পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী[১] হল প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি বিখ্যাত উপন্যাস। বাংলার গ্রামে দুই ভাইবোন অপু আর দুর্গার বেড়ে ওঠা নিয়েই বিখ্যাত এই উপন্যাস। এই উপন্যাসের ছোটোদের জন্য সংস্করণটির নাম আম আঁটির ভেঁপু। পরবর্তীকালে বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসটি অবলম্বনে পথের পাঁচালী (চলচ্চিত্র) নির্মাণ করেন যা পৃথিবী-বিখ্যাত হয়।[২]
লেখক | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় |
---|---|
দেশ | ভারত |
ভাষা | বাংলা |
ধরন | বিয়োগান্তক, পারিবারিক কাহিনি |
প্রকাশক | রঞ্জন প্রকাশলয় |
প্রকাশনার তারিখ | ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ (১৯২৯ খ্রি) |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | ২৪০ |
পরবর্তী বই | অপরাজিত |
সমগ্র উপন্যাসটি তিনটি খণ্ড ও মোট পঁয়ত্রিশটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। খণ্ড তিনটি যথাক্রমে বল্লালী বালাই (পরিচ্ছেদ ১-৬; ইন্দির ঠাকরূনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে), আম-আঁটির ভেঁপু (পরিচ্ছেদ ৭-২৯; অপু-দুর্গার একসাথে বেড়ে ওঠা, চঞ্চল শৈশব, দুর্গার মৃত্যু, অপুর সপরিবারে কাশীযাত্রা চিত্রিত হয়েছে) ও অক্রূর সংবাদ (পরিচ্ছেদ ৩০-৩৫; অপুদের কাশীজীবন, হরিহরের মৃত্যু, সর্বজয়ার কাজের জন্য কাশীত্যাগ এবং পরিশেষে নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে)।
প্রকাশনার ইতিহাস
সম্পাদনাবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পথের পাঁচালী উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন অধুনা বিহারের ভাগলপুরে থাকাকালীন। সেই সময় তিনি খেলাত ঘোষ এস্টেটের ম্যানেজারের পদে কর্মরত ছিলেন। কার্যোপলক্ষ্যে জঙ্গল লিজ দেওয়ার জন্য তাঁকে ভাগলপুর জেলার জঙ্গলমহলে ঘুরতে হত। ভাগলপুরের ‘বড়বাসা’তে ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে তিনি পথের পাঁচালী রচনার কাজে হাত দেন। প্রথমে তিনি এই উপন্যাসের দুর্গা চরিত্রটির কথা ভাবেননি। ভাগলপুরেই একদিন বিকেলে এক দেহাতি গ্রাম্য কিশোরীকে দেখতে পান তিনি। মেয়েটির মাথায় তেলহীন রুক্ষ চুল হাওয়ায় উড়ছিল। এই মেয়েটিকে দেখেই তিনি দুর্গার চরিত্র কল্পনা করেন। ফলে তাঁকে উপন্যাসটি আবার নতুন করে লিখতে হয়। ‘বড়বাসা’তে থাকাকালীনই ১৯২৮ সালের ২৬ এপ্রিল তারিখে তিনি উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করেন এবং তখনই তা প্রেরণ করেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিকপত্র বিচিত্রা-য় প্রকাশের জন্য। উক্ত পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা থেকে উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে (১৯২৮-২৯)। উল্লেখ্য, এই সময়ই বিচিত্রা-য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগাযোগ (১৯২৭-২৮) উপন্যাসটি। ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রঞ্জন প্রকাশনালয় থেকে সজনীকান্ত দাস কর্তৃক পথের পাঁচালী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।[৩] ১৯৩২ সালে এক মাসের ব্যবধানে (মাঘ-ফাল্গুন, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ) অপরাজিত উপন্যাসটি দুই ভাগে সজনীকান্ত দাস কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। পরিবেশক ছিল প্রখ্যাত পুস্তকবিক্রেতা সংস্থা পি. সি. সরকার। দুই খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পরে তা একত্রে বাঁধাই করে অপরাজিত এক খণ্ডে প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত রচনার সঙ্গে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত পথের পাঁচালী ও অপরাজিত উপন্যাসের পাঠে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। অপরাজিত প্রকাশিত হওয়ার প্রায় ত্রিশ বছর পরে বিভূতিভূষণের পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক রচিত এই ধারাবাহিকের তৃতীয় উপন্যাস কাজল প্রকাশিত হয় (আষাঢ় ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ)। বেঙ্গল পাবলিশার্স বিভাজনের পর মনোজ বসু ও শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মোট চারটি প্রকাশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মনোজ বসু বেঙ্গল পাবলিশার্স ও গ্রন্থপ্রকাশ নামে দু’টি প্রকাশনা এবং শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রকাশভবন ও বাকসাহিত্য নামে দু’টি প্রকাশনা চালু করেন। মনোজ বসুর পুত্র ময়ূখ বসু গ্রন্থপ্রকাশ থেকে পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও কাজল তিনটি উপন্যাস একত্রে অপু শিরোনামে প্রকাশ করেন (নতুন মুদ্রণ, ফাল্গুন ১৩৮৭ বঙ্গাব্দ)।[৪] এটিই ছিল বিভূতিভূষণেরর লেখা প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস।[৫]
কাহিনি
সম্পাদনাহরিহর রায়, খুব ভালো ব্রাহ্মণ নন, নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে থাকেন। হরিহর রায়ের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ইন্দিরা ঠাকুর এসে হরিহরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তিনি এক বৃদ্ধ বিধবা, যার দেখাশোনা করার জন্য কেউ ছিল না। কিন্তু হরিহরের স্ত্রী সর্বজয়া ছিল একজন বদমেজাজী মহিলা, যিনি ইন্দিরাকে সহ্য করতে পারেন না। তাই বৃদ্ধাকে বসবাসের জন্য একটি কুঁড়েঘর দেওয়া হয়। তবে সর্বজয়ার ছয় বছরের মেয়ে দুর্গা, ইন্দিরা ঠাকুরকে খুব ভালোবাসে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সাথে বসে রূপকথা শুনে।
কিছুদিন পর সর্বজয়ার এক পুত্র হয়। সর্বজয়া, ইন্দিরা ঠাকুরকে হিংসা করতে থাকেন কারণ তিনি মনে করেন যে দুর্গা সর্বজয়ার চেয়ে ইন্দিরাকেই বেশি ভালোবাসে। তাই ইন্দিরা ঠাকুরকে সামান্য কারণে নির্মমভাবে কুঁড়েঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। অসহায় বৃদ্ধা তার মৃত্যুর মুহূর্তে আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করে, কিন্তু সর্বজয়া হৃদয়হীনভাবে না করে দেয় এবং বৃদ্ধা চালের গুদামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
চার-পাঁচ বছর পর, সর্বজয়ার ছেলে অপু, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রহস্যের প্রতি অত্যন্ত কৌতূহলী ও সংবেদনশীল হতে থাকে। সে ও তার বোন দুর্গা সর্বদা নতুন নতুন দুঃসাহসিক কাজ, যেমন: জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, আদিবাসী খেলায় অংশগ্রহণ করা এবং গোপনে ফুল ও ফল পাড়া প্রভৃতির জন্য বাইরে ঘুরতে বের হতে থাকে। অপু গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হয়, যেখানে গ্রামের অনেক প্রবীণ জড়ো হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে সময় কাটাত। অপুকে একদিন তার বাবা এক মক্কেলের বাড়িতে নিয়ে যায়। অপু এই প্রথম বাইরের জগতের ঝলক দেখতে পায় যা তার মনকে আনন্দ ও উত্তেজনায় ভরিয়ে তোলে। গ্রাম্য উৎসব, মেলা, যাত্রা ইত্যাদি গ্রাম্য জীবনের একচেটিয়া প্রবাহে বৈচিত্র্য ও রোমাঞ্চ নিয়ে আসে। অস্থির কিন্তু পুরোপুরি নির্দোষ মেয়ে দুর্গা হঠাৎ করে মারা যায়, যা পুরো পরিবারকে শোকে ডুবিয়ে দেয় এবং তার ছোটো ভাইকে একা করে দেয়। হরিহর দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ও জীবিকা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে সংগ্রাম করতে থাকে। বাড়ি ফেরার পর হরিহর নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা সব গোছগাছ করে রেলওয়ে স্টেশনে যায়। ট্রেন ছাড়লে তারা ট্রেনে উঠে এবং তাদের সুখ-দুঃখের সকল স্মৃতি চিরকালের মতো পেছনে রেখে যায়।
অন্তর্ভুক্তি
সম্পাদনাউপন্যাসের ৮ম পরিচ্ছেদটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এর নবম-দশম শ্রেণির 'মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য' সংকলনে 'আম-আঁটির ভেঁপু' শিরোনামে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।[৬]
অনুবাদ
সম্পাদনাপথের পাঁচালী ১৯৬০ সালে একই নামে তেলুগু ভাষায় প্রথম অনূদিত এবং প্রকাশিত হয়। এটি অনুবাদ করেন মাদিপাতলা সুরি। পরে এটি চিন্থা লক্ষ্মী সিংহরাচি কর্তৃক মাওয়াতে গীতা নামে সিংহলী ভাষায় অনূদিত হয় এবং ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। এটি শ্রীলঙ্কায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় এবং একই অনুবাদক অপু ত্রয়ীর অন্য দুটি বইয়ের অনুবাদও সম্পন্ন করেন।
'পথের পাঁচালী' মালয়ালম ভাষায় 'পথের পাঁচালী - পাথায়ুউদয় সঙ্গীতম' নামে অনূদিত হয়, যা ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে গ্রীন বুকস প্রাইভেট লিমিটেড, ত্রিচুর কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
ইউনেস্কোর প্রতিনিধিত্বমূলক কাজের অংশ হিসেবে টি ডব্লিউ ক্লার্ক ও তারাপদ মুখোপাধ্যায় উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যা ১৯৬৮ সালে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত হয়।[৭] ১৯৭৬ সালে কে রায় ও মার্গারেট চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসটির একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন।
সাতাশ ফেব্রুয়ারি এবং ৩ মার্চ ২০১৩ সালে উপন্যাসটির একটি অভিযোজন বিবিসি রেডিও ৪-এ একটি "ধ্রুপদী ধারাবাহিক" হিসাবে সম্প্রচার করা হয়।[৮]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ পথের পাঁচালী, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, আইএসবিএন ০-১৯-৫৬৫৭০৯-৮
- ↑ সৌমিত্র শেখর (২০১২)। "পথের পাঁচালী"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ রবিনসন, অ্যান্ড্রু (১৯৮৯)। Satyajit Ray: The Inner Eye । ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ৭৪। আইএসবিএন 978-0-520-06946-6।
- ↑ বাংলা উপন্যাসে ট্রিলজি, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১১-১২, ১৪
- ↑ Encyclopaedia of Indian literature। ১। সাহিত্য আকাদেমি। ১৯৮৭। পৃষ্ঠা ৩৬৫। আইএসবিএন 81-260-1803-8। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১১-২৭।
- ↑ "জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)"। www.nctb.gov.bd (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০১-০৮।
- ↑ "Pather Panchali. Song of the Road"। অ্যালেন এবং আনউইন - ইউনেস্কো (এবং ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ব্লুমিংটন এবং লন্ডন)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৯-১৩।
- ↑ "Pather Panchali--Song of the Road"। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৩।