বিশ্বজনীন অবস্থান-নির্ণায়ক ব্যবস্থা
বিশ্বজনীন অবস্থান-নির্ণায়ক ব্যবস্থা, যাকে মূল ইংরেজিতে Global Positioning System (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ও সংক্ষেপে GPS (জিপিএস) নামে ডাকা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে উদ্ভাবিত একটি প্রযুক্তি।[১] প্রথম দিকে এর প্রয়োগ ছিল পুরোপুরি সামরিক। পরে জনসাধারণের নিমিত্তে এর ব্যবহার উন্মুক্ত করা হয়। এটি একটি কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। যেকোন আবহাওয়াতে পৃথিবী যেকোনো চলমান অবস্থান আর সময়ের তথ্য সরবরাহ করাটা এর মূল কাজ। জিপিএস এক ধরনের একমুখী ব্যবস্থা কারণ ব্যবহারকারীগণ উপগ্রহ প্রেরিত সঙ্কেত শুধুমাত্র গ্রহণ করতে পারে।
Country/ies of origin | United States |
---|---|
Operator(s) | AFSPC |
Type | Military, civilian |
Status | Operational |
Coverage | Global |
Accuracy | ৫০০–৩০ সেমি (২০–১ ফু) |
Constellation size | |
Total satellites | 33 |
Satellites in orbit | 31 |
First launch | ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ |
Total launches | 72 |
Orbital characteristics | |
Regime(s) | 6x MEO planes |
Orbital height | ২০,১৮০ কিমি (১২,৫৪০ মা) |
একসময় মানচিত্র, কম্পাস, স্কেল ইত্যাদি দিয়ে মেপে ও অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের অবস্থান (Position) নির্ণয় করা হত। বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে এখন খুব সহজে ও নিখুঁতভাবে পৃথিবীর কোন স্থানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয় তার নাম Global Positioning System বা সংক্ষেপে GPS। গাড়ি, জাহাজ, প্লেন, ল্যাপটপ এমনকি নতুন মডেলের মোবাইল ফোনেও এখন GPS রিসিভার থাকে।
ইতিহাস
সম্পাদনামার্কিন সামরিক বাহিনী তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে জিপিএস প্রযুক্তির প্রাথমিক কাজ শুরু করে ১৯৭৭ সালে। এরপর ধাপে ধাপে এর উন্নয়ন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ১৯৯৩ সালে ২৪টি স্যাটেলাইটের সমন্বয়ে সৃষ্ট নেটওয়ার্ককে পৃথিবীর সব জায়গা থেকে ব্যবহারযোগ্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সিস্টেম হিসেবে ঘোষণা করে। সেইসাথে সিস্টেমটি বিশ্বের বেসরকারী লোকদের ব্যবহারের জন্যও উম্মুক্ত করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে অবস্থিত স্যাটেলাইট ট্রেকিং স্টেশন থেকে US Military স্যাটেলাইটগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করে।
সাধারণ ধারণা
সম্পাদনাএই নিবন্ধ বা অনুচ্ছেদটি পড়তে একটি বিশ্বকোষীয় ভুক্তির চেয়ে গল্পই বেশি মনে হয়। |
GPS প্রযুক্তির বেসিক কনসেপ্ট সর্বসাধারণের বুঝার সুবিধার্থে একটি উদাহরণ তুলে ধরলাম: মনে করুন আপনি বাংলাদেশের কোন জায়গায় হারিয়ে গেলেন। আপনি জানেন না জায়গাটির নাম কী, আপনি জানেন না আপনার আশেপাশে কোন শহর বা লোকালয় আছে কিনা! আপনি ঠিক করতে পারছেন না কোনদিকে যাবেন! এসময় (A) নামে একটা লোকের দেখা পেলেন তারও একই অবস্থা, পথ হারিয়ে ফেলেছে। তবে তার কাছে বাংলাদেশের একটা মানচিত্র আছে কিন্তু তা কোন কাজে আসছে না। কারণ আপনারা কোন জায়গায় আছেন তা জানলেই তো মানচিত্র দেখে আশেপাশের শহর কোনটি, কোনদিকে যেতে হবে, কতদূর যেতে হবে ইত্যাদি জানা যাবে।
এসময় X, Y, Z নামে তিনজন লোকের দেখা পেলেন। X বললেন আপনারা ঢাকা থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে আছেন, কিন্তু ঢাকার কোনদিকে (উ:, দ:, পূ: প: ) আছেন তা বলেনি। (A) তার মানচিত্রে ঢাকাকে কেন্দ্রবিব্দু ধরে ১১০ কিলোমিটারকে ব্যাসার্ধ (মানচিত্রের স্কেলে) ধরে একটি বৃত্ত আকঁল। অর্থাৎ যেসব জায়গার উপর দিয়ে বৃত্তের পরিধিটি গেছে সেসব জায়গার কোন একটিতে আপনারা আছেন।
Y বললেন আপনারা রংপুর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে আছেন, কিন্তু কোনদিকে (উ:, দ:, পূ: প: ) আছেন তা বলেনি। (A) তার মানচিত্রে রংপুরকে কেন্দ্রবিব্দু ধরে ১৫০ কিলোমিটারকে ব্যাসার্ধ (মানচিত্রের স্কেলে) ধরে একটি বৃত্ত আকঁল। অর্থাৎ যেসব জায়গার উপর দিয়ে বৃত্তের পরিধিটি গেছে সেসব জায়গার কোন একটিতে আপনারা আছেন। কিন্তু একই সাথে X ও Yএর তথ্যকে সঠিক হিসেবে নিলে আপনাদের অবস্থান গোপালপুর অথবা ময়মনসিংহে। কারণ বৃত্ত দুটি পরস্পরকে এ দুটি জায়গায় ছেদ করেছে। গাণিতিক ও জ্যামিতিক হিসাবে শুধুমাত্র এ দুটি জায়গা থেকেই ঢাকার দুরত্ব ১১০ ও রংপুরের দুরত্ব ১৫০ কিলোমিটার।
Z বললেন আপনারা সিলেট থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে আছেন। (A) তার মানচিত্রে সিলেটকে কেন্দ্রবিব্দু ধরে ১৪০ কিলোমিটারকে ব্যাসার্ধ (মানচিত্রের স্কেলে) ধরে একটি বৃত্ত আকঁল। অর্থাৎ যেসব জায়গার উপর দিয়ে বৃত্তের পরিধিটি গেছে সেসব জায়গার কোন একটিতে আপনারা আছেন। উল্লিখিত নিয়মে আমরা দেখতে পাচ্ছি বৃত্ত তিনটি পরস্পরকে শুধু একটি বিন্দুতে ছেদ করেছে, সেটি হল ময়মনসিংহ! অর্থাৎ তিনটি বৃত্তের Intersection point (ময়মনসিংহ) থেকে X, Y এবং Z তিনজনের তথ্যই সঠিক। এভাবেই আপনারা জানলেন আপনাদের অবস্থান ময়মনসিংহে।
এখন আমরা বলতে পারি: X, Y এবং Z নামের তিনটি স্যাটেলাইট থেকে প্রেরিত বিশেষ তথ্য A নামের GPS রিসিভার গ্রহণ করে গাণিতিক ও জ্যামিতিক হিসাবের মাধ্যমে ডিজিটাল মানচিত্রে আপনার বর্তমান অবস্থানটি (Position) উল্লেখ করার যে পদ্ধতি/প্রযুক্তি তার পূর্ণনাম Global Positioning System বা সংক্ষেপে GPS।
কৃত্রিম উপগ্রহ
সম্পাদনাGPS সিস্টেমের মূল অংশ হচ্ছে ২৭টি স্যাটেলাইট (24 active, 3 Reserve) ও GPS রিসিভার। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০০০ কিলোমিটার উপরে ৬টি অরবিটে ২৪টি স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারিদিকে ২৪ ঘণ্টায় দুইবার করে ঘুরছে। অরবিটগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে পৃথিবীর যেকোন জায়গা থেকে যে কোন সময় কমপক্ষে চারটি স্যাটেলাইট দৃশ্যমান হয়। স্যাটেলাইটগুলো প্রতিনিয়ত দুধরনের সংকেত (signal) প্রেরণ করছে ; L1ও L2। L1 হচ্ছে বেসামরিক লোকের জন্য, যার ফ্রিকোয়েন্সী 1575.42 MHz (UHF band)। এই সংকেতের জন্য প্রয়োজন Line of sight। অর্থাৎ যোগাযোগের সময় স্যাটেলাইট ও রিসিভারের মাঝখানে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারবে না। L1 সংকেতে যেসব তথ্য থাকে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে: "I'm satellite X", My position is Y এবং "This information was sent at time Z". তাছাড়া থাকে almanac data ও ephemeris data। সংকেতগুলো আসে আলোর গতিতে (৩০০,০০০ কিলোমিটার/সেকেন্ড)। প্রতিটি সংকেতে sending time লেখা থাকে।
GPS রিসিভার
সম্পাদনাGPS রিসিভার সংকেতটির reciving time থেকে sending time বিয়োগ করে runtime বের করে। runtime দিয়ে ৩০০০০০ কে গুণ করলে রিসিভার থেকে স্যাটেলাইটটির দুরত্ব বের হয়। এভাবে চারটি স্যাটেলাইটের দূরত্ব বের করে রিসিভার প্রতিটি স্যাটেলাইটের পজিশনকে কেন্দ্রবিন্দু করে প্রতিটির দূরত্বকে ব্যাসার্ধ ধরে চারটি ত্রিমাত্রিক বৃত্ত (sphere) অঙ্কন করে। তারপর বৃত্তগুলোর Intersection point দিয়ে 3-D Trilateration ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে পজিশন নির্ণয় করে। ত্রিমাত্রিক পদ্ধতিতে গোলক (sphere) সৃষ্টি করে Trilateration ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে সঠিক ফলাফলের জন্য কমপক্ষে চারটি স্যাটেলাইটের তথ্য প্রয়োজন হয়। অনেকসময় ৪র্থ স্যাটেলাইটের পরিবর্তে পৃথিবীর পরিধিকে ৪র্থ বৃত্ত হিসেবে ধরেও হিসাব করা হয়।
GPS সিস্টেমে সময় মাপের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ১ লক্ষ ভাগের ১ সেকেন্ড = ৩ কিলোমিটার। এত ক্ষুদ্র সময় মাপতে পারে ব্যয়বহুল Atomic clock (accuracy ন্যানোসেকেন্ড) যা স্যাটেলাইটের আছে কিন্তু রিসিভারের নাই। রিসিভার স্যাটেলাইট থেকে প্রেরিত pseudo-random code কে synchronize করে নিজের ঘড়িকে আপ-টু-ডেট করে নেয়, অর্থাৎ স্যাটেলাইট ও রিসিভার উভয়ের ঘড়ির কারেন্ট টাইম একই হয়ে যায়। সাধারণ মানের GPS রিসিভার (±10m) সঠিক পজিশন দেখাতে পারে। Global Positioning System এর higher accuracy-র (±1m) জন্য ব্যবহার হয় Differential GPS। এই সিস্টেমে মহাশূন্যের স্যাটেলাইট ছাড়াও ল্যান্ড স্যাটেলাইট থেকেও তথ্য নেওয়া হয়। জিপিএস সফটওয়্যারে (জিপিএস ম্যাপ) রাস্তাঘাট ছাড়াও পেট্রোল পাম্প, পুলিশ স্টেশন, হোটেল/রেস্টুরেন্ট, পর্যটন স্থান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ইত্যাদির তথ্য থাকে। কারেন্ট পজিশনের আশেপাশে উল্লিখিত কোন কিছু থাকলে জিপিএস ডিভাইসের ডিসপ্লেতে তা প্রদর্শন করে। গাড়ি, জাহাজ, প্লেন ছাড়াও বড় বড় শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে, যুদ্ধে শত্রুসেনার ট্রেকিং রাখতে, বোমা-মিসাইলের নিশানাকে সঠিক করতে, কোন বিশেষ স্থানের উপর নজর রাখতে GPS সিস্টেম ব্যবহার হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের GPS-র বিকল্প হিসেবে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন তৈরি করছে global navigation satellite system (GNSS)। যাকে বলা হয় Galileo। এটি ২০১৩ সাল থেকে চালু করা হবে। GLONASS নামে রাশিয়ার নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম আছে যা মহাশূন্য গবেষণা ও সামরিক কাজে ব্যবহার হয়। চীনও Beidou-2 নামে তাদের নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম তৈরির প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবস্থা সমূহ
সম্পাদনা- India নাবিক (ভারতীয় আঞ্চলিক নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম) - বর্তমানে শুধু সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। ২০২০ তে জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য হবে।
- Russia গ্লোনাস (গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম)
- China বেইডউ (BeiDou নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম) - ২০১৮ তে জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য হয়েছে।
- European Union গ্যালিলিও (গ্যালিলিও নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম)
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "About GPS"। ১৮ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০০৯।