কাটগড়া বাওড় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝিনাইদহ জেলাযশোর জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ বাওড়।

কাটগড়া বাওড়
কাটগড়া কনসার্ন
ঐতিহ্যবাহী কাটগড়া বাওড়
দেশ  বাংলাদেশ
অঞ্চল খুলনা বিভাগ
জেলা ঝিনাইদহ জেলা
উৎস বেতনা নদী
মোহনা কপোতাক্ষ নদ
দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটার (১ মাইল)

উৎপত্তিসম্পাদনা

এই বাওড়টি আনুমানিক আটশো বছর বা তারও পূর্বে বেতনা নদী হতে সৃষ্টি হয়। এটি একই সাথে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর ও যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার মধ্যবর্তী পুড়াপাড়া বাজারের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। বর্তমানে এই বাওড়টি মহেশপুরের মান্দারবাড়ীয়া ইউনিয়নের আওতাধীন। ব্রিটিশ আমলে বাওড়টি ইংরেজদের নৌপথে যোগাযোগের অন্যতম রুট হিসাবে ব্যবহার হতো। আশেপাশের প্রায় ১৯ টি খালের পানি এই বাওড়ে এসে পতিত হয়। একটি খালের মাধ্যমে বাওড়টি পার্শ্ববর্তী খড়িঞ্চা বাওড়ে পতিত হয়েছে। আর খড়িঞ্চা বাওড়টি পতিত হয়েছে কপোতাক্ষ নদে। তবে পলি জমে ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে কাটগড়া বাওড় উৎসমুখ ও মিলনস্থল থেকে বর্তমানে বিচ্ছিন্ন।

কাটগড়া নামকরণের ইতিহাসসম্পাদনা

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা ও যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী 'কাটগড়া বাওড়ে'র তীরবর্তী অঞ্চল সমূহই হচ্ছে 'কাটগড়া'। এলাকায় এই অঞ্চলটি বিভিন্ন নামে পরিচিত হলেও ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসারে এই অঞ্চলটির প্রকৃত নাম 'কাটগড়া' । আর এই কাটগড়া নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। যেটা হয়ত আমাদের অনেকেরই অজানা । দীর্ঘ ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের সাক্ষী এই 'কাটগড়া'। ইংরেজরা এদেশে এসেছিলো ব্যবসা- বাণিজ্য করতে। তাদের ব্যবসায়ীক বুদ্ধি ছিলো তীক্ষ্ণ । ক্রমান্বয়ে তারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে । ১৭৭০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে নীল চাষ শুরু হয় । বাংলার পলি সমৃদ্ধ মাটি চিরটাকালই ফসল উৎপাদনের জন্য ছিলো উপযোগী । আর তাই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে 'নীল চাষ' হতো। ইংরেজ বণিকদের ছিলো নীলের প্রতি ব্যাপক টান। কারণ, সে সময়ে নীল ছিলো একটি উল্লেখযোগ্য অর্থকরী ফসল। ঐ সময়ে নীল ব্যবসা ছিলো খুবই লাভজনক। বস্তুত, শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাপড় রঙ করার জন্য ব্রিটেনে নীলের চাহিদা খুব বেড়ে যায়। তাছাড়া আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কারণে ইংরেজ বণিকদের সেখানকার নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলা হয়ে ওঠে নীল সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র। নীল চাষের জন্য নীলকররা কৃষকের সর্বোৎকৃষ্ট জমিটি বেছে নিতো। এমনকি তারা কৃষকদের নীল চাষের জন্য অগ্রিম অর্থ গ্রহণে(দাদন) বাধ্য করতো। আর একবার এই দাদন গ্রহণ করলে সুদ-আসলে যতই কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করুক না কেন, বংশপরম্পরায় কোনো দিনও তাদের ঋণ শোধ হতো না। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে তারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে 'নীলকুঠি' স্থাপন করেন। কাটগড়া বাওড়ের তীরে ছিলো তাদের একটি 'নীলকুঠি'। যেটার নাম ছিলো 'কাটগড়া কনসার্ন'। আজ যেখানে কাটগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান, ঠিক সেই স্থানেই ছিলো এই নীলকুঠি। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম নীলকুঠী ছিলো এই কাটগড়া। ঐতিহাসিকদের মতে, এখানে প্রায় ৭৩ হাজারের অধিক শ্রমিক কর্মরত ছিলেন । অত্র এলাকার কৃষকরা অনিচ্ছা সত্বেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে ইংরেজদের কথামতো নীল চাষ করে এই কাটগড়া বাওড়ের নৌকা বোঝায় করে নিয়ে আসতো 'কাটগড়া কনসার্ন'-এ । যেসকল কৃষকরা ব্রিটিশ বণিকদের কথা মতো চলতো না, তাদেরকে কঠিন বিচারের মুখোমুখি হতে হতো। ঐ কাটগড়া কনসারনিং-এ চলতো তাদের বিচারকার্য্য। এলাকার বৃদ্ধ/জনমানুষের মাঝে কথিত আছে যে, 'এই কাটগড়া কনসারনিং এর পাশে নাকি একসময় মস্ত বড় একটা কূপ ছিলো। সেই কূপে সংগৃহীত নীল জ্বালিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হতো। এবং যেসকল চাষীরা তাদের কথামতো না চলে বিদ্রোহ করতো, তাদের ধরে নিয়ে এসে প্রত্যেকের মাথায় কাদা দিয়ে বীজ বপন করা হতো; যাদের মাথায় চারা গজাতো, তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হতো। আর যাদের গজাতো না, তাদের প্রতি চালানো হতো অকথ্য নির্যাতন।' এভাবে ইংরেজরা ক্ষমতারবলে নীল চাষীদেরকে সারাদেশের ন্যায় কাটগড়া'তে-ও অভিনব পদ্ধতিতে নির্যাতন চালাতো। এরা এতটাই নিষ্ঠুর আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো যে, অবাধ্য নীলচাষীকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। শেষ পর্যন্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নীল চাষীরা ১৮৫৯ সালে প্রচণ্ড বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। ইতিহাসে সেটি 'নীল বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। আর উপমহাদেশে এই নীল বিদ্রোহ সর্বপ্রথম শুরু হয় যশোরে। যার নেতৃত্বদান কারী ছিলেন নবীন মাধব ও বেণী মাধব নামের দুই ভাই । আর চৌগাছায় নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসদিগম্বর বিশ্বাস নামের দুই ভাই। সেই বিদ্রোহের হাওয়া এই অঞ্চলের কৃষকদের মাঝেও বইতে থাকে। তীব্র আন্দোলন আর জনরোষের মুখে পড়ে ইংরেজরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলার সংগ্রামী কৃষকদের জয় হয়। বিদ্রোহের মুখে পড়ে ১৮৬১ সালে ইংরেজ সরকার 'ইন্ডিগো কমিশন' বা নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশের উপর ভিত্তি করে নীল চাষকে কৃষকদের 'ইচ্ছাধীন' বলে ঘোষণা করা হয়, এবং 'ইন্ডিগো কন্ট্রাক্ট' বাতিল করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নীল বিদ্রোহের অবসান হয় । (পরবর্তীতে কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হওয়ায় ১৮৯২ সালে নীল চাষ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়)। আর এভাবেই সারাদেশের মতো ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তি ঘটে 'কাটগড়া কনসার্ন'এর। কিন্তু কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে এই স্থানটির নাম সেই থেকে 'কাটগড়া'ই রয়ে যায়। বর্তমানে এই 'কাটগড়া' নামানুসারে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা- প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন:- কাটগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কাটগড়া কলেজ (বর্তমানে ডাঃ সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ, কাটগড়া ), কাটগড়া কিন্ডারগার্টেন, কাটগড়া কুঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ও এস.কে কম্পিউটার এন্ড ট্রেনিং সেন্টার(সাহাপুর-কাটগড়া কম্পিউটার এন্ড ট্রেনিং সেন্টার)। বর্তমানে উক্ত প্রতিষ্ঠান গুলো এলাকায় বেশ সুনাম অর্জন করেছে। সেই সাথে এই 'কাটগড়া বাওড়' তো রয়েছেই।

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

১. জাতীয় তথ্য বাতায়ন, মান্দারবাড়ীয়া ইউনিয়ন http://manderbariaup.jhenaidah.gov.bd/site/tourist_spot/d0c947c8-1c3a-11e7-8f57-286ed488c766/%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%BE%20%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%B2%E0%A6%BE

২. সংগ্রামের নোটবুক,https://www.songramernotebook.com/archives/78229/amp[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

৩. দৈনিক সংগ্রাম, প্রতিবেদন ১৯ জুন, ২০১৯ https://dailysangram.com/post/379580-%E0%A6%9A%E0%A7%8C%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AD%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF

৪. ঝিনাইদহ জেলা পুলিশ, অফিসিয়াল ওয়েবসাইটর তথ্য http://jhenaidah.police.gov.bd/content/181.html

৫. দৈনিক স্বাধীন আলো https://www.shadhinalo.com/2019/09/05/%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%95-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%95-%E0%A6%95/

৬. জাতীয় তথ্য বাতায়ন, চৌগাছা উপজেলা http://chougachha.jessore.gov.bd/site/page/e4e8c9c7-1c4a-11e7-8f57-286ed488c766