খালেদ মোশাররফ হত্যাকাণ্ড

মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তা যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেক্টর ২ এর সেক্টর কমান্ডার আর কে ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন।

মুজিব হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটনকারী সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ হিসেবে পাল্টা অভ্যুত্থানের অনতিবিলম্বকাল পরে সঙ্ঘটিত একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় খালেদ মোশাররফকে তার সহকর্মী অফিসার সমেত হত্যা করা হয়।

প্রেক্ষাপট

সম্পাদনা

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা মিলে হত্যা করে। হত্যার পরে, খন্দকার মোশতাক আহমেদ হত্যাকারী কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুসারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। সেনা কর্মকর্তাগণ বঙ্গভবন (রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন) দখল করে এবং রাষ্ট্রপতিকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে, যা নতুন জাতির মধ্যে চাক্ষুষ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।[]

মোশাররফ বঙ্গভবনের অভ্যন্তরে থাকা খুনিদের থামানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অভ্যুত্থান পরিচালনা করেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বর তিনি নিজেকে সেনাবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেন। তার আদেশ মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব মিলিটারি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কে গৃহবন্দী করা হয়। ৬ নভেম্বরে, মোশাররফকে ডেপুটি চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের একজন হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।[]

১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনারা একটি বিদ্রোহ করে।[]

পরিকল্পনা

সম্পাদনা

মোশাররফকে হত্যার ষড়যন্ত্র, সেইসাথে কর্নেল শাফাত জামিল সহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিল ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের চক্রান্তের একটি অংশ।

কর্নেল শাফাত জামিলের সহায়তায় মোশাররফ কর্তৃক ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘটার পর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার (বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা) প্রধান কর্নেল আবু তাহের মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে এবং একটি শ্রেণীহীন সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠার জন্য পাল্টা অভ্যুত্থান সংগঠিত করার পদক্ষেপ নেন চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির মতো বাংলাদেশে।[]

আবু তাহের তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে ব্যবহার করে মোশাররফ, শাফাত জামিল, কর্নেল নাজমুল হুদা এবং ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান নেতাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দালাল হিসেবে অপপ্রচার শুরু করেন।[] তারা মোশাররফ এবং তাদের ভারত বিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সৈন্যদের কাছে লিফলেট বিতরণ করেছিল যাতে তাকে ভারতের এজেন্ট হিসেবে প্রমাণ করা যায়। তাহের বন্দী জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে সাধারণ সৈনিকদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসারদের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে রাজি করান।[]

উপরন্তু, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের তাদের নেতার দ্বারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে কোনো মুহূর্তে মোশাররফ ও জামিলকে গুলি করে মেরে ফেলতে।[]

ঢাকা সেনানিবাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্মরত জামিল ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাত ১০টায় মোশাররফের ফোন পেয়ে বঙ্গভবনের উদ্দেশ্যে সেনানিবাস ত্যাগ করার সময় চক্রান্তের কথা জানতে পারেন। ব্রিগেড মেজর হাফিজ এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার তাকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মারাত্মক পরিকল্পনা সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন।[]

জামিল বঙ্গভবনে ছুটে যান এবং নতুন নিযুক্ত চিফ অফ স্টাফের কাছে চক্রান্তের বর্ণনা দেন যিনি কিছু রাজনৈতিক ইস্যুতে বিভ্রান্ত ছিলেন। মোশাররফ বধির কান ঘুরিয়ে অভ্যুত্থান সহজ করলেন।[]

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাতে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার সাথে মোশাররফ হত্যাকাণ্ডের সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন কোণ থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা সেই রাতে মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ করতে চেয়েছিল।

৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের কয়েক ঘণ্টা আগে মোশাররফ বঙ্গভবনে ছিলেন। তিনি সামরিক আইনের অধীনে তাদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধানের সাথে তর্ক করছিলেন। বিষয়টি সমাধানের জন্য জামিলকে ডাকা হয়। জামিল মোশাররফকে সেনানিবাসে নবজাতক অভ্যুত্থানের কথা বললে মোশাররফ সেটাকে গুরুত্বের সাথে নেননি এবং অফিসারদের সাথে কথা বলতে থাকেন।[]

ঢাকা সেনানিবাস থেকে মোশাররফ ফোন পেলেন। ওই ডাকে তাকে সেনানিবাসে বিদ্রোহের কথা জানানো হয়। তিনি কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদার সাথে এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। জামিলকে বঙ্গভবনে থাকতেও বলেন তিনি।[]

অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট পর জিয়াউর রহমান মুক্তি পান। রহমানকে ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। চীফ অফ স্টাফ সৈনিক এবং জুনিয়র অফিসারদের সকল সিনিয়র অফিসারদের ডাকতে বললেন।[] তিনি দৃঢ়ভাবে নির্দেশ দিলেন যে তিনি আর কোন রক্তপাত চান না।[] রাত ৩টার দিকে জামিল রহমানের কাছ থেকে ফোন পান। রহমান তাকে মিটমাট করতে বলেন।[]

পুরো সেনানিবাস যখন ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেতাকে উদযাপন করছিল, তখন মোশাররফ এবং তার দুই সহযোগী নিরাপদ স্থানের সন্ধানে একটি গাড়িতে করে ভ্রমণ করছিলেন।[] তারা সাবেক জাতীয় রক্ষীবাহিনী প্রধানের বাড়িতে গিয়েছিলেন। দুপুর ২টায় কর্নেল নুরুজ্জামান। তারা সেখানে তাদের পোশাক পরিবর্তন করে। সেখানে অবস্থানকালে মোশাররফ গুলির শব্দ শুনতে পান। তাদের গাড়ির চালক আমির আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করতে থাকেন।[]

মোশাররফ চালককে ছেড়ে দেন এবং হুদাকে গাড়ি চালাতে বলেন। এরপর তারা মোশাররফের এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান। মোশাররফ তার আত্মীয়ের ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করে কয়েকজনকে ফোন করেন। প্রথমে তিনি লেফটেন্যান্ট কামরুলের কাছে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান যিনি তার ফোন কলটি তুলেছিলেন। কামরুল তাকে পরিস্থিতি জানায়। পরে তিনি দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল নওয়াজিশ আহমেদকে ফোন করেন। আহমেদ তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেন।[]

নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে মোশাররফ শেরেবাংলা নগরে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পে যাত্রা শুরু করেন। শেরেবাংলা নগরে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন হুদা। তারা মোহাম্মদপুরের ফাতেমা নার্সিং হোম নামের একটি ক্লিনিকে যান। এরপর তারা হেঁটে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পে যায়। তারা ক্যাম্পে পৌঁছলে রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য তাদের থামিয়ে তাদের বন্দুক কেড়ে নেয়।[]

আহমেদ রহমানকে মোশাররফের শিবিরে উপস্থিতির কথা জানান। এটা জেনে রহমান নওয়াজিশকে মোশাররফের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সম্ভাব্য যেকোনো হামলা থেকে রক্ষা করতে বলেন।[][][][][] আতঙ্কিত না হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। তারপর তিনি রেজিমেন্টের আরেক কর্মকর্তা মেজর জলিলের সাথে কথা বলেন এবং তাকে তিনজনকে বাঁচাতে নওয়াজিশকে সহায়তা করার নির্দেশ দেন। মোশাররফের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পেরে প্রায় ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে চলে যান।[][]

মৃত্যু

সম্পাদনা

চিফ অফ স্টাফের আশ্বাস পাওয়ার পর নওয়াজিশ অফিসারদের জন্য সকালের খাবারের ব্যবস্থা করেন।[] তিনজনকে খাবার পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে ইউনিফর্ম পরা কিছু যুবক, সম্ভবত তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু কর্মী, ছুটে এসে ঘরে ঢুকে তিনজনকে বন্দুক দেখিয়ে জোর করে বের করে দেয় এবং এরপর গুলি করে ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের বেয়োনেটচার্জ করে।[]

কিছু অভ্যন্তরীণ সামরিক সূত্রে জানা যায়, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কয়েকজন কর্মী এই কর্নেল আসাদুজ্জামানকে উক্ত হত্যা করার বার্তা দিয়েছিলেন, যিনি পরবর্তীতে এই তিনজন কর্মকর্তাকে হত্যার নেতৃত্বদানকারী হিসেবে অভিযুক্ত হন।[]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Anthony Mascarenhas (১৯৮৬)। Bangladesh: A Legacy of Blood। Hodder and Stoughton। আইএসবিএন 0-340-39420-X 
  2. মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (২০০০)। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য। মাওলা ব্রাদার্স। 
  3. শাহাদুজ্জামান (২০১০)। ক্রাচের কর্নেল। মাওলা ব্রাদার্স। 
  4. কর্নেল শাফায়াত জামিল (১৯৯৮)। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। সাহিত্য প্রকাশ। 
  5. নীলুফার হুদা (২০১২)। কর্নেল হুদা ও আমার ুদ্ধ। প্রথমা। 
  6. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি (২০১১)। পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ। আফসার ব্রাদার্স। 
  7. লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ হামিদ (২০১৩)। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা। হাওলাদার। 
  8. জহিরুল ইসলাম (২০১২)। মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্তক বিদায়। প্রথমা। 
  9. "The war waged by a heroic woman", The Daily Star, আগস্ট ২৫, ২০১২, ২৯ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২৭ জুলাই ২০১৪