গ্রহের সংজ্ঞা
গ্রহের সংজ্ঞা এই শব্দযুগলটি প্রাচীন গ্রীকদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল, যা মহাবিশ্বে অবস্থিত বিভিন্ন মহাকাশীয় বস্তুদের মধ্যে কাদের গ্রহ বলা যাবে তা বিস্তৃত পরিসরে ব্যাখ্যা করেছে।
গ্রহ এর নির্দিষ্ট সংজ্ঞা কী হবে, তা উনিশ শতকেও অনির্দিষ্ট ছিল। তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে, ১৯৯২ এর পর, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নেপচুনের কক্ষপথের পর অন্যান্য আবর্তিত শত শত বস্তু আবিষ্কার করতে শুরু করলেন। এই আবিষ্কারগুলি শুধুমাত্র সম্ভাব্য গ্রহগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করেনি, তবে তাদের বৈচিত্র্য এবং বিশেষত্বগুলিও বিস্তৃত করেছে। কিছু কিছু প্রায় বিভিন্ন তারার ন্যায় বড় ছিল, আবার কিছু কিছু পৃথিবীর চাঁদের চেয়েও ক্ষুদ্র ছিল। এই আবিষ্কারগুলি "কোনও গ্রহের সংজ্ঞা কেমন হতে পারে?" এ সম্পর্কে চলে আসা দীর্ঘদিনের ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে।
২০০৫ সালে নেপচুন-পরবর্তী মহাকাশীয় বস্তু "এরিস" আবিষ্কৃত হওয়ার পর গ্রহের সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। এরিস তখন স্বীকৃত গ্রহ প্লুটোর চেয়ে আকৃতিতে বড় ছিল।ফলশ্রুতিতে, ২০০৬ সালের আগস্টে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (আইএইউ),প্রাগ শহরে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে। এই সংজ্ঞাটি কেবল সৌরজগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সংজ্ঞা অনুসারে, গ্রহ হলো এমন একটি মহাকাশীয় বস্তু যা সূর্যকে ঘিরে আবর্তন করে, এটি তার নিজস্ব মহাকর্ষ বলের জন্য গোলাকৃতি ধারণ করে এবং তার কক্ষপথে অন্য কোনো ছোট মহাকাশীয় বস্তুর অবস্থান থাকবে না। এই নতুন সংজ্ঞা অনুসারে, প্লুটো এবং অন্যান্য নেপচুন-পরবর্তী মহাকাশীয় বস্তুগুলি গ্রহ হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে না। আইএইউর সিদ্ধান্ত সকল বিতর্ককে সমাধান করেনি, এবং যদিও বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এই সংজ্ঞাটি গ্রহণ করেছেন, তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কিছু সম্প্রদায় এটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আইএইউ এর সংজ্ঞা
সম্পাদনাএরিসের আবিষ্কার আইএইউকে গ্রহের একটি কার্যকর সংজ্ঞা নিয়ে কাজ করার জন্য বাধ্য করে। ২০০৫ সালের অক্টোবরে, ১৯ আইএইউ সদস্যদের একটি দল, যা ২০০৩ সালে সেডনা আবিষ্কারের পর থেকেই একটি সংজ্ঞা নিয়ে কাজ করছিল, ভোটের মাধ্যমে তাদের শর্তগুলি নির্ধারিত করেছিল। সংজ্ঞাটি ছিল:
- একটি গ্রহের কক্ষপথের ব্যাস (সূর্যকে কেন্দ্র করে) ২০০০ কিলোমিটারের বেশি। (পক্ষে এগারো ভোট)
- একটি গ্রহ সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণরত মহাকাশীয় বস্তু যার আকৃতি নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে স্থিতিশীল। (পক্ষে আট ভোট)
- একটি গ্রহ সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণরত মহাকাশীয় বস্তু যা তার কক্ষপথে প্রভাবশালী। (পক্ষে ছয় ভোট)[১][২]
আইএইউ কমিটি ২০০৬ এর আগস্টে প্রাগে তাদের সাধারণ পরিষদের সভায় এই সংজ্ঞাগুলিকে কার্যকর করার জন্য ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।[৩] এবং আগস্টের ২৪ তারিখে, আইএইউ একটি চূড়ান্ত খসড়া নির্ধারণ করে। এটি মূলত গ্রহ এবং শিলা এর মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট পার্থক্যসূচক শ্রেণিবিভাগ তৈরি করে। এছাড়াও খসড়াটি বামন গ্রহ এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে, এবং প্লুটো, এরিস ও সেরেসকে উক্ত তালিকার মধ্যে স্থান দেয়।[৪][৫] ভোটটি পাস করা হয়েছিল, এবং ৪২৪ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভোটটিতে অংশ নিয়েছিলেন[৬][৭][৮]।
“ | আইএইউ উক্ত ভোটে নির্ধারিত সংজ্ঞার মাধ্যমে আমাদের সৌরজগৎে অবস্থিত মহাকাশীয় বস্তুদেরকে(স্যাটেলাইট ব্যতীত) তিনটি বিস্তীর্ণ শ্রেণিতে নিন্মলিখিত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভক্ত করা হয়েছেঃ
পাদটীকাঃ
আইএইউ ইহাও মীমাংসা করে যেঃ "প্লুটো" আর "গ্রহ" হিসেবে স্বীকৃত হবে না, বরং তা "বামন গ্রহ" হিসেবে স্বীকৃত হবে। |
” |
আইএইউ ইহাও মীমাংসা করে যে "গ্রহ এবং বামন গ্রহ দুটি স্বতন্ত্র শ্রেণী ", যার অর্থ বামন গ্রহগুলি তাদের নামে গ্রহ থাকা সত্ত্বেও গ্রহ হিসাবে বিবেচিত হবে না।[৯]
আইএইউ স্বীকৃত গ্রহসমূহ
সম্পাদনাআইএইউ তার নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুসারে আটটি মহাকাশীয় বস্তুকে "গ্রহ" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গ্রহগুলো হলোঃ
নং | গ্রহের নাম (সূর্য থেকে অবস্থান অনুসারে) | সূর্য হতে দূরুত্ব | ভর | পৃষ্ঠতল | ব্যাসার্ধ | উপগ্রহের সংখ্যা | আবর্তনকাল |
---|---|---|---|---|---|---|---|
১. | বুধ | ৫৭.৯১ মিলিয়ন কি.মি | ৩.২৮৫×১০২৩ কেজি | ৭৪.৮ মিলিয়ন কি.মি২ | ২,৪৩৯.৭ কি.মি | ০ টি | ৮৮ দিন |
২. | শুক্র | ১০৮.২ মিলিয়ন কি.মি | ৪.৮৬৭×১০২৪ কেজি | ৪৬০.২ মিলিয়ন কি.মি২ | ৬,০৫১.৮ কি.মি | ০ টি | ২২৫ দিন |
৩. | পৃথিবী | ১৪৯.৬ মিলিয়ন কি.মি | ৫.৯৭২ × ১০২৪ কেজি | ৫১০.১ মিলিয়ন কি.মি২ | ৬,৩৭১ কি.মি | ১ টি | ৩৬৫ দিন |
৪. | মঙ্গল | ২২৭.৯ মিলিয়ন কি.মি | ৬.৩৯×১০২৩ কেজি | ১৪৪.৮ মিলিয়ন কি.মি২ | ৩,৩৮৯.৫ কি.মি | ২ টি | ৬৮৭ দিন |
৫. | বৃহস্পতি | ৭৭৮.৫ মিলিয়ন কি.মি | ১.৮৯৮×১০২৭ কেজি | ৬১.৪২ বিলিয়ন কি.মি২ | ৬৯,৯১১ কি.মি | ৬৭ টি | ১২ বছর |
৬. | শনি | ১.৪৩৪ বিলিয়ন কি.মি | ৫.৬৮৩×১০২৬ কেজি | ৪২.৭ বিলিয়ন কি.মি২ | ৫৮,২৩২ কি.মি | ৬২ টি | ২৯ বছর |
৭. | ইউরেনাস | ২.৮৭১ বিলিয়ন কি.মি | ৮.৬৮১×১০২৫ কেজি | ৮.০৮৩ বিলিয়ন কি.মি২ | ২৫,৩৬২ কি.মি | ২৭ টি | ৮৪ বছর |
৮. | নেপচুন | ৪.৪৯৫ বিলিয়ন কি.মি | ১.০২৪×১০২৬ কেজি | ৭.৬১৮ বিলিয়ন কি.মি২ | ২৪,৬২২ কি.মি | ১৪ টি | ১৬৫ বছর |
পৃথিবী
সম্পাদনাআমাদের মাতৃগ্রহ "পৃথিবী" নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি তার পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতীয় মডেল নিয়ে আসেন, যার মূল প্রতিপাদ্য হলো, "পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য, অন্যান্য গ্রহ এবং অন্য সকল মহাকাশীয় বস্তু ঘুরছে"। কিন্তু এই মডেলে প্রচুর ভুল ছিল, যার ফলে তৎকালীন বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ মিলাতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে কোর্পানিকাস তার সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতীয় মডেল প্রস্তাব করেন, যার মূল প্রতিপাদ্য হলো, "সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী, অন্যান্য গ্রহ এবং অন্য সকল মহাকাশীয় বস্তু ঘুরছে"। এই মডেলই পরবর্তীকালে গৃহীত হয়, এবং বিজ্ঞানীরা এই মডেলের সাহায্যে হিসাব-নিকাশ করে সফলতা পান। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে মহাকাশযান পাঠিয়ে এই মডেলের সত্যতা প্রমাণ করেন।
আইএইউ এর নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, পৃথিবী একটি "গ্রহ" হিসেবে স্বীকৃত। কারণ পৃথিবী (ক) সূর্যের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথের মধ্যে পরিভ্রমণ করে, (খ) যথেষ্ট ভর রয়েছে যাতে এটি নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে একটি হাইড্রোস্ট্যাটিক ভারসাম্য (প্রায় বৃত্তাকার) আকৃতি ধারণ করে, এবং (গ) তার কক্ষপথের চারপাশে অবস্থিত আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করেছে।
পাদটীকাঃ
- পৃথিবীর কক্ষপথের দৈর্ঘ্য গড়ে ৯৪০ মিলিয়ন কিমি বা ৫৮৪ মিলিয়ন মাইল।
- পৃথিবীর আবর্তনকাল গড়ে ৩৬৫ দিন এবং সঠিক হিসাবে ৩৬৫ দিন, ৫ ঘণ্টা, ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড।
- পৃথিবীর ভর ৫.৯৭২ × ১০২৪ কেজি।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "New Scientist | Science news and science articles from New Scientist"। www.newscientist.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৮।
- ↑ "The Tenth Planet's First Anniversary by Ken Croswell"। kencroswell.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৮।
- ↑ "Planet Definition - Astronomy 2006 - IAU XXVIth General Assembly"। web.archive.org। ২০০৬-০৮-২৬। Archived from the original on ২০০৬-০৮-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯।
- ↑ ""IAU General Assembly Newspaper"" (পিডিএফ)। ২০০৬-০৮-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-০৩।
- ↑ "International Astronomical Union | IAU"। www.iau.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯।
- ↑ Science, Robert Roy Britt 2006-08-24T13:35:00Z; Astronomy। "Pluto Demoted: No Longer a Planet in Highly Controversial Definition"। Space.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯।
- ↑ "IAU 2006 General Assembly: Resolutions 5 and 6" (পিডিএফ)। ২০০৬-০৮-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৬-২৩।
- ↑ "IAU 2006 General Assembly: Result of the IAU Resolution votes"। ২০০৬-০৮-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১২-৩১।
- ↑ "IAU 2006 General Assembly: Result of the IAU Resolution votes"। Wikipedia (ইংরেজি ভাষায়)। ২০০৬-০৮-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১২-৩১।