পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ছিল ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কারাগার। এটি পুরান ঢাকার চানখাঁরপুলে অবস্থিত। ঢাকা বিভাগের এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের এখানে দন্ডপ্রদানের জন্য আটক রাখা হত। এছাড়াও ঢাকা শহরের বিভিন্ন থানার মামলায় বিচারাধীন আসামী এবং বিচারকালীন সময়ে আটক রাখার স্থান হিসেবেও কারাগারটি ব্যবহৃত হত। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এই কারাগারে আটক জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়।

পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক
মানচিত্র
অবস্থানঢাকা
স্থানাঙ্ক২৩°৪৩′০৭″ উত্তর ৯০°২৩′৫৩″ পূর্ব / ২৩.৭১৮৬° উত্তর ৯০.৩৯৮১° পূর্ব / 23.7186; 90.3981
অবস্থাপরিত্যক্ত
খোলা হয়১৭৮৮
বন্ধকরণ২০১৬

ইতিহাস সম্পাদনা

ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে কোন কারাগার ছিল না। তবে ঢাকায় একটি মোঘল দুর্গ ছিল। ১৭৮৮ সালের গোড়ার দিকে, দুর্গটি সংস্কার করে এর ভেতর একটা ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে এই কারাগারের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৩৩ সালের এক রেকর্ডে দেখা যায় এই ক্রিমিনাল ওয়ার্ড এর ধারণক্ষমতা ছিল ৮০০। তবে এই ক্রিমিনাল ওয়ার্ডে গড়ে ৫২৬ জন বন্দি থাকতো। এক পর্যায়ে পুরো দূর্গটিকে কারাগারে রূপান্তর করা হয়। ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত কোতোয়ালী থানা এই কারাগারে অবস্থিত ছিল। তখন এটি ঢাকা কারাগার নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার তৎকালীন কমিশনার চার্লস বাকল্যান্ড কুমিল্লায় একটি কেন্দ্রীয় কারাগার গঠনের প্রস্তাব দেন। তখন তার প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। পরে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত করা হয়। তখন চট্টগ্রাম বিভাগকেও এই কারাগারের আওতায় আনা হয়। ১৯০২ সালে এটি পরিপূর্ণ কারাগার হিসেবে রূপ পায়। তখন এখানে আড়াই হাজার বন্দী থাকতো। পরে ১৯৪৭ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে পূর্ব বাংলার প্রধান কেন্দ্রীয় কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়।

স্থানান্তর সম্পাদনা

জাতীয় প্রয়োজনে ২২৮ বছর পর ২০১৬ সালের ২৯ শে জুলাই এ কারাগারটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জে নতুন করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ করা হয়। তখন এই কারাগারে ৬ হাজারের বেশি বন্দী আটক ছিল।

ওয়ার্ড ও এলাকা সম্পাদনা

পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত ছিল। অপ্রাপ্তবয়স্ক, বৃদ্ধ ও মহিলাদের পৃথক রাখা হত। বিদেশী নাগরিকদের জন্যও পৃথক স্থান ছিল। সাড়ে ৬ হাজার বন্দীর ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট এই কারাগার ৩৮ একর জায়গার উপর বিস্তৃত ।

  1. আমদানী
  2. বহির্গমন
  3. কেস টেবিল
  4. খাতা
  5. সেল
  6. তৎকালীন কোতোয়ালী থানা (পরবর্তীতে জেল হাসপাতাল )
  7. ফরেন সেড
  8. মেন্টাল
  9. দফা
  10. চৌকা
  11. কনডেম সেল
  12. ফাঁসির মঞ্চ

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পাদনা

পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার কারাস্মৃতিজড়িত এই স্থাপনা জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানে তৈরি হবে পার্ক, মাঠ, কমিউনিটি সেন্টারসহ নানান নাগরিক সুবিধা।[১]

উল্লেখযোগ্য বন্দী সম্পাদনা

রাজনৈতিক বন্দী সম্পাদনা

  1. শেখ মুজিবুর রহমান - বাংলাদেশের জাতির জনক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি। ১২ বছরের কারাবন্দী জীবনে বিভিন্ন মেয়াদে ১০ বছর তিনি এই কারাগারে কাটিয়ে ছিলেন।
  2. সৈয়দ নজরুল ইসলাম - জাতীয় চার নেতার একজন। বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। উক্ত কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর অন্য তিন নেতার সাথে তাকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়।
  3. তাজউদ্দীন আহমদ - জাতীয় চার নেতার একজন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। উক্ত কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর অন্য তিন নেতার সাথে তাকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়।
  4. মুহাম্মদ মনসুর আলী - জাতীয় চার নেতার একজন। বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী ও তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। উক্ত কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর অন্য তিন নেতার সাথে তাকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়।
  5. আ হ ম কামারুজ্জামান - জাতীয় চার নেতার একজন। বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি। উক্ত কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর অন্য তিন নেতার সাথে তাকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়।

বন্দী (মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) সম্পাদনা

  1. সৈয়দ ফারুক রহমান - বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর উক্ত কারাগারে ২৮ শে জানুয়ারি ২০১০ সালে রাত ১২:২০ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  2. সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান - বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়ার পর উক্ত কারাগারে ২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে রাত ১২:২০ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  3. বজলুল হুদা - বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর উক্ত কারাগারে ২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে রাত ১২:৫০ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  4. মহিউদ্দিন আহমেদ (সেনা কর্মকর্তা) - বঙ্গবন্ধুকে সুপরিবারে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর উক্ত কারাগারে ২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে রাত ১:৩০ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  5. এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ - বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর উক্ত কারাগারে ২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে রাত ১২:৫০ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  6. আবু তাহের - অবৈধ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর শাসনামলে রাষ্ট্রবিরোধিতা ও বিদ্রোহের অভিযোগে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

বন্দী (দণ্ডপ্রাপ্ত) সম্পাদনা

  1. মো.শাহজাহান ভুঁইয়া - দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় ৪৪ বছরের কারাবন্দী ও শীর্ষ জল্লাদ। ৪৪ বছরের কারাজীবনের ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২১ বছর তিনি এই কারাগারে কাটিয়েছেন। উক্ত কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি, তিন যুদ্ধাপরাধী ও অন্যান্য হত্যা মামলার বন্দীদের ফাঁসি কার্যকর করেন তিনি।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী সম্পাদনা

  1. আব্দুল কাদের মোল্লা - যুদ্ধাপরাধের দায়ে উক্ত কারাগারে ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর রাত ১০ঃ০১ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  2. মুহাম্মদ কামারুজ্জামান - যুদ্ধাপরাধের দায়ে উক্ত কারাগারে ২০১৫ সালের ১১ই এপ্রিল রাত ১০ঃ৩১ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  3. সাকা চৌধুরী - যুদ্ধাপরাধের দায়ে উক্ত কারাগারে ২০১৫ সালের ২২শে নভেম্বর রাত ১২ঃ৫৫ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  4. এ.এ.এম মুজাহিদ - যুদ্ধাপরাধের দায়ে উক্ত কারাগারে ২০১৫ সালের ২২শে নভেম্বর রাত ১২ঃ৫৫ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
  5. মতিউর রহমান নিজামী - যুদ্ধাপরাধের দায়ে উক্ত কারাগারে ১১ মে ২০১৬ সালের রাত ১২ঃ১০ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারকালীন বন্দী সম্পাদনা

  1. ফজলুল কাদের চৌধুরী - উক্ত কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়।
  2. গোলাম আজম - উক্ত কারাগারে ১১ জানুয়ারি ২০১২ সালে কিছু সময়ের জন্য তিনি আটক ছিলেন।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত বন্দী সম্পাদনা

  1. কে.এম আমিনুল হক - ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের ৪০ বছরের শাস্তির ১০ বছর তিনি এই কারাগারে কাটিয়ে ছিলেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা