জিয়াউদ্দিন আহমেদ
মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ বা মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাবসেক্টর কমান্ডার।
জিয়াউদ্দিন আহমেদ | |
---|---|
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | ১৯৫০ পিরোজপুর জেলা, বাংলাদেশ |
মৃত্যু | ২৮ জুলাই ২০১৭ মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল, সিঙ্গাপুর |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
রাজনৈতিক দল | জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ |
দাম্পত্য সঙ্গী | কানিজ মাহমুদা |
জীবিকা | সেনা কর্মকর্তা |
সামরিক পরিষেবা | |
আনুগত্য | ![]() ![]() |
শাখা | ![]() ![]() |
কাজের মেয়াদ | ১৯৬৯-১৯৭১ (পাকিস্তান) ১৯৭১-১৯৭২ (বাংলাদেশ) |
পদ | ![]() |
জন্ম ও শিক্ষাজীবনসম্পাদনা
জিয়াউদ্দিন ১৯৫০ সালে পিরোজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দীন আহমেদ। তিনি পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।[১] তাঁর জন্মগতভাবে পারিবারিক নাম ছিল "আবুল মোমেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ", কিন্তু নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় নিজেই নাম পরিবর্তন করে রাখেন "আলী হায়দার জিয়াউদ্দিন আহমেদ"।[২]
জিয়াউদ্দিন আহমেদ পিরোজপুর সরকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে পিরোজপুর মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
কর্মজীবনসম্পাদনা
পাকিস্তান সেনাবাহিনীসম্পাদনা
জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধসম্পাদনা
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভে মার্চ মাসের ২০ তারিখ তিনি ছুটি নিয়ে দেশে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ৯ নং সেক্টরের আওতাধীন সুন্দরবন উপ-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন অঞ্চলে শত্রুদমনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তাকে ‘মুকুটহীন সম্রাট’ উপাধি দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ব্যারাকে ফিরে যান এবং মেজর হিসেবে পদমর্যাদা পান।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসম্পাদনা
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হন তখন তিনি ডিরেক্টরেট অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিএফআই), ঢাকা ডিটাচমেন্টের অফিসার ইন চার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।[৩] শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তাঁকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
৭ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি জনতার বিপ্লবে তিনি অংশ নেন। এরপর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহেরের সৈনিক সংস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তার অনুসারীদের নিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনে সেনা অভিযানে মেজর জিয়াউদ্দিন গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি ও আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলসহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ নিয়ে তখন সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা আন্দোলন শুরু করলে আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলসহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি লাভ করেন।[৪] ১৯৮৩ সালে জেনারেল এরশাদের সময় মেজর জিয়াউদ্দিন দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে আশ্রয় নেন।
রাজনৈতিক জীবনসম্পাদনা
১৯৮৪ সালের অক্টোবরে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে ছোটভাই কামালউদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শাহানুর রহমান শামীম ও কয়েককজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে যান সুন্দরবনের দুবলার চরে। বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুঁটকি মাছের ব্যবসা শুরু করেন।
তিনি ১৯৮৯-৯১ সালে বিপুল ভোটে পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগ পিরোজপুর ইউনিয়নের উপদেষ্টা ছিলেন।
তিনি ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ কর্মসূচি নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কখনও জেলেদের নিয়ে, কখনও প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে ডাকাতদের নির্মূলে অবদান রেখেছেন তিনি। এ কারণে সুন্দরবনের একাধিক ডাকাত গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এসব ডাকাত গ্রুপ জিয়াউদ্দিনকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। তিনি একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন।[৪]
সর্বশেষ মোর্তজা বাহিনীর সদস্যরা পূর্ব সুন্দরবনের হারবাড়ীয়া ও মেহেরালীর চর এলাকার মাঝামাঝি চরপুঁটিয়ায় মেজর জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বন্দুকযুদ্ধে মোর্তজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।
প্রকাশনাসম্পাদনা
মুক্তিযুদ্ধে নিজের ও অন্যান্যদের অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি "মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের উন্মাতাল দিনগুলি" নামে একটি বই লিখেছেন। যেটা মুক্তিযুদ্ধের একটি জীবন্ত দলিল। [৫]
ব্যক্তিগত জীবনসম্পাদনা
জিয়াউদ্দিন আহমেদ একজন লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। তিনি কানিজ মাহমুদাকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের চার সন্তান হয়।
মৃত্যুসম্পাদনা
তিনি ২০১৫ সাল থেকে যকৃতের অসুস্থতায় ভুগছিলেন। ১ জুলাই ২০১৭ সালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। ২৮ জুলাই ২০১৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[৪] বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করে। তাকে পিরোজপুরের পরেরহাট সড়কের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০১২-০৯-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৭-১৬।
- ↑ অগ্নিঝরা মার্চ সাক্ষাৎকার: মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ। এপ্রিল ৫, ২০১৭
- ↑ "মেজর জিয়াউদ্দিন: অনন্তলোকে এক সাহসী নক্ষত্র"। channelionline.com। সংগ্রহের তারিখ ১৪ আগস্ট ২০২০।
- ↑ ক খ গ "মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন মারা গেছেন"। bangla.bdnews24.com। সংগ্রহের তারিখ ১৪ আগস্ট ২০২০।
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৬ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১৩।