জুন ২০১৭ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধস
তিন দিনের প্রবল বর্ষণের ফলে[২] ১২ জুন ২০১৭ সোমবার মধ্যরাত ও ১৩ জুন ২০১৭ মঙ্গলবার ভোরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে ১৫৬ জন মানুষ মারা যায়।[১][৩][৪][৫] এবং সব মিলিয়ে ১৫২ মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় কয়েক শতাধিক মানুষ। বৈরী আবহাওয়ায় বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় উদ্ধার কর্মীদের পক্ষে আটকেপড়া মানুষদের উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। আটকেপড়া এবং নিখোঁজদের সন্ধানে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও স্থানীয় লোকজন সম্মিলিতভাবে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে। পুরো এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়।[২] রিয়াজ আহমেদ, বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান, বলেন যে দেশের ইতিহাসে এই ভূমিধ্বস সবথেকে মারাত্মক ছিল।
তারিখ | ১২ জুন ২০১৭ |
---|---|
অবস্থান | রাঙামাটি, চট্টগ্রাম এবং বান্দরবান, বাংলাদেশ |
ধরন | কয়েক দফা পাহাড়ধস এবং বন্যা |
কারণ | ভারী মৌসুমি বৃষ্টিপাত |
ফলাফল | বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে |
নিহত | ১৫৬[১] |
ক্ষয়ক্ষতি | ২২.৩ কোটি |
দুর্যোগের কারণ
সম্পাদনা১২ জুন, সকাল থেকে ৩৪৩ মিলিমিটার (১৩.৫ ইঞ্চি) করে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী বৃষ্টিপাতের কারণে এই ভূমিধ্বস সংগঠিত হয়। মৌসুমি জলবায়ু এবং নিম্নভূমির জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়। এই মৌসুমি জলবায়ুর কারণে প্রায় বন্যা দেখা দেয় এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ দিকের পাহাড়গুলোতে ভূমিধ্বস হয়ে থাকে।
বনউজাড়করণের কারণেও ধ্বংস সাধন হয়। নির্বিচারে কেটে বসতি স্থাপন এবং বন-জঙ্গল ও গাছ উজাড়ের কারণেই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি এবং দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা।[৬] উপজাতি নেতা, বিজয় গিরি চাকমা চ্যানেল নিউজএশিয়াকে জানান যে গাছ কাটার কারণে অনেক টিলার উপরিস্থ এলাকা একদম ক্ষয় হয়ে পড়েছে, তিনি আরো বলেন এ ধরনের ভূমিধ্বস এর আগে তিনি দেখেননি।
দ্বিতীয় বিষয় ছিল ভুমি, যেখানে প্রান্তিক এলাকাগুলোতে গরীব লোকজনকে জোড় করে কম ভাঁড়ায় থাকতে বাধ্য করা হয়। বান্দরবান সরকারি প্রশাসক দিলিপ কুমার বণিক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন যে অনেক মানুষ সরকারি সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ি ঢালু ভূমিতে ঘর বাঁধে। কক্সবাজার এলাকায়, সরকারি বর্ণনায় ৩,০০,০০০ লোকের ভূমিধ্বস-প্রবণ পাহাড়ে বসবাস রয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কে বলেন, জেলা প্রশাসক ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘরের তালিকা প্রণয়নে সরকারি অধ্যাদেশ জারি করেন, এবং তাদেরকে পুনর্বাসন করতে আলোচনা করেন।
বর্ণনা
সম্পাদনাপাহাড়ধসে রাঙামাটিতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছ। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা থেকে রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধস শুরু হয়। বেলা ১১টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় শহরের ভেদভেদি, রাঙ্গাপানি, যুব উন্নয়ন, টিভি স্টেশন, রেডিও স্টেশন, রিজার্ভ বাজার, মোনঘর, শিমুলতলি ও তবলছড়ি এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে।
উদ্ধার অভিযান
সম্পাদনা১২ জুন সোমবার রাত থেকে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপটে উদ্ধার অভিযান শুরু করে দমকল বাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা।
১৩ জুন ভোরে রাঙামাটির মানিকছড়িতে একটি পাহাড় ধ্বসে মাটি ও গাছ পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে রাঙামাটি আঞ্চলিক সদরের নির্দেশে মানিকছড়ি সেনাবাহিনী ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে যায়। তারা সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। উদ্ধারকাজ চলার সময় বেলা ১১টার দিকে পাহাড়ের একটি বড় অংশ উদ্ধারকারীদের ওপর ধসে পড়লে তারা মূল সড়ক থেকে ৩০ ফুট নিচে পড়ে যান। পরে একই ক্যাম্প থেকে আরও একটি উদ্ধারকারী দল এসে দুই সেনা কর্মকর্তাসহ চার সেনাসদস্যকে নিহত এবং ১০ সেনাসদস্যকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন।[২]
এই উদ্ধার অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা ও দুই সৈনিকের মৃত্যু ঘটে। পাহাড়ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক চালু করতে গিয়ে প্রাণ হারান তারা।[৩]
১৬ জুন শুক্রবার বিকালে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।[৭] দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ১৫৬ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করে।[৭] রাঙামাটিতে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জন, বান্দরবানে ছয়জন, কক্সবাজারের দুইজন ও খাগড়াছড়িতে এক জনের প্রাণহানি হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ঢলে ভেসে গিয়ে, গাছ ও দেয়ালচাপায় এবং বজ্রপাতে মৃত্যু হয় আরও ১৪ জনের।
প্রতিক্রিয়া
সম্পাদনাক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে রাঙামাটিতে পাহাড়ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য জরুরি মুহূর্তে ৫০ লাখ টাকা, ১০০ মেট্রিক টন চাল ও ৫০০ বান্ডিল টিন সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।[৮]
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য তিন জেলায় পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন গভীর শোক প্রকাশ করে জানান প্রয়োজনে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব উপশমে ইইউ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।[৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "পাহাড় ধস: উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত, মৃত্যু ১৫৬ জনের"। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ১৬ জুন ২০১৭। ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ ক খ গ "দুই কর্মকর্তাসহ চার সেনা নিহত"। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুন ২০১৭।
- ↑ ক খ গ "পাহাড়ধসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭"। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুন ২০১৭।
- ↑ "এত লাশ কখনও দেখেনি রাঙামাটির মানুষ"। ১৫ জুন ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুন ২০১৭।
- ↑ "রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে নিহত ১৪"। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুন ২০১৭।
- ↑ "যে কারণে পাহাড় ধস..."। দৈনিক যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ২৭ আগস্ট ২০১৭।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ "পাহাড় ধস: উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত"। প্রিয়.কম। ১৬ জুন ২০১৭। ২৭ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ "রাঙামাটিতে ৫০ লাখ টাকা, চাল, টিন দেওয়ার ঘোষণা"। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুন ২০১৭।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]