একটি গ্রহ, উপগ্রহ বা অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তুর পৃথিবীকরণ (ইংরেজি: Terraforming বা Terraformation; আক্ষরিক অর্থে "পৃথিবীতুল্য করে তোলা") বলতে বোঝায় সুচিন্তিতভাবে উক্ত বস্তুটির বায়ুমণ্ডল, তাপমাত্রা, পৃষ্ঠতলের ভূসংস্থান বা বাস্তুসংস্থানের উন্নতিসাধন ঘটিয়ে পৃথিবীর সমতুল্য পরিবেশ নির্মাণের একটি অনুমানাত্মক প্রক্রিয়া।

শিল্পীর কল্পনায় ক্রমবিকাশের চারটি স্তরে মঙ্গল গ্রহের একটি পৃথিবীকৃত রূপ।

পৃথিবীকরণের ধারণাটি বিকাশ লাভ করেছিল কল্পবিজ্ঞান ও প্রকৃত বিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রেই। ১৯৪২ সালে জ্যাক উইলিয়ামসন অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন পত্রিকায় প্রকাশিত "কলিজন অরবিট" নামে একটি কল্পবিজ্ঞান ছোটোগল্পে ইংরেজি টেরাফর্মিং শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন।[১] তবে পৃথিবীকরণের ধারণা আরও পুরনো বলে মনে করা হয়।

তবে একটি গ্রহের পরিবেশ সুপরিকল্পিতভাবে যদি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়ও, অন্য গ্রহে পৃথিবীর অনুকরণে একটি স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করার বাস্তবায়নযোগ্যতা এখনও যাচাই করে দেখা হয়নি। সাধারণত মঙ্গলকে পৃথিবীকরণের প্রধান সম্ভাব্য গন্তব্য বলে মনে করা হয়। ওই গ্রহে তাপজননের উপায় ও বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তনের সম্ভবতা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করা হয়েছে। এমনকি নাসা এই বিষয়টির উপর বিতর্কেরও আয়োজন করেছে। মঙ্গল গ্রহের জলবায়ু পরিবর্তনের বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য পদ্ধতি মানবজাতির প্রযুক্তিগত সামর্থ্যের করায়ত্ত্ব হলেও বর্তমানে তা করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার জোগান দিতে কোনও সরকার বা সমাজব্যবস্থাই রাজি নয়। পৃথিবীকরণের সুদীর্ঘ সময়ক্রম ও প্রায়োগিক দিকটিও বিতর্কের বিষয়। এছাড়াও একটি বহিঃপৃথিবীস্থ জগতের পরিবেশ পরিবর্তনের নীতি, পণ্য স্থানান্তর বিদ্যা, অর্থনীতি, রাজনীতিপদ্ধতিবিজ্ঞান-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলিরও উত্তর পাওয়া যায় না।

গবেষণার ইতিহাস সম্পাদনা

১৯৬১ সালে সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ কার্ল সেগান শুক্র গ্রহে গ্রহীয় পূর্তবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার একটি প্রস্তাব দেন।[২] সেগান কল্পনা করেছিলেন, শুক্রের বায়ুমণ্ডলে অ্যালজি রোপণ করলে তা জল, নাইট্রোজেনকার্বন ডাই-অক্সাইডকে জৈব উপাদানে পরিণত করবে। এই প্রক্রিয়া যখন বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড দূরীভূত হবে, তখন যতক্ষণ না শুক্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা "আরামদায়ক" স্তরে নেমে আসছে, ততক্ষণ গ্রিনহাউস প্রভাবও কমে আসবে। সেগানের মতে, এর ফলে যে কার্বন উৎপন্ন হবে তা শুক্র-পৃষ্ঠতলের উচ্চ তাপমাত্রায় ভস্মীভূত হবে এবং এর ফলে ওই গ্রহের পৃষ্ঠতলে "গ্র্যাফাইট অথবা কার্বনের কোনও অনুদ্বায়ী রূপে" বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।[৩] যদিও পরবর্তীকালে শুক্রের যে পরিবেশ আবিষ্কৃত হয়, তার প্রেক্ষিতে এই প্রক্রিয়াটির প্রয়োগ অসম্ভব। একটি সমস্যা এই যে মঙ্গলের মেঘগুলি উচ্চমাত্রায় কেন্দ্রীভূত সালফিউরিক অ্যাসিডের দ্রবণে গঠিত। বায়ুমণ্ডলীয় অ্যালজি যদি শুক্রের উপরের বায়ুমণ্ডলের প্রতিকূল পরিবেশে সাফল্য অর্জন করেও, তবু আরও অনতিক্রমণীয় সমস্যাটি হল এই যে, এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল অতিমাত্রায় ঘন—উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ফলে "প্রায় বিশুদ্ধ আণবিক অক্সিজেন-সমৃদ্ধ এক বায়ুমণ্ডল" সৃষ্টি হবে এবং তার ফলে গ্রহের পৃষ্ঠভাগে সূক্ষ্ম গ্র্যাফাইটের গুঁড়োর পুরু আস্তরণ পড়ে যাবে।[৩] এই উদ্বায়ী যৌগিক গঠন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জৈব আকারে স্থিত যে কোনও কার্বন দহনের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড রূপে মুক্তিলাভ করে। এর ফলে পৃথিবীকরণ প্রক্রিয়াটি "শর্ট-সার্কিট" হয়ে যায়।[৩]

ইকারাস পত্রিকায় প্রকাশিত "প্ল্যানেটারি ইঞ্জিনিয়ারিং অন মার্স" (১৯৭৩) পত্রিকায় সেগান মঙ্গল গ্রহকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার একটি ধারণা দিয়েছিলেন।[৪] তিন বছর পরে নাসা সরকারিভাবে গ্রহীয় পূর্তবিজ্ঞানের বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করে। তবে এক্ষেত্রে গ্রহীয় পূর্তবিজ্ঞানের পরিবর্তে "প্ল্যানেটারি ইকোসিন্থেসিস" বা "গ্রহীয় বাস্তুসংশ্লেষণ" পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়।[৫] এই পর্যালোচনা থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মঙ্গল গ্রহে প্রাণধারণ সম্ভব এবং এই গ্রহকে একটি বাসযোগ্য গ্রহে পরিণত করা যায়। সেই বছরই পৃথিবীকরণ নিয়ে প্রথম আলোচনাসভা আয়োজিত হয়। সেই সময় অবশ্য পৃথিবীকরণ বিষয়টি "প্ল্যানেটারি মডেলিং" বা "গ্রহীয় মডেলিং" নামে অভিহিত হত।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Science Fiction Citations: terraforming"। ২০১৪-০৪-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৬-১৬ 
  2. Sagan, Carl (১৯৬১)। "The Planet Venus"। Science133 (3456): 849–58। ডিওআই:10.1126/science.133.3456.849পিএমআইডি 17789744বিবকোড:1961Sci...133..849S 
  3. Sagan 1997, pp. 276–7.
  4. Sagan, Carl (১৯৭৩)। "Planetary Engineering on Mars"। Icarus20 (4): 513। ডিওআই:10.1016/0019-1035(73)90026-2বিবকোড:1973Icar...20..513S 
  5. Averner& MacElroy, 1976

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা