কাঁচাগোল্লা

নাটোর জেলার এক ধরণের মিষ্টান্ন
(নাটোরের কাঁচা গোল্লা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

কাঁচাগোল্লা বা নাটোরের কাঁচাগোল্লা বাংলাদেশের নাটোর জেলায় উৎপন্ন দুধ দিয়ে তৈরি এক প্রকার মিষ্টান্ন। এই মিষ্টান্নটি গরুর দুধ হতে প্রাপ্ত কাঁচা ছানা হতে প্রস্তুত করা হয় বলে এটি কাঁচাগোল্লা বলে পরিচিত।[২] যদিও নাটোরে এর উৎপত্তি হয়, তবে নাটোর ছাড়াও বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এই মিষ্টি পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের কিছু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারেও এই মিষ্টি প্রস্তুত করা হয়। ০৮ই আগস্ট ২০২৩ তারিখে দেশের ১৭ নং জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লা।[৩]

কাঁচাগোল্লা
নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা
প্রকারমিষ্টি
উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ[১]
অঞ্চল বা রাজ্যনাটোর
প্রধান উপকরণদুধ, এলাচ, চিনি, পানি, সিরকা[১]

ইতিহাস সম্পাদনা

কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির রয়েছে চমৎকার কাহিনী। জনশ্রুতি আছে নিতান্ত দায়ে পরেই নাকি তৈরী হয়েছিল এই মিষ্টি। নাটোর শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান।[৪] দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল। মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দু’মণ ছানা দিয়ে পানতোয়া, চমচম, কালো জাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন দশ পনেরজন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনিমেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তা ভাবনা।

যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর পূর্বে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়েছে, কিন্তু রসগোল্লার ছানাকে তেলে ভেজে চিনির রসে ডোবানো হয়। তাই তার নাম করণ হয়েছে রসগোল্লা। এটা কাঁচা ছানার রসে ডোবানো হয়েছে বলেই এর নাম দেয়া হলো কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ যা অন্য কোন মিষ্টিতে পাওয়া যায়না। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচাগোল্লার চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে মুধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মন ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরী হতে লাগল। সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লা কথা।

দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লা সম্পাদনা

১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রাণী ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে।[৪][৫] সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানিতোয়া প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজ পরিবার পর্যন্ত এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র। রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে।

কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ও এই দুই শহরের ঘনিষ্ঠ সার্বক্ষনিক যোগাযোগ থাকায় নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ছড়িয়ে পরে। এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিকতা।[৪]

প্রস্তুত প্রণালী সম্পাদনা

এটি তৈরি উপকরণসমূহ হচ্ছে: ছানা, মাওয়া, এলাচগুঁড়া, চিনি। মাওয়ার জন্য: দুধ, ঘি, পানি

কাঁচা গোল্লা প্রধানত দুই ধাপে তৈরি হয়:

দুধ থেকে ছানা তৈরি সম্পাদনা

১ম ধাপে দুধ ও পানি একত্রে মিশিয়ে একটি কড়াইতে জ্বাল দিতে হয়। মিশ্রণ ফুটতে থাকলে নাড়তে হয়। ৫ থেকে ৬ মিনিট পরে অল্প অল্প করে সিরকা মিশাতে হবে এবং নাড়তে হয়। দুধ জমাট বাঁধতে শুরু করলে ও যখন হালকা নরম হয় তখন সবুজ রঙের পানি আলাদা হবে, তখন পাত্রটি নামাতে হয়। ছানার পানি ঝরাতে তা একটি ঝাঁঝারিতে রাখতে হয়।

পরবর্তীতে ছানা একটি সিল্কের কাপড়ে বেঁধে সারা রাত ঝুলিয়ে রাখা হয়। এসময় কাপড় পেঁচিয়ে চাপ প্রয়োগ করেও পানি বের করা হয়। পানি বের করে ছানা একটি কাঠের পাটাতনে রেখে হাতের চাপ প্রয়োগ করে মিহি ছানা তৈরি করা হয়।

ছানা থেকে কাঁচাগোল্লা তৈরি সম্পাদনা

২য় ধাপে ছানা ৩ ভাগে ভাগ করতে হয়। প্রথমে ২ ভাগ একটি পাত্রে মাঝারি আঁচে জ্বাল দিতে হয়। ছানার পানি বেরিয়ে আসলে হালকা নরম হলে মৃদু আঁচে অল্প চিনি দিয়ে জ্বাল দিতে হয়। কিছুক্ষন পরে চিনি মিশ্রিত ছানা আঠালো ভাব নেয় তখন বাকি ১ ভাগ ছানা মিশিয়ে নাড়তে হয়। এ সময় ক্রিম ও এলাচ গুঁড়া মিশিয়ে জ্বাল দিতে হয়। কিছু পরে হালকা গরম থাকতেই মসৃণ করে ছেঁকে ঠান্ডা করতে হয়। এরপর ঐ তৈরি মিষ্টান্নকে গুড়ো গুড়ো অবস্থায় কাঁচাগোল্লা হিসেবে বিক্রি করা হয়।

চিত্রশালা সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা - নাটোরের সরকারি ওয়েব পোর্টাল" [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]www.natore.gov.bd
  2. BanglaNews24.com। "নাটোরের কাঁচাগোল্লা, নামেই যার খ্যাতি :: BanglaNews24.com mobile"banglanews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২১ 
  3. "জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল নাটোরের কাঁচাগোল্লা"বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর.কম। আগস্ট ১০, ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১০, ২০২৩ 
  4. "নাটোরের কাঁচাগোল্লা | কালের কণ্ঠ"Kalerkantho। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২১ 
  5. "My sweet beloved"The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৭-০৪-১৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২১ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা