ডেভিসন-জার্মার পরীক্ষণ
ডেভিসন-জার্মার পরীক্ষণ হলো ১৯২৩-১৯২৭ সালে ক্লিনটন জোসেফ ডেভিসন ও লেস্টার জার্মার কর্তৃক ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিক রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে[১] করা একটি পরীক্ষণ যেখানে নিকেল ধাতুর একটি স্ফটিক পৃষ্ঠ দ্বারা বিক্ষিপ্ত ইলেক্ট্রন সমূহ একটি অপবর্তন প্যাটার্ন প্রদর্শন করে। এটি ১৯২৪ সালে লুই দ্য ব্রোয়ি কর্তৃক উন্নিত তরঙ্গ-কণা দ্বৈততার পরিকল্পনাকে নিশ্চিত করে এবং এটি ছিলো কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান সৃষ্টিতে একটি মাইলস্টোন।
ইতিহাস
সম্পাদনা১৯ শতকের শেষের দিকে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ অনুযায়ী, ভাবা হতো যে আলো তড়িচ্চৌম্বক ক্ষেত্রের তরঙ্গ দিয়ে গঠিত যেখানে পদার্থ স্থানীয় কণা (localized particles) দ্বারা গঠিত। ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইন্সটাইন আইন্সটাইনের আলোক তড়িৎ ক্রিয়ার গবেষণাপত্রে একে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়, যা আলোকে স্বতন্ত্র ও শক্তির স্থানীয় (localized) কোয়ান্টা হিসেবে বর্ণনা করে, যা ১৯২১ সালে তাকে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের বিজয়ী করে। ১৯২৪ সালে দ্য ব্রোয়ি তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ (থিসিস) উপস্থাপন করেন যা উত্থাপন করে যে, সকল পদার্থই ফোটনের মত তরঙ্গ-কণা দ্বৈত্যতা প্রদর্শন করে।[২] দ্য ব্রোয়ির মতে, সকল পদার্থ ও বিকিরণের জন্য একই ভাবে, কণার শক্তি তার সাথে জড়িত তরঙ্গ এর কম্পাংকের সাথে প্ল্যাঙ্ক অন্বয় দ্বারা অন্বিতঃ
এবং কণাটির ভরবেগ এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সাথে পদার্থ তরঙ্গ দ্য ব্রোয়ি অন্বয় দ্বারা অন্বিতঃ
যেখানে h হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক।
ডেভিসন-জার্মার পরীক্ষণে ওয়াল্টার এম. এলসেসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন যখন তিনি ১৯২০ সালে গ্যটিঙেনে বলেন যে, স্ফটিকময় কঠিনের উপর ইলেক্ট্রন বিক্ষেপণ পরীক্ষার মাধ্যমে পদার্থের তরঙ্গের মত প্রকৃতি অনুসন্ধান করা যেতে পারে ঠিক যেমন এক্স-রশ্মির তরঙ্গের মত প্রকৃতি, স্ফটিকময় কঠিনের উপর এক্স-রে বিক্ষেপণ পরীক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়।[২][৩]
এলসেসারের এই প্রস্তাবনাটি তার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী (এবং নোবেল পুরস্কার বিজেতা) মাক্স বর্ন কর্তৃক ইংল্যান্ডে জ্ঞাপন করা হয়। যখন ডেভিসন-জার্মার পরীক্ষণ করা হয় তখন এলসেসারের এই প্রস্তাবনার মাধ্যমেই তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। যাইহোক, দ্য ব্রোয়ি প্রকল্পের প্রমাণ নয় বরং নিকেল পৃষ্ঠের অধ্যায়ন ছিলো ডেভিসন-জার্মার পরীক্ষণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।
১৯২৭ সালে বেল ল্যাবে ক্লিনটন জোসেফ ডেভিসন ও লেস্টার জার্মার একটি স্ফটিকময় নিকেলের লক্ষ্যবস্তুকে লক্ষ্য করে ধীর গতির ইলেক্ট্রন ছোড়েন। প্রতিফলিত ইলেক্ট্রন প্রবলতার কৌনিক নির্ভরতা (angular dependence) মাপা হয় এবং ঠিক সেই একই অপবর্তন প্যটার্ন নির্ধারিত হয় যা ব্র্যাগ কর্তৃক এক্স-রের ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। একই সময়্র জর্জ প্যাজেট টমসন স্বাধীনভাবেভ ধাতব পাতে ইলেক্ট্রন নিক্ষেপ করে অপবর্তন প্যাটার্ন সৃষ্টির মাধ্যমে একই ক্রিয়ার প্রদর্শন করেন ও ১৯৩৭ সালে ডেভিসন ও থমসন নোবেল পরষ্কারের ভাগীদার হন।[২][৪] ডেভিসন-জার্মার পরীক্ষণ দ্য ব্রোয়ি প্রকল্পকে, পদার্থের তরঙ্গের মত বৈশিষ্ট্য রয়েছে তে নিশ্চিত করে। ইহা ও আর্থার কম্পটন (১৯২৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী)[৫] কর্তৃক আবিষ্কৃত কম্পটন বিক্ষেপণ কম্পটন ক্রিয়ার সমন্বয়ে তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয় যা কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটি মৌলিক ধাপ ছিলো।
শুরুর দিকের পরীক্ষণ
সম্পাদনা১৯২১ সালে ডেভিসন ইলেক্ট্রন বর্ষণ ও গৌন ইলেক্ট্রন নিঃসরণ অধ্যায়নের জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত এক সারি পরীক্ষণ চালানো হয়।
ডেভিসন ও জার্মারের আসল লক্ষ্য ছিলো একটি নিকেল খন্ডের পৃষ্ঠে ইলেক্ট্রনের মরীচি (বীম) তাক করে বিভিন্ন কোণে কত ইলেক্ট্রন ফিরে আসে তা পর্যবেক্ষণ করা। ইলেক্ট্রনের ছোট আকৃতির কারণে তারা আশা করেছিলেন যে, সবচেয়ে মসৃণ স্ফটিক পৃষ্ঠও এর জন্য রুক্ষ হবে এবং ইলেক্ট্রনের ব্যাপ্ত প্রতিফলন হবে। [৬]
পরীক্ষণটি হয়েছিলো একটি নিলেল স্ফটিকের পৃষ্ঠে উলম্বভাবে ইলেক্ট্রনের মরীচি নিক্ষেপ করে (ইলেক্ট্রন গান থেকে) সনাক্তকারী যন্ত্র ও স্ফটিক পৃষ্ঠের বিভিন্ন কণে ইলেক্ট্রনের প্রতিফলন মাপার মাধ্যমে। ইলেক্ট্রন গানটি ছিলো একটি উত্তপ্ত টাংস্টেন অংশু (ফিলামেন্ট) যা তাপীয়ভাবে উত্তেজিত ইলেক্ট্রন নিঃসরণ করে, যেগুলি তড়িৎ বিভব পার্থক্যের কারণে ত্বারিত হয় এবং নিকেল পৃষ্ঠের দিকে যথেষ্ট গতিশক্তি পায়। যাত্রাপথে অন্যান্য পরমাণুর সাথে ইলেক্ট্রনের সংঘর্ষ এড়াতে পরীক্ষণটি একটি নির্বাত কুঠরিতে (ভ্যাকুয়াম চেম্বার) করা হয়। বিভিন্ন কোণে প্রতিফলিত ইলেক্ট্রন সনাক্তকরণের জন্য একটি ফ্যারাডে কাপ ইলেক্ট্রন সনাক্তকারী ব্যবহার করা হয় যা ব্যবহৃত স্ফটিকের উপর একটি বক্রপথে চলতে পারত। সনাক্তকারীটিকে শুধুমাত্র ইলাস্টিক্যালি স্ক্যাটার্ড ইলেক্ট্রন সমূহ সনাক্তের জন্য নকশা করা হয়।
পরীক্ষণের সময় দূর্ঘটনাজনিতভাভে কক্ষটির ভেতরে বাতাস ঢুকে পরে, যার ফলে নিকেল পৃষ্ঠের উপরে একটি অক্সাইড ঝিল্লি তৈরী হয়। এই অক্সাইড সরানোর জন্য ডেভিসন ও জার্মার নমুনাটিকে একটি উচ্চ তাপের চুল্লিতে উত্তপ্ত করেন, এটি না জেনেই যে নিকেলের পূর্বের পলিক্রিস্টালাইন গঠন থেকে একটি বৃহৎ স্ফটিক ক্ষেত্র গঠিত হয় যেখানে স্ফটিক সমতল ইলেক্ট্রন বীমের প্রস্থের চেয়েও বেশি অবিচ্ছিন্ন হয়। [৬]
যখন তারা পরীক্ষণটি আবার শুরু করেন এবং ইলেক্ট্রন পৃষ্ঠকে আঘাত করে, ইলেক্ট্রনগুলি স্ফটিকের স্ফটিক সমতলের নিকেল পরমাণু কর্তৃক বিক্ষিপ্ত হয়। ১৯২৫ সালে এটি একটি অপ্রত্যাশিত চূড়া সহ অপবর্তন প্যাটার্ন তৈরী করে।
যুগান্তকারী
সম্পাদনা১৯২৬ সালের গ্রীষ্মে এক বিরতির সময়, ডেভিসন বৃটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা অ্যাডভান্সমেন্ট অভ সায়েন্সের একটি অক্সফোর্ড অধিবেশনে উপস্থিত হন। এই অধিবেশনে তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে পারেন। ডেভিসন বিষ্মিত হন যখন ম্যাক্স বর্ন একটি বক্তৃতায় ১৯২৩ সালে সায়েন্সে প্রকাশিত ডেভিসনের গবেষণা থেকে অপবর্তন বক্ররেখা ব্যবহার করেন, এই উপাত্ত ব্যবহার করেন দ্য ব্রোয়ি প্রকল্পের প্রমাণ হিসেবে। [৭]
তিনি জানতে পারেন যে পূর্ববর্তী বছর গুলোতে ওয়াল্টার এম. এলসেসার, ই. জি. ডায়মন্ড ও প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট, জেমস চ্যাডউইক এবং চার্লস এলিস একই রকম অপবর্তন পরীক্ষণের চেষ্টা করেন কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে নিম্ন নির্বাত তৈরী করতে বা নিম্ন-প্রাবল্যের বীম শনাক্ত করতে পারেননি। [৭]
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে, ডেভিসন নলের নকশা ও সনাক্তকারী অবলম্বনের পরিবর্তন সাধন করেন। পরবর্তী পরীক্ষণগুলিতে এটি একটি একক শক্তিশালী চূড়া এবং একটি কোণ উৎপন্ন করে। তিনি, নেচারে "দ্যা স্ক্যাটারিং অভ ইলেক্ট্রন্স বাই এ সিঙ্গেল ক্রিস্টাল অভ নিকেল" নামে একটি নোট প্রকাশ করেন।[৮]
তখনো কিছু প্রশ্নোত্তর বাকি থাকায় ১৯২৭ সাল পর্যন্ত পরীক্ষণ চলে। [৯]
ইলেক্ট্রন গানের প্রযুক্ত ভোল্টেজ বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে, বিভিন্ন কোণে পারমাণবিক পৃষ্ঠ কর্তৃক অপবর্তিত ইলেক্ট্রনের সর্বচ্চ প্রাবল্য পাওয়া যায়। θ = ৫০° কোণে ৫৪V ভোল্টেজে, সর্বচ্চ প্রাবল্য প্রত্যক্ষ করা হয় যা ইলেক্ট্রন গুলিকে ৫৪ eV এর গতিশক্তি দেয়। [২]
যেমন মাক্স ফন লাউয়ে ১৯১২ সালে প্রমাণ করেন, পর্যায়বৃত্ত স্ফটিক গঠন ত্রিমাত্রিক অপবর্তন ঝাঁঝরি হিসেবে কাজ করে। সর্বচ্চ প্রতিফলন কোণসমূহ গঠনমূলক ব্যতিচারের জন্য ব্র্যাগের শর্ত দ্বারা প্রদত্ত। ব্র্যাগের সূত্রঃ
n = ১, θ = ৫০° এবং পূর্ববর্তী এক্স-রশ্মি বিক্ষেপণ পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত স্ফটিক সমতলের ব্যবধান (d = ০.০৯১ nm) এর জন্য। [২]
দ্য ব্রোয়ি অন্বয় অনুযায়ী, ৫৪ eV গতিশক্তি সম্পন্ন ইলেক্ট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হবে ০.১৬৭ ন্যামি। ব্র্যাগের সূত্র থেকে পরীক্ষাটির ফলাফল দাড়ায় ০.১৬৫ ন্যামি, যা ছিলো বেশ কাছাকাছি। ১৯২৮ সালে অনুপ্রেরিত পত্রে ডেভিসন ও জার্মার বলেন, "ব্রোয়ির সূত্রকে তুষ্ট করতে উপাত্তের ব্যার্থতা সহ এই ফলাফল, ইলেক্ট্রন অপবর্তনের উপর আমাদের পূর্ববর্তী পরীক্ষণগুলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই প্রতিফলন উপাত্ত সেই কারণেই ব্রোয়ির সূত্রকে তুষ্ট করতে ব্যার্থ হয়, যেই কারণে, ইলেক্ট্রন অপবর্তন বীম তাদের লাউয়ে বীম উদাহারণের সাথে মেলে না।"[১] যাইহোক, তারা আরো বলেন, "হিসাবকৃত তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এর তাত্ত্বিক মানের সাথে চমৎকারভাবে ঐক্য পূর্ণ যেমনটি অনুবর্তী ছকে দেখানো হয়েছে।"[১] তাই, যদিও ইলেক্ট্রন শক্তি অপবর্তন ব্র্যাগের সূত্রকে অনুসরণ করেনি, এটি ব্রোয়ির সমীকরণকে নিশ্চিত করেছিলো।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ Davisson, C. J.; Germer, L. H. (১৯২৮)। "Reflection of Electrons by a Crystal of Nickel"। Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America। 14 (4): 317–322। ডিওআই:10.1073/pnas.14.4.317। পিএমআইডি 16587341। পিএমসি 1085484 । বিবকোড:1928PNAS...14..317D।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Eisberg, R.; Resnick, R. (১৯৮৫)। "Chapter 3 – de Broglie's Postulate—Wavelike Properties of Particles" । Quantum Physics: of Atoms, Molecules, Solids, Nuclei, and Particles (2nd সংস্করণ)। John Wiley & Sons। আইএসবিএন 978-0-471-87373-0।
- ↑ Rubin, H. (১৯৯৫)। "Walter M. Elsasser"। Biographical Memoirs। 68। National Academy Press। আইএসবিএন 978-0-309-05239-9।
- ↑ Davisson, Clinton Joseph; Thomson, George Paget (১৯৩৭)। "Clinton Joseph Davisson and George Paget Thomson for their experimental discovery of the diffraction of electrons by crystals"। The Nobel Foundation।
- ↑ The Nobel Foundation (Arthur Holly Compton and Charles Thomson Rees Wilson) (১৯৩৭)। "Arthur Holly Compton for his discovery of the effect named after him and Charles Thomson Rees Wilson for his method of making the paths of electrically charged particles visible by condensation of vapour"। The Nobel Foundation 1927।
- ↑ ক খ Young, Hugh D. and Freedman, Roger A. (2004) University Physics, Ed. 11. Pearson Education, Addison Wesley, San Francisco, আইএসবিএন ০-৩২১-২০৪৬৯-৭, pp. 1493–1494.
- ↑ ক খ Gehrenbeck, Richard K. (১৯৭৮)। "Electron diffraction: fifty years ago" (পিডিএফ)। Physics Today। 31 (1): 34–41। ডিওআই:10.1063/1.3001830। বিবকোড:1978PhT....31a..34G।
- ↑ Davisson, C.; Germer, L. H. (১৯২৭)। "The Scattering of Electrons by a Single Crystal of Nickel"। Nature। 119 (2998): 558। ডিওআই:10.1038/119558a0। বিবকোড:1927Natur.119..558D।
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" (পিডিএফ)। ২২ আগস্ট ২০০৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০২০।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- R. Nave। "Davisson–Germer Experiment"। HyperPhysics। Georgia State University, Physics Departement।