বল
বল (ইংরেজি: Force) হলো এমন একটি বাহ্যিক প্রভাব যা কোনো বস্তুর বেগের মানের বা দিকের বা উভয়ের পরিবর্তন ঘটাতে পারে (যেমন স্থির বস্তু গতিশীল করা, গতিশীল বস্তুর বেগের পরিবর্তন করা কিংবা গতিশীল বস্তুকে স্থির করা), অর্থাৎ বস্তুতে ত্বরণ সৃষ্টি করতে পারে। বল প্রকাশ করতে এর মান ও দিক উভয়েরই প্রয়োজন, তাই এটি একটি ভেক্টর রাশি। বস্তুটি পূর্ণ স্থিতিস্থাপক না হলে বলের প্রভাবে বস্তুটির আকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে থাকে।
বল | |
---|---|
![]() বলকে সাধারণ ভাবে ধাক্কা বা ঠেলা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মহাকর্ষ, তাড়িতচৌম্বক বল কিংবা অন্য কোন বলের কারণে বস্তুর ত্বরণ ঘটতে পারে। | |
সাধারণ প্রতীক | , , |
এসআই একক | নিউটন (N) |
এসআই মৌলিক এককে | |
মাত্রা |
দৈনন্দিন জীবনে বলের সাধারণ উদাহরণ হলো কোন বস্তুকে "টানা" বা "ঠেলা"। এছাড়াও কোন বস্তুকে ভূমির উপর থেকে ছেড়ে দিলে তা মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সবসময় নিচে পতিত হয়।
নিউটনের দ্বিতীয় সুত্রমতে, কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হারই বলের মান এবং ভরবেগের পরিবর্তনের দিকই হলো বলের দিক। বলকে সাধারণভাবে ভর ও ত্বরণের গুনফল রূপে প্রকাশ করা হয়।
নিউটনিয় বলবিদ্যাসম্পাদনা
স্যার আইজ্যাক নিউটন ১৬৮৭ সালে তাঁর ফিলসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা প্রকাশ করেন যেখানে তিনি গতির তিনটি সুত্র প্রদান করেন যা চিরায়ত বলবিদ্যার ভিত্তিস্বরূপ।
প্রথম সুত্রসম্পাদনা
নিউটনের প্রথম সুত্রে বলা হয়, কোন বস্তুর উপর লব্ধি বাহ্যিক বল ক্রিয়া না করলে জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে স্থির বস্তু স্থির এবং গতিশীল বস্তু সমদ্রুতিতে সরলরৈখিক পথে বা সমবেগে গতিশীল থাকবে। এ সুত্রকে জড়তার সুত্রও বলা হয়। অর্থাৎ বেগের যেকোনো ধরনের (মান বা দিক) পরিবর্তন ঘটানোর জন্য অবশ্যই একটি কারণ থাকতে হবে, এবং এ কারণটি হলো লব্ধি বাহ্যিক বল [১]। গাণিতিকভাবে বলা যায়, হলে, হবে।
দ্বিতীয় সুত্রসম্পাদনা
নিউটনের দ্বিতীয় সুত্রে বলা হয়, কোন বস্তুর উপর ক্রিয়ারত লব্ধি বল হলো বস্তুটির ভর ও ত্বরণের গুনফল[২]। কোন বস্তুর ভর ও এর লব্ধি ত্বরণ হলে গানিতিকভাবে,
যেখানে হলো বস্তুর ভরবেগ। তাই নিউটনের সুত্রকে অন্যভাবে বলা হয়, ভরবেগের পরিবর্তনের হারই হলো বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল এবং ভরবেগের পরিবর্তনের দিকই হলো বস্তুর দিক।
দ্বিতীয় সুত্র হতে প্রথম সুত্রের প্রতিপাদন করা যায় কেননা হলে এবং হলে ত্বরণ হয়, অর্থাৎ বেগের কোনরূপ পরিবর্তন হয়না। তাই সেক্ষেত্রে স্থির বস্তু স্থির ও গতিশীল বস্তু সমবেগে গতিশীল থাকবে।
তৃতীয় সুত্রসম্পাদনা
তৃতীয় সুত্রে বলা হয়, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। যদি কোন বস্তু অন্য একটি বস্তু এর উপর প্রয়োগ করে তবে এ সুত্র অনুযায়ী বস্তুটিও এর উপর একটি বল প্রয়োগ করবে এবং হবে। অর্থাৎ, কোন বস্ত অন্য একটি বস্তুর উপর যে দিকে যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করবে, অন্য বস্তুটিও প্রথম বস্তুর উপর তার বিপরীত দিকে সমপরিমাণ বল প্রয়োগ করবে। নিউটনের তৃতীয় সুত্র হতে ভরবেগের সংরক্ষনশীলতার সুত্র প্রতিপাদন করা যায়। যদি একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেমে ও দুটি কনা নিয়ে গঠিত হয় এবং সিস্টেমের উপর লব্ধি বাহ্যিক বল শুন্য হয় তবে এদের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ছাড়া অন্য কোন বল সিস্টেমের ভরবেগ পরিবর্তন করতে পারবে না। কিন্তু তৃতীয় সুত্রমতে অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার কারণে উদ্ভূত সকল বলের সমষ্টি শূন্য হয় (সকল বল সিস্টেমের ভরকেন্দ্রে ক্রিয়া করে)। তাই সিস্টেমের লব্ধি ভরবেগের কোন পরিবর্তন হয় না। গাণিতিকভাবে,
অর্থাৎ সিস্টেমের মোট ভরবেগ ধ্রুব হয়।
মৌলিক বলসম্পাদনা
প্রকৃতিতে যত ধরনের বল পাওয়া যায় তার সবই বলই চারটি মৌলিক বলের একক কিংবা যৌথ প্রকাশ। বলগুলো হলো মহাকর্ষ বল, তাড়িতচৌম্বক বল, সবল নিউক্লীয় বল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বল। সবল ও দুর্বল বল দুটো হলো নিউক্লিয় বল যারা অত্যন্ত ক্ষুদ্র পাল্লার মধ্যে ক্রিয়াশীল এবং অতিপারমানবিক কণার মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী। তারিতচৌম্বক বল তড়িৎ আধানের উপর ক্রিয়া করে এবং মহাকর্ষ বল ভরের উপর ক্রিয়া করে।
মহাকর্ষ বলসম্পাদনা
চিরায়ত বলবিদ্যায় মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি ভরযুক্ত কণার মধ্যবর্তী আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলা হয়ে থাকে। নিউটনের মহাকর্ষ সুত্র অনুযায়ী এ বলের মান কণা দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক, দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক এবং এ বল তাদের মধ্যবর্তী সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে। অর্থাৎ, ও ভরের দুটি কণা দূরত্বে অবস্থান করলে তাদের মধ্যবর্তী মহাকর্ষ বলের মান হবে যেখানে একটি মহাকর্ষীয় সার্বজনীন ধ্রুবক। এসআই এককে ।
ভূপৃষ্ঠের নিকটে অবস্থিত কোন বস্তুর উপর পৃথিবীর আকর্ষনকে অভিকর্ষ বলা হয়। অভিকর্ষের প্রভাবে পৃথিবীতে কোন বস্তু উপরে উঠিয়ে ছেড়ে দিলে তা ভূমিতে পতিত হয়।
চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বল সবচেয়ে দুর্বল।
তাড়িতচৌম্বক বলসম্পাদনা
দুটি আহিত কণা তাদের আধানের কারণে একে অপরের উপর যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল প্রয়োগ করে, তাকে তাড়িতচৌম্বক বল বলে। এই বল ইলেকট্রনকে নিউক্লিয়াসের সাথে আবদ্ধ করে পরমাণু তৈরি করে। এই বলেরও পাল্লা অসীম আর আপেক্ষিক সবলতা 1039।
সবল নিউক্লিয় বলসম্পাদনা
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউক্লীয়ন (নিউক্লিয় উপাদান)-গুলোকে একত্রে আবদ্ধ রাখে যে শক্তিশালী বল, তাকে সবল নিউক্লিয় বল বলে। এই বল প্রোটন ও নিউট্রনকে আবদ্ধ করে নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এর পাল্লা 10−15 m এবং আপেক্ষিক সবলতা 1041।
দুর্বল নিউক্লিয় বলসম্পাদনা
যে স্বল্প পাল্লার ও স্বল্পমানের বল নিউক্লিয়াসের মধ্যে মৌলিক কণাগুলোর মধ্যে ক্রিয়া করে অনেক নিউক্লিয়াসে অস্থিতিশীলতার উদ্ভব ঘটায়, তাকে দুর্বল নিউক্লিয় বল বলে অথবা,যে বলের কারণে পরমাণুর নিউক্লিয়াস তেজস্ক্রিয় ধর্ম প্রদর্শন করে, সেই বলকে দুর্বল নিউক্লিয় বল বলে।তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়াগুলো দুর্বল নিউক্লিয় বলের কারণে ঘটে। এর পাল্লা 10−18 m এবং আপেক্ষিক সবলতা 1030। দুর্বল নিউক্লিয় বল (দুর্বল বল) হচ্ছে প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের একটি। অন্য তিনটি বল হচ্ছে সবল নিউক্লিয় বল, তাড়িতচৌম্বক বল এবং মহাকর্ষ বল। তেজস্ক্রিয়তার জন্য দুর্বল নিউক্লিয় বল দায়ী, নিউক্লিয় ফিশনে তেজস্ক্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দুর্বল নিউক্লিয় বলের তত্ত্বকে কখনো কখনো কোয়ান্টাম ফ্লেভারডাইনামিক্স (QFD) বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স যেমন সবল নিউক্লিয় বলের সাথে এবং কোয়ান্টাম তড়িৎ- বিজ্ঞান তাড়িতচৌম্বক বলের সাথে জড়িত। কিন্তু QFD নামপদটি খুব কম ব্যবহার করা হয়, কেননা দুর্বল বল দুর্বল-তড়িৎ তত্ত্বের (Electroweak interaction) অধীনে সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা করা যায়।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ "4.2 Newton's First Law of Motion: Inertia - College Physics | OpenStax"। openstax.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-২৮।
- ↑ Fundamentals of Physics (9th সংস্করণ)। John Wiley & Sons, Inc.। পৃষ্ঠা 91। আইএসবিএন 9780470469088।