কুতুয
সাইফুদ্দীন কুতুয (আরবি: سيف الدين قطز; মৃত্যু: ২৪শে অক্টোবর ১২৬০; পূর্ণনাম- মালিকুল মুযাফফর সাইফুদ্দীন কুতুয;[১] আরবি: الملك المظفر سيف الدين قطز) ছিলেন একজন মুসলিম সামরিক নেতা এবং মিশরে তৃতীয় অথবা চতুর্থ[ক] মামলুক সুলতান। তিনি জাতিগতভাবে তুর্কীয় ছিলেন।[৩][৪][৫] তিনি ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল, মূলতঃ একবছরেরও কম সময় সুলতান হিসেবে রাজত্ব করেছেন। তবে তিনি আসলে দে ফাক্তো শাসক হিসেবে দুই দশকের মত সময় রাজ্য সামলিয়েছেন।
সাইফুদ্দীন কুতুয | |||||
---|---|---|---|---|---|
মালিকুল মুযাফফর | |||||
মিশরের সুলতান | |||||
রাজত্ব | নভেম্বর ১২৫৯ – ২৪শে অক্টোবর ১২৬০ | ||||
পূর্বসূরি | মানসুর আলী | ||||
উত্তরসূরি | বাইবার্স | ||||
সিরিয়ার সুলতান | |||||
রাজত্ব | সেপ্টেম্বর ১২৬০ – ২৪শে অক্টোবর ১২৬০ | ||||
উত্তরসূরি | বাইবার্স | ||||
জন্ম | ২রা নভেম্বর ১২২১ খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য | ||||
মৃত্যু | ২৪ অক্টোবর ১২৬০ সালেহিয়া, মামলুক সালতানাত | (বয়স ৩৮)||||
সমাধি | |||||
| |||||
রাজবংশ | খোয়ারেজমীয় | ||||
ধর্ম | সুন্নি ইসলাম |
মিশরে তাকে দাস হিসেবে বিক্রয় করা হয়েছিল। অথচ খুব দ্রুতই তিনি সুলতানের পিছনে দাঁড়িয়ে মূল শক্তি হিসেবে রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। সপ্তম ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত করার পিছনে তিনি মূল কারণ ছিলেন। ক্রুসেডাররা ১২৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দে মিশর আক্রমণ করেছিল। ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোলরা মিশর ধ্বংস করার হুমকি দিলে তিনি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ১৫ বছর বয়সী সুলতান মানসুর আলীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ততদিনে সিরিয়া ও বাগদাদের মুসলিম শক্তিশালী সালতানাতগুলোকে মঙ্গোলরা পরাজিত করে ফেলেছিল। এমনকি বাগদাদের খেলাফতকেও পদানত করেছিল। যার ফলে মিশরের ইসলামি আমিরাত মুসলিম ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। যার ফলে মঙ্গোলরা মিশরকে তাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল। কুতুয মিশরের দীর্ঘদিনের শত্রু ক্রুসেডারদের সাথে একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তিচুক্তি করেন। তারপর তিনি মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি মামলুক সৈন্যবাহিনী তৈরি করেন।
১২৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব গ্যালিলিতে মিশরীয় মামলুক সেনাবাহিনী আর মঙ্গোলদের মধ্যে আইন জালুতের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মঙ্গোলরা কুতুযের বাহিনীর কাছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে পরাজিত হয়েছিল। মঙ্গোলদের পরাজয়ের ফলে যুদ্ধটি সেই শতাব্দীর ইতিহাস পরিবর্তন করে দেয়া যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কায়রোতে বিজয়ী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করার সময়ে সহকর্মী মামলুক নেতা বাইবার্সের হাতে নিহত হন। কুতুয অনেক সংক্ষিপ্ত সময় শাসন করলেও তিনি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মামলুক সুলতান। এছাড়া মুসলিম ইতিহাসেও তার নাম অত্যন্ত সম্মানের সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।[৬]
পটভূমি
সম্পাদনাকুতুয প্রকৃতপক্ষে ছিলেন পারস্যের তুর্কীয় রাজপুত্র।[৭][৮][৯] আনু. ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে, খোয়ারেজমীয় রাজবংশের পতনের সময়ে তিনি মঙ্গোলদের হাতে বন্দী হন। তাকে সিরিয়ার দামেস্কে একজন মিশরীয় ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়। ঐ বিক্রেতা তাকে কায়রোর মামলুক সুলতান আইবেকের কাছে বিক্রি করে দেন। কিছু সূত্র কুতুযের এই দাবি উল্লেখ করেছিল যে, তার আসল নাম মাহমুদ ইবনে মামদুদ এবং তিনি খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের শাসক আলাউদ্দিন মুহাম্মদ দ্বিতীয়ের বংশধর।[১০]
তিনি সুলতান আইবাকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুইযি মামলুক ছিলেন।[১১] তিনি ১২৫৩ সালে তার সহকারী সুলতান হন। ১২৫৭ সালে আইবাককে হত্যা করা হয়। এরপর কুতুয আইবাকের পুত্র মানসুর আলীরও সহকারী সুলতান ছিলেন। কুতুয মুইযি মামলুকদের নেতৃত্ব দেন। তারা আইবাকের বিধবা স্ত্রী শাজারাতুদ দুরকে গ্রেফতার করেন আর মানসুর আলীকে মিশরের নতুন সুলতান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।[১১] নভেম্বর ১২৫৭ এবং এপ্রিল ১২৫৮ সালে তিনি বাহরিয়া মামলুক[খ] এবং শাহরজুরি কুর্দিদের[গ] সমর্থিত কারাকের মালিকুল মুগিছের[ঘ] বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করেন। দ্বারা সমর্থিত ছিল এবং শাহরজুরি কুর্দিদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অভিযানগুলো কারাকের বাহরিয়া মামলুকদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছিল। কারণ, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিশরে তাদের অনুসারীদের সমর্থন করতে চেয়েছিল।[ঙ]
১২৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গোল সেনাবাহিনী বাগদাদ দখল করে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাসিমসহ অসংখ্যা লোককে হত্যা করে। এরপর তারা সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। সিরিয়া তখন আইয়ুবীয় সুলতান নাসির ইউসুফের শাসনে ছিল। তিনি হালাকু খানের কাছ থেকে একটি হুমকিমূলক চিঠি পেয়েছিলেন।[চ] নাসির ইউসুফ মিশরে অবিলম্বে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। যা ফলে সহকারী সুলতান কুতুয এবং মিশরীয় আমিররা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তখন ১৫ বছর বয়সী সুলতান মানসুর আলী এবং কুতুযের দরবারে সমবেত আমিররা তাদেরকে বলেছিলেন যে, পরিস্থিতির দুরাবস্থার কারণে মিশরের একজন শক্তিশালী এবং সক্ষম সুলতান থাকা উচিত; যিনি মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন। ১২৫৯ সালের ১২ নভেম্বর মানসুর আলী কুতুয কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। কুতুয যখন নতুন সুলতান হন, তখন তিনি আমিরদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, মঙ্গোলদের পরাজিত করার পর তারা অন্য কোনো সুলতানকে বসাতে পারবেন।[১৪]
কুতুয আমির ফারিসুদ্দীন আকতাই মুস্তারিবকে[ছ] মিশরীয় সেনাবাহিনীর আতাবেগ হিসেবে বহাল রাখেন। তিনি সেনাবাহিনীকে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন।[১৪]
মঙ্গোল হুমকি
সম্পাদনাহালাকু খান তার সৈন্যবহর নিয়ে দামেস্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। দামেস্কের দরবারে সিরিয়ার কিছু আমির নাসির ইউসুফকে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তাদের মতে, নিজেদের এবং সিরিয়াকে বাঁচানোর সর্বোত্তম সমাধান হচ্ছে হালাকু খানের কাছে সবকিছু সমর্পণ করে দেয়া। সভায় উপস্থিত বাইবার্স মামলুকরা এই পরামর্শে রাগান্বিত হয় এবং সেই রাতে নাসির ইউসুফকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নাসির ইউসুফ তার ভাইয়ের সাথে দামেস্কের দুর্গে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। বাইবার্স এবং তার সঙ্গীরা তারপর সিরিয়া ছেড়ে মিশরে পাড়ি জমান। কুতুয মঙ্গোল বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের চিন্তার জন্য তাদেরকে স্বাগত জানান। বাইবার্সকে কালয়ুব শহরের দায়িত্ব সমর্পণ করেন।[জ][১৫][১৬] নাসির ইউসুফ যখন শুনলেন, মঙ্গোল বাহিনী আলেপ্পোর দিকে আসছে; তখন তিনি তার স্ত্রী-সন্তান আর অর্থকড়ি মিশরে প্রেরণ করে দেন। দামেস্ক এবং সিরিয়ার অন্যান্য শহরের জনগণ পালাতে শুরু করে।[১৫] সাতদিন আলেপ্পো অবরোধে রেখে মঙ্গোলরা এটি দখল করে। শহরে ভাঙচুর শুরু করে এবং জনগণকে হত্যা করতে থাকে। নাসির ইউসুফ আলেপ্পোর পতনের কথা শুনে দামেস্কের অবশিষ্ট জনসংখ্যাকে অরক্ষিত রেখেই মিশরের দিকে পালিয়ে যান। কিন্তু কুতুয তাকে শহরে প্রবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। ইউসুফ মিশরের সীমানায় এভাবে অবস্থান করছিলেন। তার আমিররা তাকে ছেড়ে চলে যান। সুলতান কুতুয নাসির ইউসুফের অর্থকড়ি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন; যেগুলো তার স্ত্রী-সন্তানদের সাথে মিশরে প্ররণ করা হয়েছিল। মঙ্গোলদের কাছে আলেপ্পো পতনের ষোল দিন পর, দামেস্ক বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ করে। ইউসুফকে তার কোনো এক ক্রীতদাস বন্দী করে হালাকু খানের কাছে প্রেরণ করে।[১৭][ঝ]
সিরিয়ায় ইসলামী শক্তির কেন্দ্র এবং বাগদাদকে পদানত করার পর মিশর ইসলামী সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। যার ফলে হালাকু খানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। হালাকু খান একটি হুমকিমূলক চিঠি দিয়ে দূত প্রেরণ করে। যাতে কুতুযকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল।[ঞ] কুতুয প্রতিউত্তরে দূতদেরকে মৃত্যুদন্ড দেন। তাদের টুকরো টুকরো করা হয়েছিল এবং কায়রোর বাব জুয়েলার গেটে বসানো হয়েছিল।[১৪][২২] তারপর কুতুয মঙ্গোলদের আক্রমণের অপেক্ষা করার পরিবর্তে মিশর থেকে বের হয়ে তাদের মুকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। সেজন্য তিনি সেনাবাহিনী বৃদ্ধি করতে শুরু করেন।[২৩][২৪] অনেকে পলায়ন করতে শুরু করে। মিশরে বসবাসকারী মরক্কোররা পশ্চিম দিকে পালিয়ে যায়, আর ইয়েমেনিরা ইয়েমেন এবং হেজাজে পালিয়ে যায়।[২৩]
কুতুয সালেহিয়ায়[২৫][ট] গিয়ে মঙ্গোলদের উপর আক্রমণের জন্য কখন বের হবেন, সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কমান্ডারদের একত্রিত করেন। কিন্তু কিছু আমির মঙ্গোলদের ব্যাপারে ভীতি প্রকাশ করে। কুতুয ভীতুদেরকে তার সাথে থাকা অপমানজনক হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,
হে মুসলিমদের আমিরগণ! আপনাদেরকে দেশের কোষাগারের অর্থ দিয়ে লালন-পালন করা হয়েছে আর আপনারা আক্রমণ করতে ভয় পান? আমি একাই যাব। যে আমার সাথে যোগ দিয়ে চায়, সে যেন আমার সাথে যায়। আর যে আমার সাথে যেতে অপছন্দ করে, সে যেন ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু তারা যেন মনে রাখে, তারা আমাদের নারী ও দুর্বলদের রক্ষা না করার পাপ বহন করবে।[২৪]
মঙ্গোলদের ছোট একটি গ্যারিসন পর্যবেক্ষণ করতে কুতুয বাইবার্সকে গাজায় একটি বাহিনী নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। গ্যারিসনটি বাইবার্সরা সহজে পরাজিত করেন।[১৪] গাজায় একদিন অতিবাহিত করে কুতুয তার সেনাবাহিনীকে উপকূল বরাবর আক্কার দিকে নিয়ে যান। আক্কা তৎকালীন অবশিষ্ট ক্রুসেড রাষ্ট্র জেরুজালেম রাজ্যের একটি অংশ ছিল। ক্রুসেডাররা এমনিতে ছিল মামলুকদের ঐতিহ্যবাহী শত্রু। এমনকি, ফ্র্যাঙ্কো-মঙ্গোল জোট গঠনের বিষয়ে মঙ্গোলরা তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিল। যাইহোক, সে বছর ক্রুসেডাররা মঙ্গোলদের আরো বড় হুমকি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কুতুয মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডারদের সাথে একটি সামরিক জোট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রুসেডাররা দুই বাহিনীর মধ্যে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তারা কুতুয এবং তার সেনাবাহিনীকে ক্রুসেডার অঞ্চলগুলোর মধ্যে অবিচ্ছিন্নভাবে ভ্রমণ করার এবং ক্রুসেডারদের শক্তিশালী ঘাঁটি আক্কার নিকটবর্তী এলাকায় গ্যারিসন তৈরি করার অনুমতি দেয়। কুতুয এবং তার সেনাবাহিনী আক্কায় তিনদিন অবস্থান করেন।[২৬] যখন তারা মঙ্গোলদের জর্দান নদী অতিক্রম করার সংবাদ পান, তখন কুতুয এবং বাইবার্স মঙ্গোলদের মুকাবেলা করতে তাদের সেনাবাহিনীকে আইনে জালুতের অভিমুখে নিয়ে চলেন।[২৭]
আইন জালুতের যুদ্ধ
সম্পাদনা৩রা সেপ্টেম্বর ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে আইনে জালুতের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি ছিল ইতিহাসের মোড় পাল্টে দেয়া একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। এদিকে যুদ্ধটির মাত্র দশ বছর পূর্বে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে একই বাহরি মামলুকরা (কুতুয, বাইবার্স এবং কালাউন) ফ্রান্সের রাজা নবম লুইয়ের সপ্তম ক্রুসেডের বিরুদ্ধে মিশরের নেতৃত্ব দিয়েছিল। যেই যুদ্ধে মামলুকরা সিদ্ধান্তমূলক বিজয় পেয়েছিল। অপরদিকে আইনে জালুতে মঙ্গোল সৈন্যদলের নেতৃত্বে ছিল কিতবুগা। তার সাথে ছিল নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান নাইমান তুর্ক; যাকে সিলিসিয়ান আর্মেনীয় রাজা আর অ্যান্টিওকের খ্রিস্টান রাজপুত্র সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছিল।[২৮] খোয়ারিজম, বাগদাদ আর সিরিয়ার পতনের পরে মিশরই ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের শেষ দুর্গ। আর শামের উপকূলে ক্রুসেড বেলামুখের অস্তিত্ব মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।[২৯] একারণে ইসলাম এবং পশ্চিমা খ্রিস্টানদের পরবর্তী ইতিহাস এই যুদ্ধের ফলাফলের উপরই নির্ভরশীল ছিল। যেই যুদ্ধ মধ্যযুগের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই সৈন্যদল মামলুক আর মঙ্গোলদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। যদিও মঙ্গোলদের সাথে কিছু খ্রিস্টান ক্রুসেডারও ছিল।[৩০]
বাইবার্স অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি দ্রুতগামী সেনাপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।[৩১] তিনি কৌশলে মঙ্গোল বাহিনীকে আইনে জালুতে প্রবেশ করতে বাধ্য করেন। সেখানে কুতুযের নেতৃত্বে মিশরীয় সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছিল। মিশরীয়রা প্রথমে মঙ্গোল হামলার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। তাদের সেনাবাহিনীর বাম অংশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করে। কিন্তু কুতুয দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি তার শিরস্ত্রাণ খুলে ছুড়ে মারেন আর "ইয়া ইসলামাহ" (হায় ইসলাম) বলে চিৎকার করতে থাকেন। তিনি তার নিজস্ব ইউনিটকে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দিকে অগ্রসর হন।[২৩][২৭][৩২] তিনি মঙ্গোলদের পিছু হটতে বাধ্য করেন এবং তারা বাইতুশ শেয়ানের দিকে পালিয়ৈ যায়। কিন্তু তারা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে এবং পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে। কুতুয তিনবার উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে বলেন, হায় ইসলাম! হে আল্লাহ, আপনার গোলাম কুতুযকে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করুন।[৩২] কিন্তু শেষপর্যন্ত মঙ্গোলরা তাদের খ্রিস্টান ও মুসলিম মিত্ররা[৩৩] কুতুযের সেনাবাহিনীর কাছে পুরোপুরি পরাজিত হয়। তারা সিরিয়ার দিকে পলায়ন করে, কিন্তু সেখানকার স্থানীয় জনগণ তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করে।[২৩][৩৪] কুতুয সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। তার সেনাবাহিনী গণিমতের মাল একত্রিত করতে শুরু করে।মঙ্গোল বাহিনীর সেনাপতি কিতবুগাকে হত্যা করা হয়। তার কর্তিত মস্তক কায়রোতে প্রেরণ করা হয়।[৩২]
মঙ্গোলরা মুসলিম বিশ্বে আক্রমণের পর এটিই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও সামরিক পরাজয়। তারা প্রথমে দামেস্ক থেকে, পরে সমগ্র উত্তর শাম থেকে পলায়ন করতে শুরু করে।[৩২] কুতুয তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে দামেস্কে প্রবেশ করেন। বাকি মঙ্গোলদের নির্মূল করতে বাইবার্সকে হিমসে প্রেরণ করেন। আলমুদ্দীন সিনজারকে কুতুয দামেস্কে সুলতানের সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেন। আলেপ্পোর দায়িত্ব মসুলের আমির মালিকুস সাইদ আলাউদ্দীনের হাতে অর্পণ করেন।[৩২] এছাড়া কুতুয নতুন আব্বাসীয় খলীফা নিয়োগ করার জন্য চিন্তা করেন।[ঠ] মিশরের সীমান্ত থেকে দজলা নদী পর্যন্ত পুরো শাম মঙ্গোলদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল। এই বিজয়ের পর মামলুকরা তাদের সার্বভৌমত্বকে শামে সম্প্রসারিত করেন। তারা আইয়ুবীয় ও অন্যান্য শাসকদের দ্বারাও বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি পান।[৩৬] যখন হালাকু খান মঙ্গোল সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কথা শুনেন, তিনি তাবরিজের কাছাকাছি এলাকায় নাসির ইউসুফকে মৃত্যুদন্ড দেন।[ড] হালাকু খান মামলুক সালতানাতকে ধমকি দিতে থাকেন। কিন্তু অল্পকিছুদিন পরে ইউরেশীয় স্টেপের পশ্চিম অর্ধে গোল্ডেন হর্ডের মঙ্গোলদের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে তিনি কঠিন আঘাত পান। কারণ, বারকা খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন (আরও দেখুন: বারকা-হালাকু যুদ্ধ)। হালাকু খান ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তিনি কখনোই আইনে জালুতে মঙ্গোলদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পারেননি।[৩৮]
আইনে জালুতের যুদ্ধ বিস্ফোরক হাত কামান (আরবিতে মিদফা) ব্যবহারের প্রাচীনতম যুদ্ধ হিসেবেও পরিচিত। এই বিস্ফোরকগুলো মামলুক মিশরীয়রা মঙ্গোল ঘোড়া ও অশ্বারোহী বাহিনীকে ভয় দেখিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যবহার করেছিল। এই কামানগুলোর বিস্ফোরক গানপাউডারের বিবরণের উল্লেখ পরবর্তীতে ১৪শ শতকের গোড়ার দিকে আরবি রাসায়নিক আর সামরিক সারগ্রন্থসমূহে করা হয়েছিল।[৩৯]
গুপ্তহত্যা
সম্পাদনাকায়রোতে প্রত্যাবর্তন করার পথে সালেহিয়ায় শিকার অভিযানে কুতুযকে হত্যা করা হয়।[৪০] আধুনিক ও মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহাসিকরা বাইবার্সের এই হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। মাকরিজির মতে, যে আমিররা মূলতঃ কুতুযকে আঘাত করেছিলেন; তারা হলেন- আমির বদরুদ্দিন বকতুত, আমির ওন্স, আমির বাহাদুর মুইযি। তিনি বিশ্বাস করেন যে, বাইবার্স এই হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন।[৪১] পশ্চিমা ঐতিহাসিকরাও বাইবার্সকে ষড়যন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে তারা এই ঘটনার জন্য তাকেই দায়ী করেন।[৪২] মামলুক যুগের মুসলিম ঐতিহাসিকরা লিখেন, বাইবার্স সুলতান আইবাকে শাসনামলে তার বন্ধু ও বাহরি মামলুকদের নেতা ফারিসুদ্দিন আকতাইয়ের হত্যাকান্ডের জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। অথবা কুতুয আলেপ্পো মসুলের আমির আলাউদ্দিন মালিকুস সাঈদকে প্রদান করার কারণে; আইনে জালুতের যুদ্ধের পূর্বে কুতুয বাইবার্সকে সেটি প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।[৪০][ঢ]
কুতুযকে প্রথমে কুসাইর শহরে সমাহিত করা হয়। পরে কায়রোর একটি কবরস্থানে পুনঃ সমাহিত করা হয়।[৪৩][৪৪] বাইবারস কায়রোতে ফিরে আসেন যা মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে বিজয়ের উদযাপন এবং সজ্জিত ছিল,[৪০] যেখানে তিনি নতুন সুলতান হন। কুতুয কর্তৃক আরোপিত যুদ্ধ কর প্রত্যাহার করায় বাইবারস একসময় জনগণের দ্বারা প্রশংসিত হন। [৪৫]
মুদ্রা
সম্পাদনাকুতুযের মুদ্রাগুলো মামলুক মুদ্রার ইতিহাসে অনন্য বলে বিবেচিত হয়। কারণ তার উপাধি মালিকুল মুযাফফর সাইফুদ্দুনিয়া ওয়াদ্দিন (বিজয়ী রাজা এবং দুনিয়া ও ধর্মের তরবারি) এবং তার নাম মুযাফফর সাইফুদ্দিন (ধর্মের বিজয়ী তরবারি) ছাড়া আর কোনো নাম এতে খোদাই করা হয়নি।[৪৬]
আরও দেখুন
সম্পাদনামন্তব্য
সম্পাদনা- ↑ কিছু ঐতিহাসিকরা শাজারাতুদ দুরকে প্রথম মামলুক সুলতান হিসেবে গণ্য করেছেন। তাদের হিসেবে কুতুয চতুর্থ মামলুক সুলতান। অন্যদের হিসেবে তৃতীয়।[২]
- ↑ সুলতান আইবাকের শাসনামলে বাহারিয়া মামলুকদের নেতা ফারিসুদ্দিন আকতাইকে হত্যার পর অনেক বাহরিয়া মামলুক মিশর থেকে পালিয়ে যাযন। বাইবার্স, কালাউন এবং অন্যান্য বিশিষ্ট মামলুকরা সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু সিরিয়ার আইয়ুবী সুলতান নাসির ইউসুফের সাথে বিরোধের পর তারা কারাকে চলে যান যেটিও একজন আইয়ুবী রাজা দ্বারা শাসিত হচ্ছিল।
- ↑ শাহরজুরিরা ছিল কুর্দি। তারা মঙ্গোল আক্রমণের সময়ে মেসোপটেমিয়া থেকে পলায়ন করেছিল। তারা মালিকুল মুগিছকে দ্বিতীয় যুদ্ধে প্রতারিত করেছিল এবং মিশরের পক্ষে চলে গিয়েছিল।[১২]
- ↑ মালিকুল মুগিছ উমার বিন আদিল দ্বিতীয় বিন কামিল মুহাম্মাদ (الملك المغيث عمر بن العادل الثانى بن الكامل محمد) ছিলেন কারাকের আইয়ুবীয় শাসক। সুলতান বাইবার্সের শাসনামলে তিনি কায়রোর দূর্গে নিহত হন।
- ↑ সুলতান আইবাকের শাসনামলে বাহরি মামলুকদের নেতা ফারিসুদ্দীন আকতাইকে হত্যা করার পর তারা মিশর থেকে পলায়ন করে সিরিয়া, কারাক এবং সেলজুক সালতানাতে চলে যান। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুইজন মামলুক বাইবার্স বুন্দুকদারি আর কালাউন আলফি সিরিয়ায় যান এবং সেখান থেকে কারাকে যান। তারা সেখানে আইয়ুবীয় রাজা মালিকুল মুগিসকে মিশর আক্রমণে সম্মত করেন। (আরও দেখুন আইবাক, মানসুর আলী এবং নাসির ইউসুফ)
- ↑ হালাকু খান নাসিরের ছেলে মালিকুল আজিজকে দিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। এর একটি অংশে বলা হয়েছে: "আলেপ্পোর শাসক মালিকুন নাসির! আপনি জেনে নিন, আমরা সর্বশক্তিমান প্রভুর তরবারি দিয়ে বাগদাদ জয় করেছি। আমরা বাগদাদের নাইটদের হত্যা করেছি। বাগদাদ নগরীর ভবনগুলো ধ্বংস করেছি। আর এর বাসিন্দাদের বন্দী করেছি। আপনি যখন এই পত্র পাবেন, অবিলম্বে পৃথিবীর শাসক, রাজাদের রাজার কাছে আপনার সমস্ত জনগণ আর অর্থকড়ি এবং সেনাবাহিনী সমর্পণ করবেন। এর ফলে আপনি খারাপ পরিণাম থেকে বেঁচে যাবেন আর উত্তম ফল পাবেন। আমরা শুনেছি যে, লেভান্তের ব্যবসায়ী ও অন্য আরো অনেকে তাদের অর্থকড়ি ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মিশরে পলায়ন করেছে। যদি তারা পাহাড়ে লুকিয়ে থাকে, তাহলে আমরা পাহাড়কে ধ্বংস করব। তারা যদি দ্বীপে লুকিয়ে থাকে, তাহলে আমরা দ্বীপ ডুবিয়ে দেব। নিরাপত্তা কোথায়? কেউই পালাতে পারবেনা। কারণ আমরা জল এবং স্থল উভয়েরই মালিক... সিংহরা আমাদের মর্যাদা দ্বারা সম্মানিত হয়েছে। রাজকুমার আর উজিররা আমাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে।"[১৩]
- ↑ নাম, উপনাম এবং সমসাময়িক হওয়ায় ফারিসুদ্দীন আকতাই জেমদারের সাথে বিভ্রান্ত হবেন না। ফারিসুদ্দীন আকতাই বাহরি মামলুকদের নেতা ছিলেন এবং মানসুর আলীর পিতা আইবাক তাকে হত্যা করেন।
- ↑ কালয়ুব বর্তমানে উত্তর কায়রোর কালয়ুবিয়া গভর্নোরেটের অধীনের শহর।
- ↑ নাসির ইউসুফ, তার সন্তান আজিজ এবং ভ্রাতা যাহির গাজায় তার এক ক্রীতদাস বা চাকর কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। যে তাদেরকে হালাকু খানের কাছে প্রেরণ করে। আরেকটি ভাষ্যমতে, নাসির কিতবুগার কাছে গিয়েছিলেন; যে তাকে গ্রেফতার করে হালাকু খানের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
- ↑ পূর্ব ও পশ্চিমের রাজাদের রাজা থেকে, পরাক্রমশালী খান: তোমার নামে, হে ঈশ্বর! তুমি যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশকে উঁচু করেছেন। মালিকুল মুযাফফর কুতুয, যিনি ক্রীতদাসের বংশের, যে আমাদের তরবারির ভয়ে এই দেশে পালিয়ে এসেছে, এর স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করেছে এবং এর শাসকদের হত্যা করেছে। (হে প্রভু!) মালিকুল মুযাফফর কুতুয এবং তার আমিরগণ এবং মিশর এবং এর পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর জনগণদের জানিয়ে দিন, আমরা তার পৃথিবীতে ঈশ্বরের সেনাবাহিনী। তিনি আমাদেরকে তাঁর ক্রোধ থেকে সৃষ্টি করেছেন। যারা সৃষ্টিকর্তাকে ক্রোধান্বিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আদেশ করেছেন। আমাদের বিজিত এলাকাসমূহে আপনাকে উপদেশ দেয়ার এবং আমাদের সংকল্পের প্রতি স্পর্ধা থেকে বিরত রাখার উদাহরণ মজুদ রয়েছে। অন্যদের দুর্ভাগ্য দ্বারা সতর্ক হোন। পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার আগে আপনার ক্ষমতা আমাদের হাতে তুলে দিন। নইলে আপনাকে অত্যন্ত আফসোস করতে হবে। আর আপনার ভুলগুলো আপনার দিকেই ফিরে আসবে। কারণ, যারা কাঁদে আমরা তাদের প্রতি দয়া করিনা। যারা অভিযোগ করে, তাদের প্রতি আমরা কোমল হইনা। আপনি জানেন, আমরা দেশগুলোকে পদানত করেছি। পৃথিবীকে দুর্নীতিমুক্ত করেছি। বেশিরভাগ মানুষদেরকে হত্যা করেছি। তোমরা শুধু পলায়ন করবে আর আমরা তাড়া করব। কোন ভূমি তোমাকে আশ্রয় দেবে? কোন রাস্তা তোমাকে রক্ষা করবে? কোন দেশ তোমাকে রক্ষা করবে? আমাদের তরবারি থেকে তোমাদের কোনো মুক্তি নেই। আমাদের ভয় থেকে তুমি পালাতে পারবেনা; কারণ আমাদের ঘোড়াগুলো অত্যন্ত দ্রুত। আমাদের তীরগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। আমাদের তলোয়ার বজ্রের মত। আমাদের হৃদয় পাথরের মত। আমাদের সংখ্যা বালুর মত। দুর্গে আমাদের জায়গা সংকুলনা হয়না। আমাদের সাথে যুদ্ধ করে সেনাবাহিনীর কোন লাভ নেই। আমাদের বিরুদ্ধে আপনার কোনো দোয়াই কবুল করা হবেনা। কারণ, আপনি হারাম জিনিস গলধঃকরণ করেছেন, নোংরা কথা বলেছেন, প্রতিশ্রুত ভঙ্গ করেছেন এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আর আপনার মধ্যে অবাধ্যতা ও মুনাফেকি বিদ্যমান। আপনি জেনে নিন, আপনার পরিণতি খুবই লজ্জাজনক হবে।
“আজ তিনি অপমানজনক শাস্তি দিয়ে শুরু করেছেন। কারণ, আপনি পৃথিবীতে অন্যায় আর অহংকারী ছিলেন।” (কুরআন, সুরা আহক্বাফ: ২০)
“যারা অন্যায় করেছে, তারা যেন জেনে নেয়, সেগুলো তাদের দিকে ফিরে যাবে।” (কুরআন, সুরা শূআরা: ২২৭)
যারা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা অনুতপ্ত হয়। যারা আমাদের কাছে সুরক্ষা চায়, তারাই নিরাপদে থাকে। যদি আপনি আমাদের আদেশ মেনে নেন এবং আমাদের উল্লেখিত শর্তের বিষয়াবলী জমা দেন; তাহলে আপনার অধিকার এবং কর্তব্য আমাদের মতই বিবেচিত হবে। আর যদি প্রতিরোধ করেন, তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবেন। অতএব, নিজের হাতে নিজের ধ্বংস ডেকে আনবেন না। যাকে সতর্ক করা হয়েছে, তার সতর্ক থাকা উচিত। আপনি মনে করছেন যে, আমরা কাফের। আর আমরা নিশ্চিত যে, আপনি পাপাচারী। প্রভু, যিনি সবকিছু নির্ধারণ করেন আর সকলের বিচার করেন; তিনি আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের আহ্বান করেছেন। আমাদের কাছে যা অতি সামান্য, আপনাদের কাছে সেটা অনেক বেশি। আমাদের কাছে যেটা খুবই নগণ্য, সেটা আপনাদের কাছে খুবই সম্মানিত। আপনাদের রাজারাও আমাদের কাছে অপমান ছাড়া আর কিছু আশা করতে পারেনা। বেশি দেরি করবেন না। যুদ্ধের আগুন জ্বলে তার স্ফুলিঙ্গ আপনার উপর নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে দ্রুত উত্তর দিন। নইলে আপনার সম্মান, আরাম, সুরক্ষা বা আশ্রয় কিছুই বাকি থাকবেনা। আর আপনি আমাদের হাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। আপনার দেশ আপনার থেকে খালি হয়ে যাবে। আপনাকে চিঠি লিখে আমরা আপনার সাথে সঙ্গত আচরণ করেছি। আর আপনাকে সতর্ক করেছি। এখন আমাদের আর কোনো কাজ নেই, আপনার কাজ ছাড়া। আমার এবং আপনার উভয়ের উপর সালাম বর্ষিত হোক। তাদের উপরও বর্ষিত হোক, যারা ঐশ্বরিক নির্দেশনা অনুসরণ করে, মন্দ পরিণতিকে ভয় করে এবং মহান রাজার আনুগত্য করে। মিশরের জনগণকে বলুন, হালাকু খান এসেছে ধারালো ও খোলা তরবারি হাতে। তার সামনে সবচেয়ে শক্তিশালী লোকেরাও বিনম্র হয়ে যায়। আর সে পরবর্তীদেরকে পূর্ববর্তীদের কাছে (কবরে) পাঠিয়ে দেয়। (কুতুযের প্রতি হালাকু খানের চিঠি) [১৮][১৯][২০][২১]
- ↑ সালেহিয়াও বর্তমানে উত্তর মিশরে অবস্থিত। নীল বদ্বীপের পাশে। শারকিয়া গভর্নোরেটের অধীনে।
- ↑ দামেস্কে কুতুয আবুল আব্বাস আহমদকে নতুন আব্বাসীয় খলীফা হিসেবে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কুতুযের হত্যাকান্ডের পর বাইবার্স আবুল আব্বাসকে কায়রোতে আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু তার আগমনের পূর্বেই আবুল কাসিম আহমদ নামীয় আরেকজন আব্বাসীয় কায়রোতে পৌঁছেন এবং বাইবার্স কর্তৃক নতুন আব্বাসী খলীফা নির্বাচিত হন। কুতুযের নির্বাচিত আবুল আব্বাস সিরিয়ায় ফিরে যান।[৩৫]
- ↑ হালাকু খান তাবরিজের কাছাকাছি অঞ্চলে নাসির ইউসুফ আর তার ভ্রাতা যাহির গাজীকে মৃত্যুদন্ড দেন। হালাকু খানের স্ত্রী তুকুজ খাতুন ইউসুফের পুত্র আজিজের জীবনের জন্য আবেদন করলে তাকে মৃত্যুদন্ড থেকে রেহাই দেয়া হয়।[৩৭]
- ↑ বিভিন্ন মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদ পরস্পরবিরোধী বিবরণ প্রদান করেছেন। মাকরিজি এবং ইবনে তাগরি বলেন যে, ঘাতকরা কুতুযকে হত্যা করেছিল যখন সে বাইবার্সের হাতে হাত দিচ্ছিল। আবুল ফিদা বলেছেন যে, কুতুয অন্য কাউকে তার হাত দিচ্ছিলেন, যখন বাইবার্স তার পিঠে তরবারি দিয়ে আঘাত করেছিল। হাসান বলেছেন যে, বাইবার্স কুতুযকে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ এনসাইক্লোপিডিয়া ইসলামিকা, "বালবেক"।
- ↑ শাইয়াল, পৃ. ১১৫/খ. ২
- ↑ মাকরিজি, পৃ.৫০৭/খন্ড: ১
- ↑ মাওসুআহ
- ↑ Holt et al., পৃ.215
- ↑ কাসিম, পৃ. ২৪
- ↑ ক্লট, অ্যান্ড্রে (২০০৯)। L'Égypte des Mamelouks: L'empire des esclaves, 1250–1517 (ফরাসি ভাষায়)। পের্রিন। আইএসবিএন 978-2-262-03045-2। ওসিএলসি 912631823।
- ↑ কোপেরম্যান, কাযিম ইয়াসার (১৯৮৯)। Mısır Memlükleri tarihi: Sultan al-Malik al-Mu'ayyad Şeyh al-Mahmûdô devri: (1412-1421) (তুর্কি ভাষায়)। সংস্কৃতি ও পর্যটন প্রকাশনা মন্ত্রণালয়। আইএসবিএন 975-17-0489-8। ওসিএলসি 644353691।
- ↑ য়িগিত, ইসমাইল (২০০৮)। Memlukler 648-923/ 1250-1517 (তুর্কি ভাষায়)। কায়িহান পাবলিকেশনস। আইএসবিএন 978-605-5996-02-4। ওসিএলসি 949555454।
- ↑ অমিতাই-প্রিস, পৃ.৩৫
- ↑ ক খ কাসিম, পৃ.৪৪
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫০০, খ. ১
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫০৬/খ. ১
- ↑ ক খ গ ঘ Shayyal, পৃ.১২২/খন্ড: ২
- ↑ ক খ মাকরিজি, পৃ.৫০৯/খন্ড: ১
- ↑ গুগল ম্যাপে কালয়ুব
- ↑ মাকরিজি, পৃ.৫১৩/খন্ড: ১
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫১৫-৫১৬/প্রথম খন্ড
- ↑ ইবনে আইবাক আদ্দাওয়িদার, পৃ. ৪৭-৪৮
- ↑ ক্বালক্বাশান্দি, পৃ. ৬৩-৬৪
- ↑ কাসিম, পৃ. ৬১
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫১৪-৫১৫/খন্ড: ১
- ↑ ক খ গ ঘ ইবনে তাগরি, পৃ. ১০৫-২৭৩/খন্ড: ৭ /মুযাফফর কুতুয অধ্যায়
- ↑ ক খ মাকরিজি, পৃ.৫১৫/খন্ড: ১
- ↑ গুগল ম্যাপে সালেহিয়া
- ↑ রিলি-স্মিথ, পৃ.২০৪।
- ↑ ক খ মাকরিজি, পৃ.৫১৬/খন্ড: ১
- ↑ টয়নবি, পৃ. ৪৪৯
- ↑ টয়নবি, পৃ. ৪৪৬
- ↑ শাইয়াল, পৃ. ১২২-১২৩/খ. ২
- ↑ ব্রিটানিকা, পৃ. ৭৭৩/খ. ২
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ শাইয়াল, পৃ. ১২৩/খ. ২
- ↑ Amitai-Preiss পৃ. 39–45.
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫১৭/প্রথম খন্ড
- ↑ শাইয়াল, পৃ. ১৩২/খ. ২
- ↑ শাইয়াল, পৃ. ১২৩-১২৪/খ. ২
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫১৮-৫১৯/প্রথম খন্ড
- ↑ মরগ্যান, ডেভিড (২০০৭)। দ্য মঙ্গোলস (২য় সংস্করণ)। ব্ল্যাকওয়েল। আইএসবিএন 978-1-4051-3539-9। ওসিএলসি 70831115।
- ↑ আহমদ ইয়া হাসান। "Gunpowder Composition for Rockets and Cannon in Arabic Military Treatises In Thirteenth and Fourteenth Centuries"। ইসলামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস (ইংরেজি)। ১৯ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ গ শাইয়াল, পৃ. ১২৬/খ. ২
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫১৯/প্রথম খন্ড
- ↑ দেখুন: পেরি (পৃ. ১৫০), রিলি-স্মিথ (পৃ. ২৩৭, বাইবার্স ... কুতুযকে হত্যা করেন"), আমিতাই-প্রেইস (পৃ. ৪৭, "আমিরদের একটি ষড়যন্ত্র, যার মধ্যে বাইবার্স অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সম্ভবত তার নেতৃত্বেই ছিল"), Holt et al. (পৃ. ২১৫,বাইবার্স "তাঁর ন্যায় উপর [কুতুজের] হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন"), এবং Tschanz.
- ↑ মাউসুআহ, পৃ. ৭৬৪/২৪তম খন্ড
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫১৯-৫২০/প্রথম খন্ড
- ↑ মাকরিজি, পৃ. ৫২১/প্রথম খন্ড
- ↑ ফাহমি, পৃ. ৮৮
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাকুতুয বাহরি রাজবংশ মামলুক সালতানাত এর ক্যাডেট শাখা জন্ম: ২রা নভেম্বর ১২২১ মৃত্যু: ২৪শে অক্টোবর ১২৬০
| ||
রাজত্বকাল শিরোনাম | ||
---|---|---|
পূর্বসূরী মানসুর আলী |
মিশরের সুলতান নভেম্বর ১২৫৯ – ২৪শে অক্টোবর ১২৬০ |
উত্তরসূরী বাইবার্স |
শূন্য | সিরিয়ার সুলতান সেপ্টেম্বর ১২৬০– ২৪শে অক্টোবর ১২৬০ |