করুণা সাহা

ভারতীয় শিল্পী (১৯২১-১৯৯৬)

করুণা সাহা ( জন্ম নাম ঘোষ; ১ জানুয়ারী ১৯২১ - ৫ মে ১৯৯৬) একজন ভারতীয় শিল্পী। কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টে পড়াশোনা করা প্রথম কয়েকজন নারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। নগ্ন অধ্যয়ন করে বিভিন্ন মাধ্যমে ছবি আঁকার জন্য তিনি জন্য সুপরিচিত।

করুণা সাহা
জন্ম
করুণা ঘোষ

(১৯২১-০১-০১)১ জানুয়ারি ১৯২১
মৃত্যু৫ মে ১৯৯৬(1996-05-05) (বয়স ৭৫)
মাতৃশিক্ষায়তনসরকারি কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট
দাম্পত্য সঙ্গীশম্ভু শাহা (বি. ১৯৪৬; মৃ. ১৯৮৮)
সন্তানচন্দ্রিমা সাহা

প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা সম্পাদনা

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কলকাতায় (বর্তমানে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি খুব অল্প বয়স থেকেই শিল্প ও সঙ্গীত শিক্ষকদের কাছ থেকে বাড়িতে চিত্রাঙ্কন এবং গান গাওয়ার প্রশিক্ষণ নেন। শিল্পকলায় তার একজন শিক্ষক ছিলেন ও সি গাঙ্গুলি। তিনি তার পিতামাতাকে অবহিত করেছিলেন গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টে (বর্তমানে গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট) মেয়েদের ভর্তির বিষয়ে। করুণা সাহা একজন শিল্পী হতে চাইলে তাঁর একটি আনুষ্ঠানিক শিল্পকলা শিক্ষা থাকা দরকার এই বিষয়ে ও সি গাঙ্গুলি জোর দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৩৯ সালে বেলতলা গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করার পরে তিনি আর্ট স্কুলে যোগদান করেন। তিনি ফলস্বরূপ কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট-এ যোগদানকারী প্রথম মহিলা ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন। এখান থেকে তিনি ১৯৪৯ সালে স্নাতক শেষ করেন।[১]

কর্মজীবন সম্পাদনা

শিল্প সম্পাদনা

প্রারম্ভিক বছর সম্পাদনা

তিনি ১৯৪৮ সালে কলকাতা অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস আয়োজিত গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট-এর বার্ষিক ছাত্র প্রদর্শনীতে তার প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরের বছর সাঁচি স্তূপের গেটওয়ে নিয়ে করা তার ডাক টিকিটের নকশাটি প্যান ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত এবং পুরস্কৃত হয়। তিনি 'আর্ট ইন ইন্ডাস্ট্রি' প্রদর্শনীতে তার পোস্টার বইয়ের প্রচ্ছদ ও চিঠির নকশার জন্য বেশ কয়েকটি প্রশংসাও পান।[২] ১৯৫০ সালে তাকে একটি বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে জঁ রনোয়ারের চলচ্চিত্র, ল্য ফ্লোভের সেটের জন্য একটি বিশেষ নয় ফুট লম্বা আলপনা ডিজাইন করতে বলা হয়।[৩] ৫০-এর দশকে করুণা সাহা প্রধানত মাথা এবং মানবদেহ অধ্যয়ন নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যান, এটি তার বিশেষ দক্ষতায় পরিণত হয়।[৪]

 
১৯৪৯ সালের ডাকটিকিট যার জন্য করুণা পুরস্কার পেয়েছিলেন

ইতালিতে পড়াশোনা সম্পাদনা

ইতালি সরকারের কাছ থেকে বৃত্তি পাওয়ার পর করুণা সাহা ইতালির ফ্লোরেন্সে চলে যান। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত অ্যাকাডেমিয়া ডি বেলে আর্টি ডি ফায়ারঞ্জে অধ্যয়ন করেন এবং ফ্রেস্কো ও ম্যুরাল পেইন্টিংয়ে ডিপ্লোমা পান। এই সময়ে, তিনি ইউরোপ জুড়ে আরও কয়েকটি গ্যালারি এবং জাদুঘর দেখার সুযোগ পান।[২] একাডেমিতে স্টুডিও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ইউরোপীয় মাস্টারদের অধ্যয়ন, মানব মূর্তি বিশেষ করে নগ্নতার প্রতি তার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তোলে। ১৯৬২ সালে ইতালি থেকে ফিরে করুণা সাহা কলকাতায় 'সেই মহিলা যিনি নগ্নতা আঁকেন' হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।[১]

পরে বছর সম্পাদনা

করুণা সাহা ইতালি থেকে ফিরে আসার পর কিছু বাণিজ্যিক শিল্প উদ্যোগে তাঁর জীবিকার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি অন্য এক শিল্পীর সঙ্গে অংশীদারিত্বে ইউনিট ৬২ নামে নিজের বাণিজ্যিক শিল্প সংস্থা শুরু করেন যা অল্প কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। পরে তিনি অন্য একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় তাঁর কর্মজীবন শুরু করলেও তা বেশি স্থায়ী হয়নি। পরে তিনি বিদ্যালয় শিক্ষায় একটি স্থিতিশীল কর্মজীবনের বিকল্প খুঁজে পান। ১৯৬৪ সালে তিনি সদ্য খোলা মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লসে শিক্ষাদান শুরু করেন, যেখানে তিনি ১৯৮৮ সালে অবসর যাওয়ার আগে পর্যন্ত পুরো-সময়ের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন।[২] তৎকালীন নারী শিল্পীদের জন্য একটি সম্প্রদায় গড়ে তোলার পরিকল্পনার সাথে, করুণা সাহা দ্য গ্রুপ গঠনের নেতৃত্ব দেন, এটি একটি শিল্পী গোষ্ঠী যার মধ্যে প্রাথমিকভাবে মীরা মুখোপাধ্যায়, শানু লাহিড়ী সন্তোষ রোহাতগী এবং শ্যামশ্রী বসু অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদের উদ্বোধনী প্রদর্শনী ১৯৮৩ সালে কলকাতার একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে অনুষ্ঠিত হয়। দ্য গ্রুপ পরবর্তী বছরগুলোতে কলকাতা দিল্লি এবং মুম্বাইতে প্রদর্শনী অব্যাহত রাখে। ১৯৯০ এর দশকে সাহার রচনাগুলো আরও পরাবাস্তববাদী হয়ে ওঠে এবং মূলত সামাজিক প্রতীক চিত্রিত হয়।[১]

সঙ্গীত সম্পাদনা

তিনি আর্ট স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি হীরেন্দ্র গোস্বামী এবং শচীন দাস মতিলালের মতো শিক্ষকদের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে একজন দক্ষ শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। এর পরে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৪৪ এবং ১৯৪৬ সালের মধ্যে তার গানের উদ্যোগের ফলে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথে যুক্ত হন।[১] তিনি এই দলটির সাথে বিভিন্ন এলাকায় ভ্রমণ এবং সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। সময়ের সাথে সাথে, তিনি আকাশবাণী প্রোগ্রামে নিয়মিত শিল্পী হয়ে ওঠেন, তার দুটি রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড হিজ মাস্টার্স ভয়েস দ্বারা প্রকাশিত হয়।[৪]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতন চলচ্চিত্রের জন্য পরিচিত ফটোগ্রাফার শম্ভু শাহাকে ১৯৪৬ সালে করুণা সাহা বিয়ে করেছিলেন। তাদের একটি কন্যা আছে তার নাম চন্দ্রিমা সাহা, যিনি একজন বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী।[৫]

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার সম্পাদনা

করুণা সাহা ৫ মে ১৯৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯৬-৯৭ সালে আর্ট হেরিটেজ গ্যালারী নয়াদিল্লিতে তার কাজের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।[৬] প্রদর্শনীর সূচিতে করুণা সাহার পরিচয় দিয়ে শিল্প সমালোচক প্রশান্ত দা লেখেন 'বাংলার সবচেয়ে স্পষ্টবাদী ও নির্ভীক নারী শিল্পী করুণা সাহার মূল্যবান অবদানের উল্লেখ ছাড়া ভারতে সমসাময়িক শিল্পের কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ হবে না।'[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Guha-Thakurta, Tapati (২০০১)। In her own right : remembering the artist Karuna Shaha। Seagull Books। আইএসবিএন 81-7046-199-5ওসিএলসি 47863747 
  2. LaDuke, Betty (১৯৯২)। Women Artists: Multi-Cultural Visions। The Red Sea Press, Inc.। পৃষ্ঠা 50। আইএসবিএন 0932415784 
  3. "Bengal alpona, "The River by Jean Renoir"— part 1"Chantal Jumel (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৫-০৮-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-০৩ 
  4. "Biography: Karuna Shaha"Art of Karuna and Shambhu Shaha। ২০২৩-০২-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-০৩ 
  5. Shaha, Shambhu (২০০১)। Captured moments, a life। Chandrima Shaha। Seagull Books। আইএসবিএন 81-7046-200-2ওসিএলসি 47965614 
  6. "List of Past Exhibitions (1977–2015)" (পিডিএফ)Art Heritage Gallery। নভেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩