পেলের কেশ (হাওয়াইয়ান ভাষায় lauoho o Pele[১]; আক্ষরিক বাংলা: পেলে'র মাথার কেশ) হচ্ছে এক ধরনের লাভারূপ। এর নামকরণ করা হয়েছে হাওয়াইয়ানদের আগ্নেয়গিরির দেবী পেলে এর নামানুসারে। একে আগ্নেয়-কাঁচ তন্তু অথবা সূক্ষ্ম আগ্নেয় কাঁচের সুতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়।[২] সাধারণত লাভা প্রস্রবণ (lava fountains), লাভা প্রপাত (lava cascades) এবং তীব্র লাভা উদগীরণের সময়, নির্গত লাভা হতে উদ্গত গলিত ব্যাসল্টজাত কাঁচ থেকে এই সূত্রগুলো গঠিত হয়।

পেলে'র কেশ (মাপকাঠি হিসেবে একটি হাত লেন্স দেখানো হয়েছে)
এক গোছা পেলের কেশ এর আণুবীক্ষনিক চিত্র

হালকা তন্তুগুলো অনেক সময় বাতাসে ভেসে অনেক ওপরে উঠে যায় এবং আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বৃক্ষাগ্র, বেতার অ্যান্টেনা কিংবা বৈদ্যুতিক খুঁটির মত উঁচু স্থানে পেলের কেশের গোছা পাওয়াটা সাধারণ একটা ব্যাপার।

পেলের কেশ অবশ্য যে শুধু হাওয়াইতেই পাওয়া যায়, তা নয়। বিশ্বের অনেক জায়গাতেই আগ্নেয়গিরির আশেপাশে এগুলো দেখা যায়। যেমন- নিকারাগুয়া (মাসায়া আগ্নেয়গিরি), ইতালি (এট্‌না পর্বত), ইথিওপিয়া (এরতা' আলে), এবং আইসল্যান্ড (যেখানে এটি nornahár (ডাইনির কেশ) নামে পরিচিত)।[৩] এটা মাটির ফাঁকে ফাঁকে পাওয়া যায়, সাধারণত আগ্নেয়গিরির মুখ, সমুদ্র মুখ বা এমন কোণাগুলোতে যেখানে পেলের কেশ জমা হতে পারে।

পেলের কেশ, সান্তিয়াগো জ্বালামুখ, নিন্দিরি আগ্নেয়গিরি, মাসায়া আগ্নেয়গিরি জাতীয় উদ্যান, নিকারাগুয়া

পেলের কেশ স্পর্শ না করতেই পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, কেননা এটা অত্যন্ত ভঙ্গুর ও অত্যন্ত ধারালো, এবং এর ছোট ছোট ভাঙ্গা টুকরাগুলো ত্বক ভেদ করে শরীরে ঢুকতে পারে। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় অবশ্যই দস্তানা পরিধান করা উচিৎ।

পেলের অশ্রু'র সাথে একই সাথে পেলে'র কেশও গঠিত হতে পারে।[৩] এটা আগ্নেয়গিরিবিদদের অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে, যেমন- তাপমাত্রা এবং ম্যাগমার ভূ-পৃষ্ঠে বেরিয়ে আসার পথ। প্রায় ১,১৬০ °সে. এর দিকে, পেলের কেশের ম্যাগমা থেকে প্ল্যাজিওক্লেজ (Plagioclase) গঠিত হতে শুরু করে।[৪] এছাড়াও, পেলের অশ্রু'র আকার দেখেও অগ্ন্যুৎপাতের গতিবেগ সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর অশ্রুর মধ্যে আটকে পড়া কণা ও গ্যাসের বুদ্বুদ থেকে ম্যাগমা প্রকোষ্ঠের সংযুতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপের পু-উ-ও-ও নামক স্থানের দক্ষিণ প্রান্তে থাকা রেডিও অ্যান্টেনায় আটকে যাওয়া পেলে'র কেশ এর ছবি (২২ জুলাই, ২০০৫)
 
হাওয়াই এর কিলাউইয়া আগ্নেয়গিরির পাহাউই-হাউই (pahoehoe) প্রবাহের ওপর পাওয়া পেলের কেশ (২৭ মার্চ, ১৯৮৪)

যখন গলিত লাভা আকাশে নিক্ষিপ্ত হয়ে অতি ক্ষুদ্র ফোঁটা গঠন করে এবং ক্রমান্বয়ে প্রলম্বিত হয়ে একদম সোজা হয়ে যায়, তখন পেলের কেশের সূত্রগুলো তৈরি হয়। সাধারণত লাভা প্রস্রবণে, লাভা প্রপাতে (lava cascades) এবং তীব্র লাভা উদগীরণের সময় এগুলো গঠিত হয়।[৩]

বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা

পেলের কেশের রঙ হচ্ছে সোনালি হলুদ এবং দেখতে মানুষের চুল কিংবা শুকনো খড়ের মতন। সূর্যালোকে এর রঙ ঝলমলে সোনালি দেখা যায়। দৈর্ঘ্য যদিও উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন হয়ে থাকে, তবে সচরাচর ৫ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার, এবং সর্বোচ্চ ২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।[৫] কেশের ব্যাস হয় ১ থেকে ৩০০ মাইক্রোমিটার (০.০০১ ~ ০.৩ মিলিমিটার)। এজন্য এগুলো খুব হালকা ওজনের হয়ে থাকে।

ব্যবহার

সম্পাদনা

খনিজ পশম (mineral wool; প্রস্তর পশম (stone wool) বা শিলা পশম (rock wool) নামেও পরিচিত) সাধারণত অদাহ্য, টেকসই, মাত্রিকভাবে সুস্থিত, অতিবেগুনী সুস্থিত, পানিবিদ্বেষী (hydrophobic), বাষ্প-ভেদনযোগ্য অন্তরক পদার্থ হিসেবে আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং সুউচ্চ অট্টালিকাসমূহের নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এইসব পদার্থের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে পেলের কেশ গঠনের মূলনীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়: বিগলিত শিলা এবং ইস্পাত উৎপাদন প্রণালী হতে প্রাপ্ত পুনর্ব্যবহৃত ধাতুমলের (slag) সাথে উচ্চচাপে প্রবাহিত বায়ু। হাইড্রোপোনিক কৃষিকাজের ক্ষেত্রে, পানির স্বল্প ব্যবহার, উচ্চ ফলনের জন্য, মাটির বদলে এই পদার্থের পানিগ্রাহী রূপ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

প্রচলিত বিশ্বাস

সম্পাদনা

হাওয়াইয়ানদের কাছে পেলে হচ্ছে আগুন, বজ্রপাত, বাতাস, নৃত্য এবং আগ্নেয়গিরির দেবী। পেলে কীভাবে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এলো, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লোককাহিনী প্রচলিত আছে। তবে লোকে এটা বিশ্বাস করে যে, পেলে'র আত্মা হাওয়াই দ্বীপের কিলাউইয়া আগ্নেয়গিরির (Kilauea volcano) জ্বালামুখের ভেতর বাস করে। পেলের আত্মা নানা রূপে দেখা দেয় এবং তাকে অমঙ্গলের অগ্রদূত বলেই গণ্য করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ আদিবাসী হাওয়াইয়ানের ভাষ্যমতে, তারা জীবনে অন্তত একবার হলেও তার মুখোমুখি হয়েছেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

প্রচলিতভাবে হাওয়াইয়ানরা বিশ্বাস করে যে, সকল প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের সাথে তাদের মিলেমিশে থাকতে হবে। যারা আগ্নেয় পাথর, বালি, ঝিনুক, অথবা দ্বীপের অন্য যে কোন প্রাকৃতিক বস্তু নিজেদের সাথে নিয়ে যায়, তাদের ওপর পেলের অভিশাপ পড়ে। ঐসব জিনিস তাদের যথাযোগ্য স্থানে ফিরিয়ে না দেওয়া অব্দি ঐ অভিশাপ বিদ্যমান থাকে। তাছাড়া, রাষ্ট্রীয় আইনে কোন জাতীয় উদ্যান থেকে কোন কিছু সরিয়ে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। প্রতি বছরই অনেক লোক দ্বীপ থেকে নিয়ে যাওয়া বহু সংখ্যক জিনিস ডাকযোগে হাওয়াইয়ে ফেরত পাঠান কেননা তারা বিশ্বাস করেন যে, সেগুলো নেওয়ার পর থেকেই তারা চরম দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন।[৬][৭]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Pele"The Free Dictionary 
  2. Shimozuru, Daisuke (১৯৯৪)। "Physical parameters governing the formation of Pele's hair and tears"। Bulletin of Volcanology56 (3): 217–219। ডিওআই:10.1007/BF00279606 
  3. Duffield, W. A.; Gibson Jr., E. K.; Heiken, G. H. (১৯৭৭)। "Some characteristics of Pele's hair" (পিডিএফ)Journal of Research of the U. S. Geological Survey5 (1): 93–101। 
  4. Katsura, Takashi (১৯৬৭)। "Pele's hair as a liquid of Hawaiian tholeiitic basalts" (পিডিএফ)Geochemical Journal1 (4): 157–168। ডিওআই:10.2343/geochemj.1.157। ২২ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  5. Herzog, G. F; ও অন্যান্য (২০০৯)। "Isotopic and elemental abundances of copper and zinc in lunar samples, Zagami, Pele's hairs, and a terrestrial basalt"। Geochimica et Cosmochimica Acta73 (19): 5884–5904। ডিওআই:10.1016/j.gca.2009.05.067 
  6. "Pele, Hawaii Goddess of Fire: Hawaiian Legend ⋆ Mythical Realm"। ২২ আগস্ট ২০১৬। 
  7. Moon, Grandmother। "Hawai'ian Volcano Goddess, Madame Pele" 
  • Moune, Séverine; Faure, François; Gauthier, Pierre-j। (২০০৭) Pele's hairs and tears: Natural probe of volcanic plume। Elsevier, Journal of Volcanology এবং Geothermal Research. France, পৃ. ২৪৪-২৫৩।
  • M. Potuzak, M., Dingwell, D.B., Nichols, A.R.L.। (২০০৬) Hyperquenched Subaerial Pele’s Hair Glasses from Kilauea Volcano, Hawaii। European Geosciences Union, সংস্করণ ৮।
  • Piccardi, L. and Masse, W. B.। (২০০৭) Myth and Geology Geological Society, London, Special Publications, ২৭৩, ১-৭। The Geological Society of London, ২০০৭
  • Zimanowki, B., Buttner, R. Lorenz, V., Hafele, H-G.। (১৯৯৭) Fragmentation of Basaltic Melt in the Course of Explosive Volcanism। Journal of Geophysical Research, খণ্ড ১০২, No. B1, পৃ. ৮০৩-৮১৪
  • Villmant, B.; Salaün, A. and Staudacher, T। (২০০৯) Evidence for a Homogeneous Primary Magma at Piton De La Fournaise (La Réunion): A Geochemical Study of Matrix Glass, Melt Inclusions and Pélé's Hairs of the 1998–2008 Eruptive Activity। Journal of Volcanology and Geothermal Research, সংস্করণ ১৮৪, পৃ. ৭৯-৯২

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা
  • Gill, Robin। Igneous Rocks and Processes: A Practical Guide। Hoboken, N.J.: Wiley-Blackwell, ২০১০।
  • Lopes, Rosaly। The Volcano Adventure Guide। Cambridge, UK: Cambridge University Press, ২০০৫।
  • MacDonald, Gordon Andrew; Abbott, Agatin Townsend; and Peterson, Frank L। Volcanoes in the Sea: The Geology of Hawaii. Honolulu: University of Hawaii Press, ১৯৮৩।
  • Morey, Kathy। Hawaii Trails: Walks, Strolls, and Treks on the Big Island। Berkeley, Calif.: Wilderness Press, ২০০৬।
  • Nimmo, Harry। Pele, Volcano Goddess of Hawai'i: A History. Jefferson, N.C.: McFarland & Co., ২০১১।

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা