি স্কট ব্যুত্থান কে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারে সহযোগিতা করেন। ব্যুত্থানকে সারা পৃথিবীব্যপি পরিচিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টোনে ওয়ার্ল্ড ব্যুত্থান ফেডারেশন গঠিত হয়। ২০০২ সালে ইংল্যান্ডে ব্যুত্থানের প্রশিক্ষক এবং পরামর্শকগণের উপস্থিতিতে এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে 'ইন্টারন্যাশনাল ব্যুত্থান ফেডারেশন’ করা হয়। 'ইন্টারন্যাশনাল ব্যুত্থান ফেডারেশন’ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে মার্শাল আর্ট প্রচার করে থাকে। ২০০৪ সালে মায়ানমারের থাইং ফেডারেশন দেশের ৩২ জন গ্র্যান্ড মাস্টারের উপস্থিতিতে ব্যুত্থানের স্থপতি ম্যাক ইউরির সম্মানে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মায়ানমার ব্যুত্থানের বিশ্বব্যপি প্রচারণার সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করে।

ব্যুত্থান প্রচারের উদ্দেশ্যে ম্যাক ইউরী ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের সুইনডন শহরে গমন করেন। সুইনডনের তৎকালীন মেয়র স্টিভ ওয়াক ফিল্ড ব্যুত্থানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ব্যুত্থান প্রচারে সহযোগিতা করেন। ২০০৭ সালে ‘ওয়ার্ল্ড মার্শাল আর্ট হল অফ ফেইম‘ ম্যাক ইউরিকে ‘গ্র্যান্ড মাস্টার অব দ্য ইয়ার’ পদকে ভূষিত করে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মার্শাল আর্ট বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘কমব্যাট‘ ম্যাক ইউরিকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপায়, যার ফলে মার্শাল আর্ট জগতে ব্যুত্থান বিশ্বব্যপি পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে এই ম্যাগাজিন এর সম্পাদক পল ক্লিফটন ব্যুত্থানের প্রচার ও প্রসারে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। উপরন্তু, সুইনডন শহরস্থ ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ডেরেক মনটাতে, যুক্তরাজ্যে ব্যুত্থান প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২০১০ সালে বারমিংহ্যাম, ইংল্যান্ডের এ অবস্থিত ন্যাশনাল এক্সহিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মার্শাল আর্ট এক্সহিবিশনে ইন্টারন্যাশনাল ব্যুত্থান ফেডারেশন প্রচারণা স্টল স্থাপনের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশের একটি জাতীয় ক্রীড়া হিসেবে ব্যুত্থান অনুমোদন লাভ করে। ২০১৫ সালে 'মার্শাল আর্ট ইলাসট্রেটর' ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ কাহিনী হিসেবে ব্যুত্থানকে ঘিরে বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশ করে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে ব্রনেই দারুস সালামের সরকার তাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে অনুশীলনের জন্য ক্রীড়া হিসেবে ব্যুত্থানকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দেয়।[৭]

ব্যুত্থান দর্শন ও চালচিত্র সম্পাদনা

ব্যুত্থান, যা দক্ষিণ এশিয়ার মার্শাল আর্টের একটি রূপ, ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং আত্মরক্ষার কলাকৌশলের একটি আধুনিক ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি। ব্যুত্থান মার্শাল আর্ট অনুশীলন একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, আবেগিক এবং আধ্যাত্মিক ভারসাম্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে একজন অনুসারীকে আত্মউত্তীর্ণ হতে শেখায়। ব্যুত্থান প্রণীত যুগান্তকারী ‘সহ -প্রতিযোগিতা’ পদ্ধতি অ-আক্রমনাত্মক এবং সহযোগিতা ভিত্তিক মনোভাব সমৃদ্ধ শক্তিশালী পথের দিশা প্রদর্শন করে। এই খেলাটি মূলত সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং ইতিবাচক প্রেরণার উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যুত্থান ক্রীড়াটি গভীরভাবে গুরুত্ব প্রদান করে মনোসংযোগ প্রশিক্ষণ ও সচেতনভাবে মনের নির্দেশ অনুসরণে মাংস পেশী তথা দৈহিক কার্যক্রম পরিচালনার উপর। ফলে তা সুচারুরূপে শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। একে ব্যুত্থানের ভাষায় বলা হয় 'মনচালা পদ্ধতি'।[৮]

আত্মশৃঙ্খলা এবং ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাসকে প্রায়োগিক পুনঃবিন্যাসের মাধ্যমে ব্যুত্থান মার্শাল আর্ট অনুশীলন একই সঙ্গে বা সল্পসময়ে সর্বোত্তম ফলাফল আনতে মনের সচেতন নির্দেশনার মাধ্যমে দৈহিক ক্রিয়া সংঘটিত করে। একে ভাজশোধন বলে। প্রতিযোগীদের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতার মান সমানভাবে নিশ্চিত করার জন্য ব্যুত্থান চমৎকারভাবে প্রতিযোগিতার নিয়ম হিসেবে একটি অনন্য মনোস্তাত্তিক পরীক্ষা যুক্ত করেছে। একে ‘ঝলক খেলা’ বলা হয়। ব্যুত্থান পদ্ধতির ভেতর রয়েছে মনোবিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতি, মানবশরীর বিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, স্নায়ুতন্ত্র, বজ্র প্রাণ, সিদ্ধা চিকিৎসা বিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞান যা নির্বাচিত আত্মরক্ষার কৌশলের সাথে মিশ্রিত। ব্যুত্থান বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন শিল্প যেমন বান্ডো, বজ্রমুষ্টি, ভারমা কালাই, তিব্বতিয় এবং চাইনিজ কেম্প, মিন জিং, বানশে, লাঠি খেলা এবং আরও কিছু প্রাচীন ভারতীয় বার্মিজ ও তিব্বতীয় খালি হাত ও অস্ত্রবিদ্যার সমন্বয়ে গঠিত।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. জাতীয়-ব্যুত্থান-সমাপ্ত ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে, ব্যুত্থান প্রতিযোগিতা, বাংলা ট্রিবিউন। বাংলা ট্রিবিউন থেকে প্রকাশের তারিখ: ২৬-১২-২০১৫ খ্রিস্টাব্দ।
  2. ব্যুত্থান,জাতীয়-ব্যুত্থান-প্রতিযোগিতা-সমাপ্ত,। প্রথম আলো থেকে প্রকাশের তারিখ: ২৭-১২-২০১৫ খ্রিস্টাব্দ।
  3. "The Thundershin Man: In Conversation with Martial Arts and Security Expert Mak Yuree"দ্য ডেইলি স্টার। ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ মে ২০, ২০২০ 
  4. "How ancient is yoga? Seals recovered from Indus valley civilisation sites tell a fascinating story"টাইমস অফ ইন্ডিয়া। জুন ২১, ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০২০ 
  5. ব্যুত্থান ঐতিহ্য শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে,ব্যুত্থান ঐতিহ্য শীর্ষক সেমিনার,। দি রিপোর্ট ২৪ থেকে প্রকাশের তারিখ: ১১-৬-২০১৫ খ্রিস্টাব্দ।
  6. "Bangladeshi martial artist Mak Yuree on Ripley's Believe It Or Not"Daily Star। মার্চ ৮, ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০২০ 
  7. "Brunei Butthan becomes member of Int'l Butthan Fed"দ্য ডেইলি অবজারভার। মে ১২, ২০১৮। জুন ৩, ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ২০, ২০২০ 
  8. "Butthan – The noble art of self-defense and personal development"Borneo Bulletin। সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৯। জানুয়ারি ১২, ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ২০, ২০২০ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা