ডি ভোটার
ডি ভোটার (সন্দেহজনক ভোটার; ইংরেজি: Dubious voter/ Doubtful voter) হলো এক ধরনের ভোটার শ্রেণী (ক্যাটাগরি), যে শ্রেণীর ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারার দরুন ভোটদানের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ডি ভোটার নির্ধারণ করে থাকে বিদেশী আইনের অধীনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলো। যারা ডি ভোটার হিসেবে ঘোষিত হন, তাদের দেওয়া হয় না ছবিসহ ভোটার কার্ড। ২০১১ সালে গৌহাটি উচ্চ আদালত ঘোষণা দিয়েছিল যে, ডি ভোটারদের বিদেশি ট্রাইব্যুনাল আদেশ ১৯৬৪ এর আওতায় বিচার করা হবে এবং তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে।[১] অসমের ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের আগে ও পরে শরণার্থী হয়ে আসা বাঙালি হিন্দু পাকিস্তানের বর্বরতায় শরণার্থী হয়ে আসা ও ১৯৪৭ এর আগে থেকে বাস করা বাঙালি মুসলমানরা এর ভুক্তভোগী।[২] নিখিল ভারত বাঙলি উদ্বাস্তু সমন্বয়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক সুদীপ শর্মার মতে, ৬ লাখ বাঙালি হিন্দু ডি ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।[৩]
ইতিহাস
সম্পাদনা১৯৯৭ সালের ১৭ জুলাই ভারতের নির্বাচন কমিশন অসম রাজ্য সরকারকে ভোটার তালিকা থেকে নাগরিক নয় এমন ব্যক্তিদের সরানোর নির্দেশ দেয়।[৪] এরপর থেকেই অসম রাজ্যে নির্বাচনী ভোটগ্রহণের তীব্র সংস্করণ হওয়া শুরু হয় ও শীধুমাত্র বৈধ ভারতীয় নাগরিকদের নাম তালিকাভুক্ত করতে বাড়ি বাড়ি গেয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু হয়। যারা তাদের নিজেদের বৈধ নাগরিকত্বের সপক্ষে প্রয়োজনীয় প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন নি, নির্বাচনী তালিকায় তাদের নামের পাশে ডি লেখা হয়, যা তাদের সংশয়াপন্ন ও বিতর্কাত হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের নাগরিকত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।[৫] এই তালিকা চলাকালে বাড়িতে না থাকা ভোটারদের নামের পাশেও ডি লেখা হয়।[৪] এসব ব্যক্তিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।[৫] এই হালনাগাদ চলাকালে কোনোভাবে অনুপস্থিত থাকা ভোটারদেরও ডি ভোটার বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এছাড়াও, বাসস্থান পরিবর্তন করে অন্য গ্রামে বসতি স্থাপন করা ব্যক্তিদেরও ডি ভোটার হিসেবে ঘোষণা করার নজিরও দেখা গিয়েছে।[৬]
যাচাই বাছাই শেষ হবার পর ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রায় তিন লাখ সত্তর হাজার মানুষকে ডি ভোটার হিসেবে ঘোষণা দেয়।[৭] ডি ভোটারদের নির্বাচনে ভোটদান ও নির্বাচনী প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ১৯৬৪ সালের বিদেশী ট্রাইবিউনাল অনুযায়ী এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয় ও তাদের আরেকবার নাগরিকত্ব প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়৷ প্রায় তিন লক্ষ সত্তর হাজার ব্যক্তির মাঝে মাত্র ১,৯৯,৬৩১ জন ব্যক্তির নাগরিকত্ব পুনরায় যাচাই করা হয়। প্রথম পর্যায়ে তাদের মধ্যে মাত্র ৩,৬৮৬ ব্যক্তিকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা যায় ও তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় ও নির্বাচনী তালিকা থেকে নাম বহির্ভুত করা হয়৷
মাত্র ছত্রিশটি আদালত ধীর গতিতে ডি ভোটার নির্ধারণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঐ সময়ে পুণর্বিবেচনাধীন ডি ভোটার হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া ও ভারতীয় নির্বাচনী বিধির নিয়ম অনুযায়ী অবৈধ বাংলাদেশী হিসাবে আখ্যায়িতদের একটি বড়ো অংশ পলায়ন করে৷ ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের চার তারিখে গৌহাটি হাইকোর্ট জানায় যে, এসব ব্যক্তিদের তাদের প্রতি আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে। এসব ডি ভোটারদের এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়ালপাড়া ও কোকড়াঝাড়ের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল৷ বিদেশী নাগরিক আইন কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত তারা নিজেদের পর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে নাগরিক বৈধতা পেতে পারেন বলে জানানো হয়। ২০০৫ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন আবারও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঐকবার জরিপ করা হয়৷ এই জরিপ করার সময় ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ডি ভোটার হিসাবে নথিভুক্ত ভোটারদের একটা বড় অংশেরই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি৷ এরপর সরকারী হিসাবে ডি ভোটারের সংখ্যা ১,৮১,৬১৯ এ নেমে আসে।[৭] ২০১২ সালের জুন মাসে যাদের তালিকা প্রতিপাদনযোগ্য ছিলো তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৫৭,৪৬৫ তে।[৮] ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি অসম রাজ্য সরকার ঘোষণা আইন-পারিষদকে জানায় যে, সেই রাজ্যে ১,৪৩,২২৭ জন ডি ভোটার আছে।[৯] ২০১৮ সালে ডি ভোটারের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ একুশ হাজারের কাছাকাছি।[৬]
মানবাধিকার ইস্যু
সম্পাদনা২০১১ দুজন স্থানীয় বাঙালি হিন্দু সহোদর সন্তোষ শব্দকর ও মনোতোষ শব্দকরকে বিদেশি বলে ঘোষণা দেয় ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল।[১০] দুই ভাই ছিলেন রিকশাচালক যারা বেড়ে উঠেছিলেন কাছাড় জেলার শিলচরে।[১০] তারা পূর্বে ভোট দিলেও ২০১১ সালে অসম বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।[১০] রায় ঘোষণার পর তাদের গ্রেফতার করা হয় ও বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়।[১০] ২০১১ সালের ১২ জুলাই মধ্যরাতে বিএসএফ তাদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করে বলে জানায়।[১১] এরপর শব্দাকর ভাইদের খোঁজ জানা যায় নি।[১২]
২০১২ সালের মার্চে অসম রাজ্য সরকারের মন্ত্রী হেমন্ত শর্মা সেখানকার বাঙালি হিন্দুদের মামলাগুলো আলাদা কমিটির অধীনে বিবেচনা করার ঘোষণা দেন। অসম রাজ্য সরকার জানায় যে, অসম পুলিশ ডি ভোটারের নামে বাঙালি হিন্দুদের হেনস্তা করবে না।[১৩] মন্ত্রীর ঘোষণার পরও ডি ভোটারের নামে বাঙালিদের নাজেহাল করা থামে নি।[৪] ২০১২ সালের ৮ জুন ডি ভোটার হিসেবে ঘোষিত হবার পর কাছাড় জেলার বাঙালি হিন্দু অর্জুন নমশূদ্র আত্মহত্যা করেন।[১৪]
বিদেশি বলে চিহ্নিত হওয়া মানুষদের রাখার জন্য অসমে যে বন্দীশিবির তৈরি হয়েছে, সেগুলোর অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দায়িত্ব দিয়েছিল মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দারকে। তিনি ওই শিবিরগুলি ঘুরে গিয়ে যে দুর্বিষহ পরিস্থিতি দেখতে পান। তিনি তার প্রতিবেদনে দুর্বিষহ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। পরবর্তীতে, তার প্রতিবেদন মানবাধিকার কমিশন বিবেচনায় না নেবার অভিযোগে তিনি পদত্যাগ করেন।[১৫]
২০১৬ সালে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে বঙাইগাঁও জেলার সুভদ্রা সরকার নামের এক ৮৫ বছরের বৃদ্ধাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর নির্দেশ দেয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।[১৬] সুভদ্রা সরকারের পরিবার তার ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকার প্রমাণ উপস্থাপন করেছিল গণমাধ্যমের সামনে।[১৬] ২০১৮ সালে চন্দ্রধর দাস নামে ১০২ বছরের এক বৃদ্ধকে 'অনুপ্রবেশের' অপরাধে গ্রেফতার করা হয়।[১৫] তিনি তার বয়সের কারণে কয়েকবার ভোট দিতে যান নি বলে তাকে ডি ভোটার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার আইনজীবী সৌমেন চৌধুরী।[১৫] তিনি ডি ভোটার প্রসঙ্গে বলেন, "যেভাবে এই মামলাগুলো হচ্ছে, সম্পূর্ণভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। রাষ্ট্র যখন কোনও অভিযোগ করবে, তখন রাষ্ট্রেরই দায় যে সেই অভিযোগ প্রমাণ করার। কিন্তু এই আইনে অভিযুক্তকে আটক করা হবে, আবার তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি আসল ভারতীয় নাগরিক। এই মানুষটির ভাগ্যক্রমে নথি ছিল, তাই জোরের সঙ্গে তার কেসটা লড়তে পেরেছি। বহু ভারতীয় নাগরিক রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছেন হঠাৎ করেই।"[১৫] তিন মাস কারাগারে বন্দী থাকার পর চন্দ্রধর দাস জামিনে মুক্তি পান।[১৫]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Protect rights of Bengalis from Bangladesh: CPI(M)"। The Hindu। Kozhikode। এপ্রিল ১০, ২০১২। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১২, ২০১২।
- ↑ "ভোটের মুখে কেমন আছেন আসামের বাঙালী মুসলমান-হিন্দুরা?"। বিবিসি বাংলা। ৩১ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৯।
- ↑ "Pincer attack on D-voters"। The Telegraph। Kolkata। মার্চ ২৬, ২০১২। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৮, ২০১২।
- ↑ ক খ গ Chowdhury, Jyotilal (আগস্ট ২০১২)। "The Dreaded List of Assam"। Eastern Panorama। Shillong। ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৮, ২০১২।
- ↑ ক খ "Deleting Assam voters on religious basis not possible: Centre tells SC"। The Hindu। New Delhi। আগস্ট ১০, ২০১২। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১২, ২০১২।
- ↑ ক খ "ভারতের আসাম রাজ্যের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ৪০ লাখ মানুষ"। বিবিসি বাংলা। ৩০ জুলাই ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৯।
- ↑ ক খ Bhattacharya, Rajeev (জুলাই ১৬, ২০০৫)। "Assam 'D' voters in vanishing act"। The Telegraph। Kolkata। মার্চ ৪, ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৮, ২০১২।
- ↑ "Rights body moves National Human Rights Commission over suicide"। Times of India। Guwahati। জুন ১২, ২০১২। জানুয়ারি ৩, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১২, ২০১২।
- ↑ Talukdar, Sushanta (১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। "Assam's 'doubtful' voters await clearance by foreigners' tribunals"। The Hindu। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০১৪।
- ↑ ক খ গ ঘ "Two brothers identified as Bangladeshis"। The Sentinel। Guwahati। জুলাই ১৩, ২০১১।
- ↑ "'D' phobia grips Barak as Shabdakar brothers 'pushed back'"। The Sentinel। Guwahati। জুলাই ১৪, ২০১১।
- ↑ "Gautam orders cell to be set in DCC for 'D' voters"। The Sentinel। Guwahati। জুলাই ১৭, ২০১১।
- ↑ Jaiswal, Umanand (এপ্রিল ২০, ২০১২)। "D-voter tussle in PM court - Assam ready with a memorandum for Singh"। The Telegraph। Kolkata। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১২, ২০১২।
- ↑ "D voter commits suicide in Cachar"। Assam Times। জুন ১০, ২০১২। এপ্রিল ১৪, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৮, ২০১২।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "আসামের বন্দীশিবির থেকে ১০২ বছরের বৃদ্ধ 'বিদেশি' ছাড়া পেলেন"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৯।
- ↑ ক খ "'অনুপ্রবেশকারী' সন্দেহে আসামে ৮৫বছরের বৃদ্ধার জেল"। বিবিসি বাংলা। ১৮ জুন ২০১৬।