পঞ্চম বেদ
পঞ্চম বেদ ধারণাটির মাধ্যমে এমন একটি ধর্মগ্রন্থকে বোঝায় যেটি চারটি আনুশাসনিক বেদের অন্তর্গত না হলেও গুরুত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে বেদের সমতুল্য। বেদ-উত্তর যুগে রচিত একাধিক ধর্মগ্রন্থকে পঞ্চম বেদ বলে দাবি করা হয়। হিন্দুধর্মে এই ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মগ্রন্থগুলিকে বেদের নিত্যতা ও সার্বভৌমত্বের সমতুল্য জ্ঞান করা হয়।[১] এই ধারণাটি প্রাচীন। উপনিষদে প্রথম এই ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে আধুনিক সংস্কৃত ও অ-সংস্কৃত ভাষায় রচিত একাধিক গ্রন্থকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ: পঞ্চম বেদ
সম্পাদনাছান্দোগ্য উপনিষদে (৭।১। ২) প্রথম পঞ্চম বেদের উল্লেখ পাওয়া যায়।[২] এই উপনিষদে ইতিহাস ও পুরাণকে পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে,
- "ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদম্"
‘ইতিহাস’ শব্দটি এখানে ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ, মহাভারতেই এই গ্রন্থটিকে ‘পঞ্চম বেদ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৩] বেদের সংকলক ব্যাসদেবকে মহাভারতের রচয়িতা মনে করা হয়। মহাভারতে বলা হয়েছে, এই মহাকাব্য নতুন যুগের নতুন বেদ। এটি সকল ব্যক্তির উপযুক্ত এবং চতুর্বেদের সমতুল্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেদ অপেক্ষাও মহত্তর।[৪] অপর সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণকেও পঞ্চম বেদ বলে দাবি করা হয়।[১]
পুরাণ সাহিত্যেও একই ধরনের দাবি করা হয়েছে। পুরাণগুলিতে ইতিহাসের সঙ্গে বা ইতিহাস ছাড়াই নিজেদের পঞ্চম বেদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে পুরাণে ‘পুরাণ বেদ’ কথাটি পাওয়া যায়।[৫] ভাগবত পুরাণে ছান্দোগ্য উপনিষদের বক্তব্যটিকে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ব্রহ্মার চার মুখ থেকে চার বেদ উৎপন্ন হয়। তারপর তার পঞ্চম মুখ[১] বা সকল মুখ থেকে ইতিহাস-পুরাণের সৃষ্টি।[৬] এরপর ভাগবত পুরাণ নিজেকে ব্যাসদেবের শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে শ্রেষ্ঠ পুরাণ বলে ঘোষণা করেছে।[৫] স্কন্দপুরাণেও একই ভাবে বলা হয়েছে যে পুরাণ সাহিত্য পঞ্চম বেদ এবং সেই জন্য এই সাহিত্যের ধর্মগ্রন্থ হওয়ার যোগ্যতা আছে।[১][৭]
নাট্যশাস্ত্র নামে একটি কলাতত্ত্ব নিজেকে পঞ্চম বেদ বলেছে (১। ৪)। যদিও এটি প্রথাগতভাবে গন্ধর্ববেদ নামে একটি সামবেদীয় উপবেদ। নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে, এটি ব্রহ্মার কথিত এবং এতে চার বেদের সব উপকরণই আছে। চার বেদ সকল বর্ণের জন্য নয়। কিন্তু নাট্যশাস্ত্র সবার জন্য।[৮] নাট্যশাস্ত্রের মূল উপজীব্য হল ধর্মীয় উপাখ্যানগুলিকে নাটক বা সংগীতের মাধ্যমে উপস্থাপিত করে মানুষকে পবিত্র চিন্তার দিকে টেনে আনা।[৯]
পঞ্চম বেদ রূপে গণ্য অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদ।[১০]
অ-সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ: বৈদিকায়ণ
সম্পাদনাস্থানীয় ভাষায় লেখা একাধিক ধর্মগ্রন্থকে বেদের সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৭শ শতাব্দীতে অবধি ভাষায় রচিত রামায়ণ রামচরিতমানস কাব্যটিকে ভক্তেরা পঞ্চম বেদ বা হিন্দি বেদ মর্যাদা দেন। তারা মনে করেন, কলিযুগে এই গ্রন্থ বেদের সমতুল্য বা বেদ অপেক্ষা মহত্তর।[১১][১২]
একাধিক তামিল গ্রন্থকে অনুগামীরা নতুন বেদ, তামিল বেদ বা দ্রাবিড় বেদ বলে থাকেন। তামিল বৈষ্ণব ভক্তিবাদী সম্প্রদায় আলোয়ারগণ তিরুবায়মোলি গ্রন্থটিকে এই মর্যাদা দিয়ে থাকেন।[১৩] পরবর্তীকালে সাধারণভাবে দিব্য প্রবন্ধম এই মর্যাদা পেয়েছে। লীলাতিলকম নামে ১৪শ শতাব্দীর কেরল মণিপ্রবলম ব্যাকরণ গ্রন্থের মতো ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থও এই দাবি করেছে।[১৪] নাট্যশাস্ত্রের মতো,[১৫] লেখকেরা তিরুবায়মোঝি গ্রন্থের মতো গ্রন্থকেও পঞ্চম বেদ বলেছেন। তাদের মতে, চার বেদ শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্য। কিন্তু এই নতুন তামিল বেদ সকল বর্ণের জন্য রচিত।[১৬] একই ভাবে তামিল শৈব সম্প্রদায় তেবরম নামে স্তোত্র সংগ্রহকে তামিল বেদ বলেছেন।[১৭] তামিল শৈবরা যেমন তেবরমকে সংস্কৃত বেদের সমতুল্য মর্যাদা দিয়েছেন, তেমনই বৈষ্ণবরা তাদের ধর্মগ্রন্থকে অনুরূপ মর্যাদা দিয়েছেন।[১৮] শেষ পর্যন্ত তিরুক্কুরাল নামে একটি নীতিবাদী উক্তিসঞ্চয়নকে তামিল বেদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তিরুবল্লুবমালাইতে। এটি সম্ভবত প্রথম শতাব্দীর রচনা।[১৯] বইটি তামিল বেদ নামেই পরিচিত।[২০]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ Smith, Brian K. (আগস্ট ১৯৮৭)। "Exorcising the Transcendent: Strategies for Defining Hinduism and Religion"। History of Religions। 27 (1): pp. 32–55। জেস্টোর 1062532। ডিওআই:10.1086/463098। at p. 46.
- ↑ Lidova, Natalia R. (Autumn ১৯৯৭)। "Review of: The Vernacular Veda: Revelation, Recitation and Ritual by Vasuda Narayanan"। Journal of the American Academy of Religion। 65 (3): pp. 681–684। জেস্টোর 1465662। at p. 684
- ↑ Fitzgerald, James (১৯৮৫)। "India's Fifth Veda: The Mahabharata's Presentation of Itself"। Journal of South Asian Literature। 20 (1): pp. 125–140।
- ↑ Sullivan, Bruce M. (অক্টোবর ১৯৯৪)। "The Religious Authority of the Mahābhārata: Vyāsa and Brahmā in the Hindu Scriptural Tradition"। Journal of the American Academy of Religion। 62 (2): pp. 377–401। জেস্টোর 1465271। ডিওআই:10.1093/jaarel/LXII.2.377। at p. 385.
- ↑ ক খ Holdrege, Barbara A. (২০০০)। "Mystical Cognition and Canonical Authority: The Devotional Mysticism of the Bhagavata Purana"। Katz, Steven T.। Mysticism and Sacred Scripture। New York: Oxford University Press। পৃষ্ঠা pp. 184–209। আইএসবিএন 978-0-19-509703-0। at pp. 193-196.
- ↑ Bhagavata Purana, 3.12.37-3.12.39.
- ↑ Skandapurana 5.3.1.18 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে: purāṇaṃ pañcamoveda iti brahmānuśasanaṃ
- ↑ Ley, Graham (২০০০)। "Aristotle's Poetics, Bharatamuni's Natyasastra, and Zeami's Treatises: Theory as Discourse"। Asian Theatre Journal। 17 (2): pp. 191–214। ডিওআই:10.1353/atj.2000.0020। at pp. 194-195.
- ↑ Bahm, Archie J. (১৯৬৫)। "Comparative Aesthetics"। The Journal of Aesthetics and Art Criticism। The Journal of Aesthetics and Art Criticism, Vol. 24, No. 1। 24 (1): pp. 109–119। জেস্টোর 428253। ডিওআই:10.2307/428253। at p. 110.
- ↑ Larson, Gerald James (জুলাই ১৯৮৭)। "Ayurveda and the Hindu Philosophical Systems"। Philosophy East and West। Philosophy East and West, Vol. 37, No. 3। 37 (3): pp. 245–259। জেস্টোর 1398518। ডিওআই:10.2307/1398518।
- ↑ Lamb, Ramdas (১৯৯১)। "Personalizing the Ramayan: Ramnamis and Their Use of the Ramcaritmanas"। Richman, Paula। Many Ramayanas: The Diversity of a Narrative Tradition in South Asia। Berkeley: University of California Press। পৃষ্ঠা pp. 235–251। আইএসবিএন 978-0-520-07589-4। at pp. 237-238.
- ↑ Lutgendorf, Philip (১৯৯০)। "The Power of Sacred Story: Ramayana Recitation in Contemporary North India"। Ritual and Power: Special issue of the Journal of Ritual Studies। 4 (1): pp. 115–147। .
- ↑ Clooney, Francis X. (এপ্রিল ১৯৯২)। "Extending the Canon: Some Implications of a Hindu Argument about Scripture"। The Harvard Theological Review। 85 (2): pp. 197–215। .
- ↑ Freeman, Rich (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)। "Rubies and Coral: The Lapidary Crafting of Language in Kerala"। The Journal of Asian Studies। The Journal of Asian Studies, Vol. 57, No. 1। 57 (1): pp. 38–65। জেস্টোর 2659023। ডিওআই:10.2307/2659023। at p. 57.
- ↑ The similarity between the vedicisation of the Tiruvaymozhi and earlier moves to declare Sanskrit texts as the "Fifth Veda" is pointed out in Lidova, Natalia R. (Autumn ১৯৯৭)। "Review of: The Vernacular Veda: Revelation, Recitation and Ritual by Vasuda Narayanan"। Journal of the American Academy of Religion। 65 (3): pp. 681–684। জেস্টোর 1465662। at pp. 683-684.
- ↑ Narayanan, Vasudha (১৯৯৪)। The Vernacular Veda: Revelation, Recitation, and Ritual। Studies in Comparative Religion। University of South Carolina Press। পৃষ্ঠা p. 26। আইএসবিএন 0-87249-965-0।
- ↑ Peterson, Indira V. (১৯৮২)। "Singing of a Place: Pilgrimage as Metaphor and Motif in the Tēvāram Songs of the Tamil Śaivite Saints"। Journal of the American Oriental Society। Journal of the American Oriental Society, Vol. 102, No. 1। 102 (1): pp. 69–90। জেস্টোর 601112। ডিওআই:10.2307/601112। at p. 77.
- ↑ Cutler, Norman; Peterson, Indira Viswanathan; Piḷḷāṉ; Carman, John; Narayanan, Vasudha; Pillan (১৯৯১)। "Tamil Bhakti in Translation"। Journal of the American Oriental Society। Journal of the American Oriental Society, Vol. 111, No. 4। 111 (4): pp. 768–775। জেস্টোর 603406। ডিওআই:10.2307/603406। at p. 770.
- ↑ Blackburn, Stuart (মে ২০০০)। "Corruption and Redemption: The Legend of Valluvar and Tamil Literary History"। Modern Asian Studies। 34 (2): pp. 449–482। ডিওআই:10.1017/S0026749X00003632। at p. 454.
- ↑ Cutler, Norman (১৯৯২)। "Interpreting Tirukkuṟaḷ: The Role of Commentary in the Creation of a Text"। Journal of the American Oriental Society। Journal of the American Oriental Society, Vol. 112, No. 4। 112 (4): pp. 549–566। জেস্টোর 604470। ডিওআই:10.2307/604470। at p. 550.