চার্লস স্টুয়ার্ট (হিন্দু স্টুয়ার্ট)

চার্লস স্টুয়ার্ট (আনু. ১৭৫৮ - ৩১ মার্চ ১৮২৮) ছিলেন হিন্দুধর্ম-অনুরাগী ও হিন্দুসভ্যতাপ্রেমী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে নিযুক্ত  সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। তিনি  ভারতের হিন্দু সংস্কৃতিকে আন্তরিকতার সঙ্গে ভালোবেসে হিন্দু ধর্মের চিরন্তন আচার-আচরণ, রীতিনীতি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন আজীবন এবং সেকারণে হিন্দু স্টুয়ার্ট নামে পরিচিত হন।[] এমনকি তিনি হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রশংসা করে এবং ভারতে বসবাসকারী স্বজাতি ইউরোপীয়দের হিন্দু সংস্কৃতি পরিগ্রহ করতে আহ্বান করেছেন। তার রচিত পুস্তক ও সংবাদপত্রে লেখা নিবন্ধে তা প্রতিভাত হয়েছে। অন্যদিকে যারা ভারতীয় সংস্কৃতির নিন্দা বা অবমূল্যায়ন করেছেন তাদের মনোভাব ও ক্রিয়াকলাপের সরাসরি নিন্দা করেছেন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল রচিত White Mughals বা শ্বেত মুঘল বইটিতে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।

চার্লস স্টুয়ার্ট
ডাকনামহিন্দু স্টুয়ার্ট
জন্মআনু. ১৭৫৮
আয়ারল্যান্ড
মৃত্যুমার্চ ৩১, ১৮২৮(১৮২৮-০৩-৩১)
কলকাতা, বৃটিশ ভারত
সমাধি
সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান, কলকাতা
আনুগত্যব্রিটিশ সাম্রাজ্য
ব্রিটিশ ভারত
পদমর্যাদামেজর জেনারেল
সম্পর্কটমাস স্মিথ (লিমেরিক এমপি)
রবার্ট স্টুয়ার্ট(ব্রিটিশ সেনা আধিকারিক)
জেমস স্টুয়ার্ট (শিল্পী)

জন্ম ও পরিবার

সম্পাদনা

চার্লস স্টুয়ার্টের জন্ম আয়ারল্যান্ডের গালওয়ে'র  এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে, জন্মসূত্রে আইরিশ। পিতা থমাস স্মিথ  (১৭৪০ - ১৭৮৫) ছিলেন লিমেরিক শহরের এমপি ও মেয়র।

তার পিতামহ চার্লস স্মিথও (১৬৯৪-১৭৮৩) ছিলেন লিমেরিক শহরের মেয়র। পিতমহী ছিলেন প্রথম ব্যারোনেট স্যার টমাস প্রেন্ডারগাস্টের কন্যা এলিজাবেথ।[] [] তার দুই ভ্রাতুষ্পুত্রের একজন রবার্ট স্টুয়ার্ট (১৮১২-১৯০১) ছিলেন কূটনীতিক এবং অন্যজন জেমস স্টুয়ার্ট ছিলেন প্রকৃতিবিদ ও সার্জেন। পাদ্রী ও খ্যাতনামা ফুটবলার রবার্ট কিং (১৮৬২-১৯৫০) ছিলেন তার পৌত্র।

কর্মজীবন

সম্পাদনা

চার্লস স্টুয়ার্ট ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ঊনিশ বৎসর বয়সে  আয়ারল্যান্ড ছেড়ে ভারতে আসেন এবং সারাজীবনই ভারতে অতিবাহিত করেন।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ক্যাডেট হিসাবে চাকরি শুরু করে পদমর্যাদায় তিনি মেজর-জেনারেল হন। প্রাত্যহিক জীবনের নির্দিষ্ট সময় হিন্দু ধর্ম ও  সংস্কৃতির জন্য বরাদ্দ রাখলেও স্টুয়ার্ট কাজকর্মে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন, তাই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফার্স্ট বেঙ্গল ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের কোয়াটার মাস্টার পদ হতে  মেজর জেনারেলের পদে উন্নীত হতে কোনকিছুই অন্তরায় হয়নি। সেনাবাহিনীর চাকরির সঙ্গে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ফার্সি ভাষার অধ্যাপক হিসাবেও কাজ করেছেন। ভারতে প্রশাসক হয়ে আসা ইংরেজ সাহেবদের যেমন উর্দু ফার্সি পড়িয়েছেন, তেমন সেখানে সহকর্মী হিসাবে পেয়েছেন জন গিলক্রিস্ট, উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ম্যাথু লামসডেন প্রমুখকে। এর মাঝে কিছুদিন তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাষার অধ্যাপনা করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে। অধ্যাপনাকালে নিপুণতায় তিনি ছিলেন একজন বৃটিশ বিদ্বান ও প্রাচ্যবিদ। সেনাবাহিনীর চাকুরিতে তার সর্বশেষ কমান্ড ছিল সাগর ফিল্ড ফোর্স। কিন্তু সামরিক বাহিনী থেকে অবসরের পর ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন।[]

ভারতে হিন্দু সভ্যতাপ্রেম ও ধর্মীয় আচরণ

সম্পাদনা

ভারতে আসার পর অষ্টাদশ শতকে ভারতের হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতি চার্লস স্টুয়ার্টকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি সেসময় ভারতে অনুভব করেন মুসলমান পরিবারে পর্দা প্রথা থাকলেও পারিবারিক জীবনে তারা খোলামেলাই, তাদের জীবন-যাপন বিশ্বাস, ভাবনা এসব আবিষ্কার করতে কৌতুহলী গবেষকের বেশি সময় লাগে না, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজের অবগুণ্ঠন খুলে তার ভেতরটা দেখে আসা রীতিমত বড় আবিষ্কার -- এই অবগুণ্ঠনের অন্তরালে তিনি পেয়েছেন সংস্কৃতির অঢেল উপাদান। কলকাতার হিন্দুদের সমাজজীবনে এর অনুসন্ধানই তাকে শেষ পর্যন্ত  পরিণত করে হিন্দু স্টুয়ার্ট-এ। তার বিচারে ভারতের হিন্দু সভ্যতা পরম্পরাগতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ। তিনি উৎসাহের সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেন এবং নিজেকে ধর্মান্তরিত হিন্দু হিসাবে পরিচয় দেন। তাছাড়া শুধু পরিচয় নয়, কৃষ্ণভক্ত স্টুয়ার্ট দৈনন্দিন জীবনে আচার-আচরণ, রীতিনীতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। কলকাতায় প্রত্যহ ভোরবেলায় কৃষ্ণবিগ্রহ নিয়ে  নগ্নপদে, পরনে কাছা দিয়ে ধুতি পরে, ঊর্দ্ধাঙ্গে আজানুলম্বিত উত্তরীয় নিয়ে গঙ্গাস্নান, ভক্তিভাবে সকাল-সন্ধ্যা পূজাপাঠের পর জলগ্রহণ, বেদ-উপনিষদ-পুরান-মহাকাব্য ইত্যাদির নিয়মিত অধ্যয়ণে প্রশান্তি লাভ করতেন তিনি। "জয় সীতারামজী" ধ্বনিতে ভারতীয়দের অভ্যর্থনা জানাতেন। প্রাত্যহিক জীবনে তার এহেন ক্রিয়াকলাপে উপনিবেশবাদী সাহেবরা ব্যঙ্গ করত। কিন্তু স্টুয়ার্ট বিন্দুমাত্র বিচলিত হতেন না। বরং কৃষ্ণপ্রেমে আপ্লুত হয়ে সংবাদপত্রে হিন্দুধর্ম, দর্শন, রীতিনীতির স্তুতিতে প্রবন্ধ লিখতেন এবং উৎসাহিত করতেন অন্যদের। অন্যদিকে খ্রিস্টান যাজকদের গণধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধে প্যামফ্লেটে প্রচার করতেন। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত স্টুয়ার্ট তারভিন্ডিকেশন অফ দ্য হিন্দু'স বইয়ে ভারতে ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারকদের কাজের সমালোচনা করে বলেছেন -

"একটি সভ্য সমাজের জনসাধারণের উপযুক্ত সঠিক পথ প্রদর্শন এবং নৈতিক উন্নতির জন্য হিন্দুধর্মের প্রয়োজনীয়  সাহায্য খ্রিস্টধর্মের কাছে সামান্যই।

স্টুয়ার্ট এই বইতে আরো ব্যাখ্যা করে মিশনারিদের আক্রমণ থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষায় বলেছেন -

"আমি  আমার চারপাশের যেদিকে তাকাই, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর বিশাল সমুদ্রের মাঝে, আমার বিচার বুদ্ধিতে  ধার্মিকতার... নৈতিকতার... যে সুনির্দিষ্ট রূপ এখানে প্রদর্শিত হয় তা বিশ্বের অন্য কোথাও কদাচিৎ চোখে পড়েছে।"

বইটি জুড়ে স্টুয়ার্ট, ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারকদের সমূহ বিপদ সম্পর্কে সজাগ করে, ভারতীয়দের খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টায় সতর্ক করেছেন, তাদের ধর্মান্তরকরণের প্রক্রিয়াটিকে তিনি "অপরাধী, অপ্রয়োজনীয়, বিপজ্জনক, বুদ্ধিহীন এবং উন্মাদ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন - "যদি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের অবমাননা করা হয়, তাহলে আমরা আমাদের হিন্দু সৈন্যদের বিশ্বস্ততায় কীভাবে আস্থা রাখতে পারি?"

চার্লস স্টুয়ার্ট প্রাত্যহিক জীবন-যাপনে হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি যেমনভাবে গ্রহণ করেন, তেমনই ভারতের ন্যায় উষ্ণ ক্রান্তীয় দেশের উপযুক্ত পোশাক-আশাক ছিল তার পছন্দের। প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে বের হয়েই তিনি স্বাভাবিক ভারতীয় পোশাক পরতেন এবং  স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। অন্যদের উৎসাহিত করতেন। শাড়িতে ভারতীয় নারীর সৌন্দর্য অতুলনীয়। স্টুয়ার্ট হিন্দু নারীর শাড়ির পরার প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। শাড়িকে তিনি দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষক এবং যৌন আবেদনময় পোশাক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ইউরোপীয় মহিলাদের হাল ফ্যাশনের পোশাকের চেয়ে শাড়ি অনেক সুন্দর এবং তাদেরও শাড়ি পরা উচিত বলে মনে করতেন তিনি। এনিয়ে তিনি 'দৈনিক ক্যালকাটা টেলিগ্রাফ'-এ বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। বহু লেখালেখিও চলেছিল বহুদিন। নিজের কর্মক্ষেত্রে পোশাক বিষয়ে তার মতবাদ প্রচলনের চেষ্টায় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অধস্তন সেপাইদের লম্বা গোঁফ ও তিলক পরার অধিকার দিয়ে  ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে সাসপেন্ড হন, তবে পরের বছরেই পদোন্নতির সাথে পুনরায় বহাল হন।

পারিবারিক জীবন

সম্পাদনা

চার্লস স্টুয়ার্টের প্রথম স্ত্রী স্যার উইলিয়াম গর্ডনের কন্যা, দ্বিতীয় স্ত্রী রেভারেন্ড নিকোলাস রিডার কন্যা অ্যানি। স্টুয়ার্ট নিঃসন্তান ছিলেন। [] বিশিষ্ট লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল রচিত White Mughals বা শ্বেত মুঘল বইটিতে অবশ্য স্টুয়ার্টের ভারতীয় স্ত্রী উল্লেখ আছে যাকে নিয়ে তিনি সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছেন কাজের ফাঁকে।[]

উত্তরাধিকার

সম্পাদনা
 
চার্লস স্টুয়ার্ট-এর সমাধি - কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থানে

চার্লস স্টুয়ার্ট যদিও মনেপ্রাণে হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত ছিলেন, তাঁর উপাস্য দেবতা ছিলেন গোপাল, তিনি খ্রিস্টীয় মতবাদকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেননি। কারণ, তিনি হিন্দু দেবতা কৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতারে মানবজাতির উপকারে  পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া যেমন বিশ্বাস করতেন, তেমনই  "খ্রিস্টান ধর্মের সাথে এটি খুব বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ নয়"। তার শেষ ইচ্ছা ছিল তাকে যেন এক অ্যাংলিকান কবরস্থানে তার উপাস্য দেবতার মূর্তিগুলির সঙ্গে  সমাহিত করা হয়।  

স্টুয়ার্ট ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মার্চ পরলোক গমন করেন  এবং তাঁর ইচ্ছানুসারে কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থানে[] একটি সমাধিতে তাকে ও তার উপাস্য দেবতা গোপালবিগ্রহের  সঙ্গে  সমাধিস্থ করা হয়। ভক্ত ও  ভগবানের শেষশয্যার উপর নির্মিত হয়  হিন্দু মন্দিরের আদলে এক স্মৃতিসৌধ।

চার্লস স্টুয়ার্টের ভারতবাসে বিশেষকরে কলকাতার বাসস্থান, উড স্ট্রিট  ও থিয়েটার রোডের মাঝামাঝি চৌরঙ্গির অট্টালিকা ভরা ছিল  অসংখ্য প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ-জৈন মূর্তি, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, পুঁথিপত্র, রংবাহারি পোশাকসহ ঐতিহাসিক সামগ্রীতে। এগুলি ছিল তার সারাজীবনের অসাধারণ পুরাকীর্তির সংগ্রহ। নিজের সেনাবাহিনীর পোস্টিং কাজে লাগিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থান হতে সংগ্রহ করেছিলেন বিরল  মূর্তি ও অন্যান্য প্রত্ন সামগ্রী।  স্টুয়ার্টের মৃত্যুর পর ভারতীয় প্রত্নমূর্তির এই বিপুল সংগ্রহ লন্ডনের ক্রিস্টি-র নিলামে উঠে 'জন ব্রিজ' ও পরে তার ভাই জর্জ ব্রিজের মাধ্যমে  অবশেষে ঠাঁই হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে - ব্রিজ কালেকশন নামে।[][]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ ডিসেম্বর ২০২১)। "জনৈক সাহেব-হিন্দুর কাহিনী"anandabazar.com। আনন্দবাজার পত্রিকা। ১২ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০২১ 
  2. Spurrell, J. C. In Search of Thomas Smyth, Mayor of Limerick, Irish Family History Journal, Vol. 25 (2009)
  3. "হিন্দু স্টুয়ার্টের মুসলিম বাংলা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৪ 
  4. The South Park Street Cemetery, Calcutta, published by the Association for the Preservation of Historical Cemeteries in India, 5th ed., 2009
  5. See Michael D. Willis, 'Sculpture of India' in A. W. Franks: Nineteenth-century collecting and the British Museum, ed. M. Caygill and J. Cherry (London: British Museum Press, 1997), pp. 250–61. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭১৪১-১৭৬৩-৮
  6. British Museum Collection

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা