ধনীরাম টোটো হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অনগ্রসর টোটো জনজাতির একজন সরকারি কর্মচারী, টোটো ভাষার সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক। [১] তিনি বিপন্নপ্রায় টোটো জনজাতির মুখের ভাষা তথা সিনো-তিবেতিয়ান বা ইন্দো-বর্মান ভাষা পরিবারের টোটো ভাষার বর্ণলিপি সৃষ্টি করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার এই অনন্য সাধারণ কাজের জন্য ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার সাহিত্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী প্রদান করে।[২][১]

ধনীরাম টোটো
জন্ম১৯৬৪
টোটোপাড়া মাদারিহাট আলিপুরদুয়ার জেলা পশ্চিমবঙ্গ ভারত
ভাষাটোটো
জাতীয়তাভারতীয়
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি'ধানুয়া টোটোর কথামালা’
‘ডুমরা থিরতে’।
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারপদ্মশ্রী (২০২৩)
দাম্পত্যসঙ্গীচম্পা টোটো
সন্তানসঞ্জয়, রঞ্জয় ও ধনঞ্জয় তিন পুত্র ও এক কন্যা

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

ধনীরাম টোটোর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট-বীরপাড়া সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের টোটোপাড়া গ্রামে। ধনীরাম আমেপা টোটো এবং লক্ষ্মিণী টোটোর মধ্যম পুত্র। তার পিতা টোটো জনজাতির নিজস্ব-গোষ্ঠী নির্বাচিত পঞ্চায়েতের শেষ প্রধান ছিলেন।[৩] ধনীরাম বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় কম্পার্টমেন্টাল পান এবং শেষে রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। [৪] বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তার পিতা মারা যান। সেকারণে তিনি আর বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেন নি। তবে বেশ কয়েকটি ভাষা আয়ত্ত করেন নিজের চেষ্টায়। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ ও আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগে কাজে নিযুক্ত হন এবং পরে আধিকারিক পদে উন্নীত হন।

সাহিত্যকর্ম সম্পাদনা

ধনীরাম টোটো সংস্কৃতি রক্ষায় আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। টোটো সাহিত্যের জন্য প্রচুর কবিতা, উপন্যাস ও রম্যরচনা লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল -

  • ধানুয়া নদীর তীরে
  • উত্তাল তোর্ষা

এ পর্যন্ত যে পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ‘ধানুয়ার টোটো কথামালা’ দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছে। এছাড়াও, টোটো জনজাতির কথা নিযে লোকাসুর, টোটোদের জেনেটিক্স, সমগ্র টোটোপাড়ার ইতিবৃত্ত, টোটো ক্যালেন্ডার, টোটোপাড়ার সকলের বংশ পরিচয়ের এক দলিলও তৈরি করেছেন তিনি। প্রয়াত স্ত্রীকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা ‘প্রিয়তমার স্বপ্নভূমি’।

টোটো ভাষার বর্ণমালা রচনা সম্পাদনা

ছোট থেকেই ধনীরাম গান ও কবিতা ভালবাসতেন। নিজে রচনা করেছেন প্রচুর কবিতা। কিন্তু রেডিওতে যখনই বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পী রুনা লায়লার কন্ঠে—

“ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে ধুলোবালু চরে, পাখিদের নীড়ে তুমি আমি গাই গানের বর্ণমালা…”

গানটি শুনতেন, তখনই তিনি আনমনা হয়ে যেতেন। মনের মধ্যে বর্ণমালা শব্দটি তাকে ভীষণভাবে তাড়া দিত। তার মাতৃভাষা টোটোর সম্পূর্ণ আলাদা শব্দভাণ্ডার, ব্যাকরণ থাকলেও নিজস্ব লিপি বা হরফ তথা বর্ণমালা না থাকার কারণে বাংলা লিপিতেই লেখা হয় তার ভাষা। ধনীরাম কবিতা উপন্যাস রম্যরচনা সবই লেখেন বাংলা লিপিতে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সচেষ্ট হন টোটো ভাষার স্ক্রিপ্ট ও হরফ তৈরিতে। নিজে প্রশিক্ষিত ভাষাবিদ না হওয়ায় তিনি সাহায্য নেন অস্ট্রেলিয়ান ভাষাবিদ টোবি অ্যান্ডারসনের। দীর্ঘ দশ বৎসরের প্রচেষ্টায় সৃষ্টি করেন টোটো ভাষার সম্পূর্ণ বর্ণমালা। ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ৯টি স্বরবর্ণ এবং ৬টি ডিফথং সহ মোট ৩৭টি লিপি নিয়ে বর্ণমালাটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্থাৎ আইএসও কোড-ও পেয়েছে টোটো লিপিটি।( ISO 15924 Code/Key Toto/294)[৫] তার এই অসামান্য অবদানের জন্য টোটো জনজাতি অত্যন্ত গর্বিত। এছাড়াও ধনীরামবাবু টোটোদের শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছেন।

সম্মাননা সম্পাদনা

ধনীরাম টোটো জনজাতির মুখের ভাষা সংরক্ষণে ও তাদের সার্বিক উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছেন। সে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "বিলুপ্তপ্রায় টোটো জাতি নিয়ে বড় আক্ষেপ 'পদ্মশ্রী ২০২৩' ধনীরাম টোটোর, EXCLUSIVE সাক্ষাৎকার"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৯ 
  2. "Padma Awards 2023 announced"PIB। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ 
  3. "ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জলদাপাড়া"। ২০২৩-০৩-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৮ 
  4. "আমার দুখিনী বর্ণমালা......পদ্মশ্রী ধনীরাম টোটো"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৮ 
  5. "The architect of Toto alphabet fights to save mother tongue from extinction" (ইংরাজী ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৮ 

আরো দেখুন সম্পাদনা