বাংলাদেশে চা উৎপাদন

বাংলাদেশ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চা উৎপাদনকারী দেশ। এর চা শিল্প ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলে আসছে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা ব্যবসা শুরু করে।[১] বর্তমানে, বাংলাদেশে ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা এস্টেট রয়েছে (সর্বশেষ খাগড়াছড়ি জেলায়), যার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম চা বাগান।[২][৩] এখানকার এই শিল্প বিশ্বের ৩% চা উৎপাদন করে থাকে, এবং ৪০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।[৪]

শ্রীমঙ্গলের চা বাগান

এখানকার উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সমূহে চা উৎপাদন হয়ে থাকে; উচ্চভূমি, উষ্ণ জলবায়ু, আর্দ্র এবং অতি বৃষ্টি প্রবণ এলাকাসমূহ উন্নতমানের চা উৎপাদনের মোক্ষম পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়।[৪]

ইতিহাস সম্পাদনা

 
চট্টগ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশ চা শিল্পের জন্মস্থান।

ঐতিহাসিকভাবে, বঙ্গ চা অশ্ব সড়কের শেষপ্রান্ত ছিল, যা এই উপমহাদেশকে চীনের প্রথম দিককার চা-উৎপাদনকারী অঞ্চল ইউন্নানের সাথে সংযুক্ত করেছিল। অতীশ দীপঙ্করকে প্রথম দিককার একজন বাঙ্গালি চা পানকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৫]

বঙ্গ প্রদেশে কালো চায়ের চাষ ব্রিটিশ শাসনামলের সময় শুরু হয়েছিল।[৬] ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ১৮৪০ সালে এই উপমহাদেশের সর্বপ্রথম চা বাগান বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করে, যখন কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে চীনা চায়ের গাছ এনে চট্টগ্রাম ক্লাবের পাশে রোপণ করা হয়।[১][৫] ১৮৪৩ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে প্রথম চা তৈরি এবং পান করা হয়।[১][৫] বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে।[১] সিলেট অঞ্চলের সুরমা নদী উপত্যকা পূর্ব বাংলার চা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। চা চাষ নিম্ন ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) এবং উত্তর বঙ্গের পঞ্চগড়েও শুরু হয়। পঞ্চগড় হচ্ছে বাংলাদেশের তৃতীয় চা অঞ্চল এবং সবথেকে চাহিদাপূর্ণ চা এখানে উৎপন্ন হয় ও উৎপাদনের দিক থেকে পঞ্চগড় দেশের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

 
পঞ্চগড়ের একটি চা বাগান

চা ব্রিটিশ বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানিপণ্য ছিল। সুরমা এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা চাষিদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের রপ্তানিকারকদের কাছে চা পৌঁছিয়ে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে এই শিল্পের জীবনরেখা হিসেবে সেবা দিয়ে গেছে।[৭][৮]

চট্টগ্রাম চা নিলাম ১৯৪৯ সালে ব্রিটিশ এবং অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসায়ীরা স্থাপন করে। জেমস ফিনলে এবং ডাঙ্কান ব্রাদার্সের মতো ব্রিটিশ কোম্পানি এক সময় এই শিল্পের আধিপত্য করেছে।[৯] ইস্পাহানী পরিবারও এই শিল্পের এক বিখ্যাত অংশীদার ছিল।[১০]

চা শিল্প সম্পাদনা

 
সিলেট জেলার একটি চা বাগান।

পাটের পরেই চা হচ্ছে বাংলাদেশের সবথেকে বেশি রপ্তানি হওয়া অর্থকারী ফসল। এই শিল্প থেকে জাতীয় জিডিপির ১% আসে।[১১] চা উৎপাদনকারী জেলাগুলো হচ্ছে- মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং রাঙ্গামাটি[১২] মৌলভীবাজারে ৯২টি, হবিগঞ্জে ২৪টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে ৩৭টি, রাঙ্গামাটিতে ২টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১০টি চা বাগান রয়েছে।[১৩] বর্তমানে চা উৎপাদনের দিকথেকে প্রথম স্থানে রয়েছে মৌলভীবাজার জেলা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পঞ্চগড় জেলা ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা।

এক সময়কার বিশ্বের প্রধান একটি চা রপ্তানিকারক দেশ, বাংলাদেশ এখন মাত্র সাধারণ এক রপ্তানিকারক দেশ।[১৪] বাংলাদেশি মধ্যম শ্রেণীর উত্থান এই শিল্পকে লাভজনক দেশীয় বাজারের দিকে আলোকপাত করে ব্যাপকভাবে চালিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে এই সেক্টরটি ম ম ইস্পাহানি লিমিটেড, কাজী এন্ড কাজী, ট্রান্সকম গ্রুপ, জেমস ফিনলে বাংলাদেশ, ওরিয়ন গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ রেবনল টি লিমিটেড এবং ডানকান ব্রাদার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

২০১২ সালে, বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন করে, যা প্রায় ৬.৩৮৫ কোটি কিলোগ্রাম ছিল।[১৫] পরবর্তীতে এই রেকর্ড ভেঙ্গে ২০১৬ সালে সাড়ে আট কোটি কিলোগ্রাম এবং ২০১৯ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কিলোগ্রাম চা উৎপাদিত হয়।[১৬] ১৯৪৭ সালে যেখানে ২৮,৭৩৪ হেক্টর ভূমি ছিল, সেখানে ২০১২ সালে ৫৬,৮৪৬ হেক্টরেরও বেশি ভূমি এই শিল্পের চাষে ব্যবহার করা হয়েছে।[১][২] ২০২২ সালে ১৬৬টি চা বাগানে মোট ভূমির পরিমাণ ১,১৩,০৮৭ হেক্টর (২,৭৯, ৪৩৯ একর)।[১৭] বর্তমানে সরকার ক্ষুদ্র পরিসরের চা উৎপাদকদের এই শিল্পের বিকাশে কাজ করতে উদ্যোগ নিয়েছে, বিশেষকরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

বাংলাদেশে চায়ের মূল্য চট্টগ্রামে হওয়া সরকারি নিলামের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এমন নিলামকেন্দ্র বাংলাদেশে ৩ টি রয়েছে। ১. চট্টগ্রাম চা নিলাম কেন্দ্র ২. পঞ্চগড় চা নিলাম কেন্দ্র ৩. শ্রীমঙ্গল চা নিলাম কেন্দ্র

নিলামগুলো পরিচালনা করেন বাংলাদেশের চা ব্রোকারগন, যারা বাংলাদেশ চা বোর্ডের থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত।

চা ব্রোকার্স এর সংক্ষিপ্ত তালিকাঃ

বাংলাদেশে বৃটিস আইন দ্বারা চায়ের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এই নিলাম পরিচালনা করে থাকেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের লাইসেন্সপ্রাপ্ত চা ব্রোকার্সগণ। এরএর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল - ১. ন্যাশনাল ব্রোকার্স ২. ইন্ডিগো ব্রোকার্স লিমিটেড ৩. ইউনিটি ব্রোকার্স ৪. পূর্ববাংলা ব্রোকার্স ৫. শ্রীমঙ্গল ব্রোকার্স সহ ১৬ টি ব্রোকার্স।

মার্চ ২০১৫-তে, বাংলাদেশের চায়ের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ছিল মার্কিন$২.৪০ ডলার।[১৮] চা রফতানি বাবদ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৭.১০ লাখ ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৬.৩০ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৮.৩০ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৪.৭০ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৭.৮০ লাখ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৮.২০ লাখ ডলার আয় হয়েছে।[১৯]

শ্রম সম্পাদনা

বাংলাদেশের চা বাগানে ৩,০০,০০০ অধিক বাগানি কর্মরত আছে। যার ৭৫% নারী।[৩] অনেক শ্রমিকই উপজাতি বাসিন্দা যাদের ব্রিটিশ শাসনামলে মধ্য ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।[২০]

সরকারী প্রতিষ্ঠান সম্পাদনা

বাংলাদেশে চায়ের বাণিজ্যের জন্য উৎপাদন, এর সত্যায়ন, এবং রপ্তানিকরণে বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।[২১] বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৫৭ সালে চায়ের গুণগত মান উন্নয়নে কাজ শুরু করে, সর্বোচ্চ মানের উচ্চ ফলনশীল পাতা উৎপাদন এবং বিকাশের লক্ষ্যে জিন উদ্ভাবনের মাধ্যমে।[২২]

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Nasir, Tasnuba (জুন ২০১১)। "Tea Productions, Consumptions and Exports: Bangladesh Perspective" (পিডিএফ)International Journal o f Educational Research2 (1): 68–73। আইএসএসএন 0976-4089। সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  2. Dr. Kazi Muzafar Ahammed। "Investment for Sustainable Development of Bangladesh Tea Industry – An Empirical Study" (পিডিএফ)। Bangladesh Economic Association। ৬ আগস্ট ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  3. "Tea Gardens in Bangladesh"bangladesh.com। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০১৫ 
  4. "Tea"scribd.com। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০১৫ 
  5. Home। "Saving the Slips Between Cup and Lips"। Firstnewsmagazine.com। সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  6. Colleen Taylor Sen (2004). Food Culture in India. Greenwood Publishing Group. p. 26. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৩১৩-৩২৪৮৭-১.
  7. Ishrat Alam; Syed Ejaz Hussain (২০১১)। The Varied Facets of History: Essays in Honour of Aniruddha Ray। Primus Books। পৃষ্ঠা 273। আইএসবিএন 978-93-80607-16-0 
  8. Alan Warren (১ ডিসেম্বর ২০১১)। Burma 1942: The Road from Rangoon to Mandalay। A&C Black। পৃষ্ঠা 235। আইএসবিএন 978-1-4411-0673-5 
  9. Tea Industry, Banglapedia
  10. Ispahani Family, Banglapedia
  11. "Tea @ Global Trade Concern – Bangladesh"। Tea.globaltradeconcern.com। সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  12. "Bangladesh Tea Board"। Teaboard.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  13. বিশ্ববাজারে বাড়ছে চায়ের দাম, দেশে ক্রেতা নেই, জাগো নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম, ১৫ জুলাই ২০২০
  14. "Growth of imports shake tea gardens of northern Bangladesh"The Daily Star। ৫ ডিসেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  15. "Bangladesh records highest tea production in 2012"thedailystar.net। ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০১৫ 
  16. ১৬৬ বছরের ইতিহাসে চা উৎপাদনে রেকর্ড, প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি ২০২০
  17. বিশ্ববাজারে বাড়ছে চায়ের দাম, দেশে ক্রেতা নেই, জাগো নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম, ১৫ জুলাই ২০২০
  18. "Bangladesh tea prices edge up on strong demand"dhakatribune.com। ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০১৫ 
  19. বিশ্ববাজারে বাড়ছে চায়ের দাম, দেশে ক্রেতা নেই, জাগো নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম, ১৫ জুলাই ২০২০
  20. "As tea estates expand in Bangladesh, tribes fear for their future"ucanews.com। ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০১৫ 
  21. Bangladesh Tea Research Institute, Banglapedia
  22. Chen, Liang; Apostolides, Zeno; Chen, Zong-Mao (২০১২)। Global Tea Breeding: Achievements, Challenges and Perspectives। Hangzhou: Zhejiang University Press। পৃষ্ঠা 290।