তিরুবল্লুবর

বিশিষ্ট তামিল কবি,তিরুক্কুরল গ্রন্থের লেখক

তিরুবল্লুবর (তামিল: திருவள்ளுவர்) ছিলেন একজন বিশিষ্ট তামিল কবি। তিনি তামিল সাহিত্যের একটি ন্যায়শাস্ত্রমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার নাম তিরুক্কুরল। তিরুবল্লুবর থেবা ফুলবর, বল্লুবর ও পোয়ামোড়ী ফুলবর নামেও পরিচিত।

তিরুবল্লুবর

প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, তিরুবল্লুবর ময়লাপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার স্ত্রী বাসুকী ছিলেন সাধ্বী ও ধর্মপ্রাণা নারী এবং আদর্শ পত্নী। তিনি তার স্বামীর আদেশ অমান্য করতেন না; বিনা প্রশ্নে মেনে চলতেন। তিরুবল্লুবর দেখিয়েছিলেন যে, মানুষ তার পবিত্রতা বজায় রেখেও গৃহস্থজীবন যাপন করতে পারেন। তিনি বলতেন দিব্য জীবনযাপনের জন্য গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তার বাণী গ্রন্থিত হয়েছে তিরুক্কুরল নামক বইটিতে।[১] তামিল পঞ্জিকা তার সময় থেকেই গণনা করা হয় এবং তার নাম অনুসারে এই পঞ্জিকাকে বলা হয় তিরুবল্লুবর আন্দু (বছর)।[২]

তিরুবল্লুবরের সময়কাল জানা যায় মূলত ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে। আজ পর্যন্ত তার কোনো পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৩] আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে তিনি বর্তমান ছিলেন।[৪]

প্রচলিত বিবরণ সম্পাদনা

তিরুক্কুরলে লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। "তিরুবল্লুবর" নামটি পাওয়া যায় আরও কয়েক শতাব্দী পরে লেখা তিরুবল্লুবরমালাই (তিরুবল্লুবরের মালা) গ্রন্থে। তিরুবল্লুবর সংক্রান্ত গল্পগুলির উদ্ভব ঘটে এই বইটি লেখার পর থেকেই।[৫] সাধারণভাবে মনে করা হয় যে তিরুবল্লুবর নামটি তামিল তিরু (অর্থাৎ, সম্মানসূচক শ্রী)[৬]বল্লুবর (তামিল বল্লুবন শব্দের নম্র রূপ) শব্দদুটি নিয়ে গঠিত। বল্লুবন ঠিক ব্যক্তিনাম নয়, এটি জাতিবাচক নাম। তবে তিরুক্কুরল গ্রন্থের রচয়িতার নাম তার জাতির নাম থেকে এসেছে, না তার নাম থেকে তার জাতি নাম পেয়েছে, তা সঠিক জানা যায় না।

কোনো কোনো কিংবদন্তি অনুসারে, তার মাতা ও পিতার নাম হল আতি ও ভগবান।[৭] এই সব কিংবদন্তিতে তাকে আব্যাইয়ার, কবিলার ও অতিগামানের ভাই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভি. আর. রামচন্দ্র দীক্ষিতর মনে করে, চার জনে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন জাতি থেকে আগত। তাই তাদের মধ্যে ভ্রাতৃসম্বন্ধ থাকা অসম্ভব।[৮]

অপর একটি কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি তামিল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক পাণ্ড্য রাজাদের রাজধানী মাদুরাইতে থাকতেন। অপর মতে, তার জন্ম ও নিবাস ছিল চেন্নাই শহরের ময়লাপুর অঞ্চলে। তিনি পরে মাদুরাইতে গিয়ে তিরুক্কুরল বইখানি পাণ্ড্য রাজা ও তার কবিসভায় প্রদান করে। তার স্ত্রীর নাম ছিল বাসুকী।[৯]

প্রচলিত গল্প অনুসারে, "মাদুরাইয়ের তামিল সঙ্গম" (বিশিষ্ট পণ্ডিতদের দ্বারা নিয়মিত আয়োজিত সম্মেলন) তিরুক্কুরল বইটিকে বিশ্বের সামনে সুপরিচিত করে তোলে। তিরুবল্লুবর সম্ভবত মাদুরাইতে থাকতেন। কারণ পাণ্ড্য রাজাদের রাজত্বকালে সেখানে অনেক তামিল কবি বাস করতেন। কন্যাকুমারী ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র সাম্প্রতিককালে দাবি করছে যে, তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী জেলার বল্লুবনাড়ু পার্বত্য অঞ্চলের এক রাজা ছিলেন বল্লুবর।[১০]

অধিকাংশ গবেষক ও তিরুক্কুরল সহ অন্যান্য তামিল গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদকারী জর্জ উগলো পোপ (যিনি নিজেও তামিলনাড়ুতে বহুদিন কাটান) তিরুবল্লুবরকে পারাইয়ার বলে উল্লেখ করেছেন। কার্ল গ্রাউল (১৮১৪-১৮৬৪) তিরুক্কুরল বইটিকে বৌদ্ধগন্ধী রচনা বলে উল্লেখ করেন। এই কারণেই হয়ত তিরুবল্লুবরকে পারাইয়ার সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করা হয়ে থাকে। তবে গ্রাউল জৈনদেরও বৌদ্ধদের অংশ মনে করেছিলেন।

ধর্ম সম্পাদনা

তিরুক্কুরল বইটি আগাগোড়া ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা হয়েছে।[১১] প্রথম অধ্যায়ে ঈশ্বরের স্তব করা হলেও, ঈশ্বরের কোনো বিশেষ নাম গ্রহণ করা হয়নি।[৭] তাছাড়া, তিরুক্কুরলে যে নীতির কথা বলা হয়েছে, তা সকল ধর্মেই রয়েছে।[৮] এই জন্য তিরুবল্লুবরকে পারাইয়ার, জৈন, বৌদ্ধ বা অর্ধ ব্রাহ্মণ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।[৪]

তিরুক্কুরল সম্পাদনা

 
তিরুবল্লুবর মূর্তি, কন্যাকুমারী

তিরুক্কুরল প্রাচীন তামিল সাহিত্যের সর্বাধিক সমাদৃত গ্রন্থ।[১২] "কুরল" শব্দের অর্থ "সাধারণ নীতি"।[১৩] এই গ্রন্থে মানব জীবনের আদর্শ ও নৈতিক উন্নতির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বের নানা ভাষায় বইটি অনূদিতও হয়েছে।

বইটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডের বিষয়বস্তু অরম (বিবেক ও সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন বা "সঠিক আচরণ"), দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু পারুল (জাগতিক কাজকর্মগুলি সঠিকভাবে সম্পাদনা) এবং তৃতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু ইনবম (নরনারীর প্রেম)। তিনটি খণ্ডের অধ্যায় সংখ্যা যথাক্রমে ৩৮, ৭০ ও ২৫। প্রতিটি অধ্যায়ে দশটি করে দোঁহা বা "কুরল" রয়েছে। গ্রন্থে মোট কুরলের সংখ্যা ১৩৩০। অরমইনবম অংশের বিষয়বস্তু ব্যক্তিগত জীবন, পারুল অংশে আলোচিত হয়েছে গণজীবন।[১৪]

অন্যান্য রচনা সম্পাদনা

তিরুক্কুরল ছাড়া আরও দুটি গ্রন্থ তিরুবল্লুবরের রচনা বলে মনে করা হয়। এগুলি হল তামিল চিকিৎসা গ্রন্থ জ্ঞান বেত্তিয়ানপঞ্চরত্নম্‌। তবে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, পরবর্তীকালে কোনো এক সমনামধারী লেখক এই বইদুটি রচনা করেছিলেন।[১৫] তাছাড়া সিদ্ধ ঔষধি সম্পর্কে লিখিত এই বইদুটির রচনাকাল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী।[১৬] তিরুক্কুরলে সংস্কৃত প্রভাব না থাকলেও, এই দুটি বইতে ব্যাপক।[১৭]

স্মারকস্থল ও সম্মাননা সম্পাদনা

১৯৭৬ সালে চেন্নাইতে বল্লুবর কোট্টাম নামে একটি তিরুবল্লুবর স্মারক নির্মিত হয়েছে।[১৮] এই স্মারকস্থলটি দ্রাবিড় মন্দির স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত।[১৯] এই স্মারকস্থলে একটি মন্দির রথ রয়েছে।[২০] রথটি তিনটি গ্র্যানাইট ব্লকে খোদাই করা। এছাড়া একটা অগভীর আয়তাকার পুষ্করিণী রয়েছে।[১৮] স্মারকস্থল সংলগ্ন অডিটোরিয়ামটি দেশের অন্যতম বৃহৎ অডিটোরিয়াম। এতে ৪০০০ দর্শকাসন রয়েছে।[২১] জায়গাটি আগে ছিল পরিত্যক্ত হ্রদ। পরে এটি জঞ্জালের স্তুপে পরিণত হয়েছিল। চেন্নাই পৌরসংস্থা জায়গাটি পুনরুদ্ধার করে এই স্মারকস্থলটি তৈরি করে।[১৯]

ভারতের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণতম বিন্দু কন্যাকুমারীতে যেখানে আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর মিলিত হয়েছে সেখানে ১৩৩ ফুট উঁচু একটি তিরুবল্লুবর মূর্তি রয়েছে। ১৩৩ ফুট তিরুক্কুরল বইয়ের ১৩৩টি অধ্যায়ের প্রতীক। মূর্তির হাতের তিনটি আঙুল প্রদর্শন অরম, পারুলইনবম অর্থাৎ নীতি, সম্পদ ও প্রেমের প্রতীক। মূর্তিটির নকশা প্রস্তুত করেন তামিলনাড়ুর মন্দির স্থপতি ভি. গণপতি স্থপতি[২২]

তামিলনাড়ু সরকার পোঙ্গল উৎসব উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে ১৫ জানুয়ারি তার সম্মানে "তিরুবল্লুবর দিবস" পালন করে।[২৩]

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. http://www.tn.gov.in/literature/thiruvalluvar/Thirukkural/kural.htm
  2. http://www.dlshq.org/saints/thiruvalluvar.htm
  3. Mohan Lal (১ জানুয়ারি ২০০৬)। The Encyclopaedia Of Indian Literature (Volume Five (Sasay To Zorgot)। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 4333–4334। আইএসবিএন 9788126012213। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০১০ 
  4. Arun Kumar Jain (২০০৯)। Faith & philosophy of Jainism। Gyan Publishing House। পৃষ্ঠা 161–। আইএসবিএন 9788178357232। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১০ 
  5. Blackburn, Cutler (২০০০)। "Corruption and Redemption: The Legend of Valluvar and Tamil Literary History"Modern Asian Studies34: 449–482। ডিওআই:10.1017/S0026749X00003632। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১২-০৯ 
  6. Caldwell, Robert. 1875. A comparative grammar of the Dravidian or South-Indian family of languages. London: Trübner.
  7. Gerard Foekema; Swamiji Iraianban (১৯৯৭)। Ambrosia of Thirukkural। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 11–। আইএসবিএন 9788170173465। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১০  উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "FoekemaIraianban1997" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  8. Ramachandra Dikshitar (২০০৭)। Studies in Tamil Literature and History। READ BOOKS। পৃষ্ঠা 65–135। আইএসবিএন 9781406772456। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১০ 
  9. Kanakasabhai (১৯৯৭)। The Tamils Eighteen Hundred Years Ago। Asian Education Service। পৃষ্ঠা 138। আইএসবিএন 8120601505 
  10. "Valluvar lived in Kanyakumari district"। Yahoo! News। ২৬ এপ্রিল ২০০৭। ২০০৭-০৩-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৮-২২ 
  11. "Declare Thirukkural as a national scripture: Adigal", The Hindu, ২০০৯, সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১২-১১ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  12. "Tamil Nadu seeks national status for 'Thirukkural'"। ১৬ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১০ 
  13. Kamil Zvelebil (১৯৭৩)। The smile of Murugan on Tamil literature of South India। BRILL। পৃষ্ঠা 156–। আইএসবিএন 9789004035911। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১০ 
  14. Ravindra Kumar (১ জানুয়ারি ১৯৯৯)। Morality and Ethics in Public Life। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 92–। আইএসবিএন 9788170997153। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ 
  15. Ca. Vē Cuppiramaṇiyan̲ (১৯৮০)। Papers on Tamil studies। International Institute of Tamil Studies। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১০ 
  16. Marion Zimmermann (সেপ্টেম্বর ২০০৭)। A Short Introduction: The Tamil Siddhas and the Siddha Medicine of Tamil Nadu। GRIN Verlag। পৃষ্ঠা 8–। আইএসবিএন 9783638771269। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০১০ 
  17. Ashraf, N.V.K. (২০০৮), An introduction to Thirukkural and its author 
  18. David Abram; Rough Guides (Firm) (২০০৩)। South India। Rough Guides। পৃষ্ঠা 421–। আইএসবিএন 9781843531036। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১০ 
  19. Tourist Guide to Tamil Nadu। Sura Books। পৃষ্ঠা 20–। আইএসবিএন 9788174781772। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১০ 
  20. Mary Elizabeth Hancock (৮ অক্টোবর ২০০৮)। The politics of heritage from Madras to Chennai। Indiana University Press। পৃষ্ঠা 113–। আইএসবিএন 9780253352231। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১০ 
  21. Rina Kamath (২০০০)। Chennai। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 34–। আইএসবিএন 9788125013785। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১০ 
  22. Tiruvaḷḷuvar; Satguru Sivaya Subramuniyaswami (১ জানুয়ারি ২০০০)। Tirukural। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 31–32। আইএসবিএন 9788170173908। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১০ 
  23. Various। Tourist Guide to South India। Sura Books। পৃষ্ঠা 13–। আইএসবিএন 9788174781758। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১০ 

তথ্যসূত্র সম্পাদনা