আল খানসা
তুমাদির বিনতে আমর ইবনে হারিস ইবনে শারিদ আল সুলামিয়া (আরবি: تماضر بنت عمرو بن الحرث بن الشريد السُلمية) (সাধারণত আল খানসা বলে পরিচিত) (আরবি: الخنساء) ছিলেন ৭ম শতাব্দীর একজন আরব কবি। তিনি নজদ অঞ্চলে (বর্তমান সৌদি আরবের মধ্যাঞ্চল) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুহাম্মদ এর সমসাময়িক ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।
الخنساء আল খানসা Al-Khansa | |
---|---|
জন্ম | ৫৭৫ |
মৃত্যু | ৬৪৫ (বয়স ৬৯–৭০) |
পেশা | কবি |
তার সময়ে মহিলা কবিরা মূলত মৃতদের জন্য শোককবিতা লিখতেন এবং তা জনসম্মুখে প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করতেন। ভাই শাখর ইবনে আমর ও মুয়াবিয়া ইবনে আমর জন্য লেখা শোককবিতার কারণে আল খানসা এসকল প্রতিযোগিতায় সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি সাহিত্যের মহিলা কবিদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে পরিচিত।[১]
নাম ও বংশ পরিচয়
সম্পাদনাআল খানসার আসল নাম তুমাদির। চালাক-চঞ্চল স্বভাব ও মন কাড়া চেহারার জন্যে খানসা (হরিণী) নামে ডাকা হতো, এবং খানসা নামেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।[২] তার পিতার নাম আমর ইবনে শারিদ। তিনি ছিলেন কায়স গোত্রের সুলায়ম শাখার সন্তান।[৩][৪] তাদের গোত্র বনু সুলায়ম হিজায ও নাজদের উত্তরে বসবাস করতো। [৫][৬] তাদের পরিবার ধনী ছিলো।
ইসলাম পূর্ব জীবন
সম্পাদনাদুরায়দ ইবনে আস সিম্মাহ নামে আরবের বিখ্যাত নেতা খানসাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠইয়েছিলেন এবং খানসা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন[৭]
দুরায়দ প্রত্যাখ্যাত হয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন,
“হে আমার সাথী-বন্ধুগণ!
তোমরা তুমাদিরকে স্বাগতম জানাও এবং আমার জন্য অপেক্ষা কর। কারণ, তোমাদের অবস্থানই আমার সম্বল।
খানসা (হরিণী) কি তোমাদের হৃদয়কে প্রেমে পাগল করে তুলেছে এবং তার ভালোবাসায় তোমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছো?[৮]
এরপর খানসা বিয়ে করেন স্বগোত্রীয় যুবক রাওয়াহা ইবনে আবদিল উযযাকে। তার ঔরসে পুত্র শাজারা আবদুল্লাহর জন্ম হয়।
কিছুদিন পর রাওয়াহা মারা গেরে তিনি মিরদাস ইবনে আবি আমরকে বিয়ে করেন। এই দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে জন্মগ্রহণ করে দুই পুত্র- ইয়াযিদ ও মুয়াবিয়া এবং এক কন্যা উমরা।[৯][১০] তার এই স্বামী ছিলো দায়িত্বহীন অপচয়কারী প্রকৃতির। তার স্বামী তাদের সমস্ত অর্থ নষ্ট অপচয়, জুয়া খেলে শেষ করে ফেলে। ফলে খানসা তার ভাই শাখরের নিকট বিচার নিয়ে গেলো। কিন্তু তার ভাই শাখর ইবনে আমর স্ত্রীর বাঁধা স্বত্বেও তার সম্পদ থেকে অর্ধেক সম্পদ আল খানসাকে দান করেন। এর কিছুদিন পর তার স্বামী এ টাকাও বাজে কাজে ফুরিয়ে ফেলে নিঃশেষ হয়ে যায়, তারপর তার ভাই আবারো তার সম্পত্তি থেকে খানসাকে অর্ধেক দান করেন।[১১] এজন্য আল খানসা তার ভাইদের অন্ত্যন্ত ভালোবাসতেন।
ভাইদের মৃত্যু
সম্পাদনা৬১২ সালে তার ভাই মুয়াবিয়া ইবনে আমর অন্য গোত্রের এক ব্যক্তির হাতে নিহত হন। আল খানসা চাইতেন যাতে তার আরেক ভাই শাখর ইবনে আমর অন্যজনের হত্যার প্রতিশোধ নেন। শাখর এই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এসময় শাখর ইবনে আমর, আবু সাওর আল আসাদি নামে এক ব্যক্তির তীরে আহত হন এবং আঘাতজনিত কারণে এক বছর পর মারা যান।[১২] আল খানসা তার ভাই সৎ ভাই শাখরের মৃত্যুর পর কবিতায় নিজের শোক ফুটিয়ে তোলেন এবং কবিতার গঠনের কারণে খ্যাতি অর্জন করেন।
ইসলাম গ্রহণ
সম্পাদনা৬২৯ সালে তিনি মুহাম্মদ এর সাথে সাক্ষাত করেন ও ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সাক্ষাতে তিনি মুহাম্মাদ স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান। মুহাম্মাদ কবিতা শুনে অভিভূত ও বিস্ময় হন এবং প্রশংসা করেন।[৩][১৩]
আবু বকরের আমলে
সম্পাদনামুহাম্মাদ মৃত্যুবরণ করার পরে খানসা একদিন উম্মুল মুমীনিন আয়িশার নিকট গেলেন,তখনো তার মাথায় তার ভাই হারানোর চিহ্ন হিসাবে মাথায় কালো কাপড় বাঁধা ছিলো। এটা দেখে আয়িশা তাকে এটা করতে নিষেধ করেন। তখন খানসা তার জীবনের দুঃখের ও ভাইদের অবদানের কাহিনী শোনান।[১৪]
উমরের আমলে
সম্পাদনাদ্বিতীয় খলিফা উমরের খিলাফতকালের কোন এক সময় খানসা গেলেন খলীফার দরবারে। তখন তার বয়স ৫০ বছর এবং তখনো তিনি মৃত ভাইয়ের জন্য শোক প্রকাশ করে চলেছেন। তার দুই চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে ঝরতে গালে দাগ পড়ে যায়। খলিফা দাগের কথা জিজ্ঞেস করলে খানসা বলে এটা আমার ভাইদের শোকে কান্নার দাগ।[১৫] খলিফা বললেন, তাদের জন্য এত শোক কেন, তারা তো জাহান্নামে গেছে! খানসা তখন উত্তর করলেন, পূর্বে তাদের রক্তের বদলার জন্য কাঁদতাম, আর এখন কাঁদি তাদের জাহান্নামের আগুনের জন্য।[১৬][১৭]
১৬ হিজরিতে খলিফা উমারের খিলাফতকালে সংঘটিত হয় মুসলিম বাহিনী ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে কাদেসিয়ার যুদ্ধ। যুদ্ধের পূর্ব রাতে তার সন্তানদের উৎসাহ ও দিকনির্দেশনামূলক ইতিহাস প্রসিদ্ধ বক্তব্য দেন। সেটা ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়েছে। তার মর্মকথা হচ্ছেঃ “আমার প্রিয় সন্তানগণ! তোমরা আনুগত্য সহকারে ইসলাম গ্রহণ করেছো এবং হিজরত করেছো স্বেচ্ছায়। সেই আল্লাহর নামের কসম, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। নিশ্চয়ই তোমরা একজন পুরুষেরই সন্তান, যেমন তোমরা একজন নারীর সন্তান। আমি তোমাদের পিতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, তোমাদের মাতুল কুলকে লজ্জায় ফেলিনি এবং তোমাদের বংশ ও মান-মর্যাদায় কোন রকম কলঙ্ক লেপনও করিনি। তোমরা জান, কাফিরদের বিপক্ষে জিহাদে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জন্য কত বড় সাওয়াব নির্ধারণ করে রেখেছেন। তোমরা এ কথাটি ভালো রকম জেনে নাও যে, ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের চেয়ে পরকালের অনন্ত জীবন উত্তম। মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: “হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ধারণ কর এবং মুকাবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সামর্থ হতে পার। (সূরা আল ইমরান-২০০) আগামীকাল প্রত্যুষে তোমরা শত্রু নিধনে দূরদর্শিতার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার সাহায্য কামনা করবে।“[১৮][১৯][২০]
মায়ের অনুগত ছেলেরা মায়ের উপদেশ সামনে রেখে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতেন থাকেন। এবং এক পর্যায়ে সকলেই শাহাদত বরণ করেন। তার সাহসী মা এই খবর শোনার পর যা বলেন তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
“সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাদেরকে শাহাদাত দান করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর আমি আমার রবের নিকট আশা করি, তিনি আখিরাতে তার অনন্ত রহমতের ছায়াতলে তাদের সাথে আমাকে একত্রিত করবেন।“[১৯][২১]
খলিফা উমার তার ছেলেদের জীবদ্দশায় প্রত্যেকেকে এক শো দিরহাম করে ভাতা দিতেন। শাহাদাতের পরেও তাদের ভাতা হযরত খানসার নামে জারি রাখেন। তিনি আমরণ সে ভাতা গ্রহণ করেন।[১৮][২০][২২]
কাব্য চর্চায় খানসা
সম্পাদনাআল খানসা তার কাব্য চর্চা জীবনের প্রথম দিকে মাঝে মধ্যে দুই চারটি শ্লোক রচনা করতেন। তার দুই ভাইকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদের অকাল মৃত্যুতে খানসা খুব দুঃখ পান। ইবনে কুতায়বা বলেন, শাখরের শোকে কাঁদতে কাঁদতে তিনি অন্ধপ্রায় হয়ে যান।[২৩] এরপর থেকেই খানসা তাদের স্মরণে শোকগাধা রচনা শুরু করেন এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।[৩]
প্রফেসর আর এ নিকলসন তার আবেগ-অনুভূতি বলেন, মর্মভেদী ও স্পষ্ট অনুভূতির অনুবাদ করা অসম্ভব, কিন্তু প্রানবন্ত আবেগ শক্তি এবং আবেগীয় শক্তি যা খানসার কবিতাকে আলাদা করে তোলে।[২৪]
তার কিছু কবিতা
সম্পাদনাআল খানসা আরবের সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তার কিছু কবিতা স্বরূপ।
- তার ভাই শাখরের স্মরণে একটি কবিতা রচনা করেন যা সেই সময়ে খুব বিখ্যাত হয়েছিলোঃ
হে আমার দুই চোখ, উদার হও, কার্পণ্য করোনা ।
তোমরা কি দানশীল শাখরের জন্য কাঁদবে না?
তোমরা কি কাঁদবে না তার মত একজন সাহসী ও সুন্দর পুরুষের জন্য?
তোমরা কি কাঁদবে না তার মত একজন যুব-নেতার জন্য?
তার অসির হাতল অতি দীর্ঘ!
ছাইয়ের স্তূপ বিশালকায়।
সে তার গোত্রের নেতৃত্ব তখনই দিয়েছে যখন সে ছিল অল্প বয়সী।
যখন তার গোত্র কোন সম্মান ও গৌরবময় কর্মের দিকে হাত বাড়িয়েছে, সেও দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সুতরাং সে সম্মান ও সৌভাগ্য নিয়েই চলে গেছে।
তুমি দেখতে পাবে যে, সম্মান ও মর্যাদা তার বাড়ীর পথ বলে দিচ্ছে।
সর্বোত্তম মর্যাদও তার প্রশংসা করা উচিত বলে মনে করে।
যদি সম্মান ও আভিজাত্যের আলোচনা করা হয় তাহলে তুমি তাকে মর্যাদার চাদর গায়ে জড়ানো অবস্থায় দেখতে পাবে।।“
- তৎকালীন আরব নারীদের অভ্যাস ও প্রথা অনুযায়ী খানসা তার ভাইয়ের কবরের পাশে সকাল সন্ধ্যায় গিয়ে বসতেন, তাকে স্মরণ করে কবিতা রচনা ও করে মাতম করতেন।[২৫]
প্রতিদিনের সূর্যোদয় আমাকে শাখরের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়।
আর আমি তাকে স্মরণ করি প্রতিটি সূর্যাস্তের সময়।
যদি আমার চারপাশে নিজ নিজ মৃতদের জন্য প্রচুর বিলাপকারী না থাকতো,
আমি আত্মহত্যা করতাম।
- তার ভাই শাখরের সাহায্যকে স্মরণ করে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন।
ওহে শাখর!
যদি তুমি আমার দুই চোখেকে কাঁদিয়ে থাকো, তাতে কি হয়েছে?
তুমি তো একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমাকে হাসিয়েছো!
আমি তোমার জন্য কেঁদেছি একদল উচ্চকণ্ঠে বিলাপকারীদের মধ্যে।
অথচ যারা উচ্চকণ্ঠে বিলাপ করে তাদের চেয়ে উচ্চকণ্ঠে বিলাপ করার আমিই উপযুক্ত।
তোমার জীবনকালে তোমার দ্বারা আমি বহু বিপদ-আপদ দূর করেছি।
এখন এই বড় বিপদ কে দূর করবে?
যখন কোন নিহত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা খারাপ কাজ,
তখন তোমার জন্য কান্নাকে আমি একটি খুবই ভালো কাজ বলে মনে করি।
- তার ভাই শাখরের মান ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন
বড় বড় নেতৃস্থানীয় মানুষ সাখরের অনুসরণ করে থাকে।
শাখর এমন একটি পাহাড় সদৃশ যার শীর্ষদেশে আগুন জ্বলছে।[২৬]
- শাখরের স্মরণে তিনি নিচের শোকগাঁথাটিও রচনা করেন
ওহে আমার চোখের কি হয়েছে, ওহে তার কী হয়েছে?
সে তার জামা অশ্রু দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে।
আস-শারীদের বংশধর !শাখরের মৃত্যুর পর যমীন কি তার ভারমুক্ত হয়েছে?
অতপর আমি একজন ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্যক্তির প্রতি সমবেদনা প্রাকাশের জন্য শপথ করে বসেছি।
আর কান্নারত অবস্থায় প্রশ্ন করছি- তার কী হয়েছে?
সে নিজেই সকল দুখ-কষ্ট বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং আমার নিজের জন্য ভালো কষ্টগুলো অধিক উপযোগী।
আমি নিজেকে একটি পথ ও পন্থায় বহন করবো- হয়তো তা হবে তার বিপক্ষে অথবা পক্ষে।
- একবার খানসাকে তার দুই ভাইয়ের গুণের ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন।
আল্লাহর কসম!
শাখর ছিল অতীত সময়ের একটি ঢাল
এবং পাঁচহাতি নেয়ার বিষাক্ত লাল ফলা।
আর আল্লাহর কসম, মুয়াবিয়া যেমন বক্তা, তেমনি করিৎকর্মাও।
শাখর হচ্ছে শীতকালের উষ্ণতা, আর মুয়াবিয়া হচ্ছে বাতাসের শীতলতা [মর্যাদার ব্যপারে]
শাখর! সে তো হৃদপিণ্ডের কম্পন। আর মুয়াবিয়া হচ্ছে শরীরের জ্বর [ শোকের ব্যপারে]
তারা দুইজন হলো দুঃসাহসী রক্তলাল পাঞ্জাওয়ালা সিংহ!
রুক্ষ মেজাজ ক্রদ্ধ কালচক্রের মধ্যে দুইটি সাগর, সভা-সমাবেশে দুইটি চন্দ্র,
সম্মান ও মর্যাদায় অত্যুচ্চ,পাহাড়ার মত নেতা ও স্বাধীন ।[২৭]
তার এসব কবিতা ইসলাম পূর্ব গোটা আরবে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবিতা রচয়িতা হিসেবে খ্যাতনামা লাভ করেন।
কবি হিসেবে খানসার স্থান
সম্পাদনাআরবী কবিতায় প্রায় সকল অঙ্গনে খানসার বিচরণ দেখা যায়। তবে মরসিয়া রচনায় তার জুড়ি মেলা ভার।
- আল্লামা ইবনুল আসির বলেছেন, “আরবী কাব্যশাস্ত্রের পণ্ডিতরা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, খানসার পূর্বে ও পরে তাঁর চেয়ে বড় কোন মহিলা কবির জন্ম হয়নি।“[৩]
- আব্বাসীয় যুগের কবি বাশশার ইবনে বুরদ বলেন, আমি যখন মহিলা কবিদের কবিতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তখন তাদের প্রত্যেকের কবিতায় একটা না একটা দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করি। লোকেরা প্রশ্ন করলো: খানসার কবিতারও কি একই অবস্থা? বললেন : তিনি তো পুরুষ কবিদেরও উপরে।[২৮]
- সকল আরব উমাইয়া কবি খানসাকে আরব মহিলা কবিদের মাথার মুকুট জ্ঞান করেছেন।
- আধুনিক যুগের মিসরীয় পণ্ডিত ডঃ উমার ফাররূখ খানসার বলেছেন, “খানসা সার্বিকভাবে শ্রেষ্ট আরব কবি। তাঁর কবিতা সবই খণ্ড খণ্ড। অত্যন্ত, বিশুদ্ধ, প্রাঞ্জল, সূক্ষ্ম, শক্ত গঠন ও চমৎকার ভূমিকা সংবলিত। তার কবিতায় গৌরব গাথার প্রাধান্য অতি সামান্য। তার মরসিয়ার অর্থ স্পষ্ট, সূক্ষ্ম ও কোমল এবং আবেগ-অনুভূতির সঠিক মুখপত্র। দুই ভাইয়ের প্রশংসায় অতিরঞ্জন থাকা সত্ত্বেও তা বেদুঈন পদ্ধতি ও স্টাইলের দিকে সঠিক।
- আরব শ্রেষ্ঠ কবি আল নাবিগা তার সম্পর্কে বলেন “আল খানসা জিন ও মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি (আরবি: الخنساء أشعر الجن والإنس)। [২৯]
মোটকথা, কাব্য শক্তি ও প্রতিভার দিক দিয়ে খানসার স্থান দ্বিতীয় স্তরের তৎকালীন আরব কবিদের মধ্যে অনেক উঁচুতে। তার কবিতার একটি দিওয়ান ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বৈরুতের একটি প্রকাশনা সংস্থা সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দিওয়ানটি ফরাসী ভাষায় অনুবাদ হয়।[৩০]
কাব্য বিতর্কে অংশগ্রহণ
সম্পাদনামক্কার দুমাতুল জান্দালে, ইয়ামেনের সানয়ার নিকটস্থ স্থানে, মক্কার উকাজ প্রভৃতি স্থানে কবিদের কবিতা চর্চা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান হতো।[৩১] এর মধ্যে উকাজের কাব্য মেলা সবচেয়ে রমরমা ও প্রসিদ্ধ ছিলো। উকাজের মেলাতে কবি আন নাবিগা আজ জুরইয়ানীর সভাপতিত্ব কবি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। সেই সময় তিনি আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন।[৩২] সেই সম্মেলনে সম্মান হিসেবে সবার থেকে আলাদা করার জন্য শুধু তার তাবুই লাল রঙে তৈরি করা হত।[৩৩] আরবের বড় বড় কবিগণ এ সম্মেলনে যোগ দিতেন এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। খানসা এই সকল মেলায় ও সমাবেশে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং উকাজ মেলায় তার মরসিয়া অপ্রতিদ্বন্দী বলে স্বীকৃতি পায়। তবে হিজরি ১২৯ সনে খারেজিদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার সময় উকাজ বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়।
একবার এক সম্মেলনে তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ তিন কবি আল আশা আবু বাসির, হাসসান ইবনে সাবিত ও আল খানসা যোগ দেন। প্রথমে আল আ‘শা, তারপর হাসসান সবশেষে খানসা কবিতা পাঠ করেন। সবশুনে সভাপতি আন নাবিগা খানসাকে লক্ষ করে বলেন,
“আল্লাহর কসম! এই একটু আগে যদি আল আশা আবু বাসির আমাকে তার কবিতা না শোনাতেন তাহলে আমি বলতাম, জিন ও মানুষের মধ্যে তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।“
আন নাবিগার এ মন্তব্য শুনে হাসসান দারুণ ক্ষুব্ধ হন এবং কবিদের মধ্যে বাক- বিতর্ক চলতে থাকে।[৩৪][৩৫][৩৬][৩৭]
মৃত্যু
সম্পাদনাআল খানসার মৃত্যু সন নিয়ে মতপার্থক্য আছে। একটি মতে, হযরত উসমানের খিলাফতকালের সূচনা পর্বে ২৪ হিজরি / ৬৪৪- ৪৫ খ্রিস্টাব্দ সনে তিনি মারা যান। প্রক্ষান্তরে অপর একটি মতে, ৪২ হিজরি/ ৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের কথা এসেছে।[২২]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Ayyildiz, Esat (২০২০-০৬-৩০)। "El-Hansâ' Bint 'Amr: Eski Arap Şiirinde Öncü Bir Mersiye Şairi Hanım"। Mütefekkir (তুর্কি ভাষায়)। 7 (13): 201–224। আইএসএসএন 2148-8134। ডিওআই:10.30523/mutefekkir.757993। ২০২০-০৭-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-২৩।
- ↑ [সাহাবিয়াত-পৃ.১৮১]।
- ↑ ক খ গ ঘ [উসুদুল গাবা-৫/৪৪১]।
- ↑ [আল-ইসাবা-৪/২৮৭]।
- ↑ [ড:উমার ফাররূখ]।
- ↑ [তারিখ আল-আদাব-১/৩১৭]।
- ↑ [ইবন কুতায়বা : আশ-শি‘রু ওয়াশ শু‘আরাউ-পৃ.১৬০]।
- ↑ [আলা-ইসাবা-৪/২৮৭]।
- ↑ [আস-সুয়ূতী : দাররুল মানছুস, পৃ.১১০]।
- ↑ [আশ-শি‘রু ওয়াশ শু‘আরাউ, পৃ.১৬০]।
- ↑ [ড: উমার ফাররূখ ০১/৩১৭]।
- ↑ [আল-ইসতী‘আব (আল-ইসাবার পার্শ্ব টিকা)-৪/২৯৬]।
- ↑ [আল-ইসাবা-৪/৫৫০]।
- ↑ [প্রাগুক্ত; আল-ইসাবা-৪/২৯৬]।
- ↑ [ড: উমার ফাররূখ-১/৩১৭]।
- ↑ [আল-ইকদূল ফারীদ-৩/২৬৬]।
- ↑ [আশ-শিরু ওয়াশ শু‘আরাউ-১৬১]।
- ↑ ক খ [আল-ইসাবা-৪/২৮৮]।
- ↑ ক খ [জামহারাতুল খুতাবিল আরাব-১/২৩১]।
- ↑ ক খ [খাযানাতুল আদাব-১/৩৯৫]।
- ↑ [উসুদুল গাবা-৫/৪৪২]।
- ↑ ক খ [ড: উমার ফাররূখ-১/৩১৮]।
- ↑ [আশ-শি‘রু ওয়াশ শু‘আরাউ-১৬১]।
- ↑ [আরবের একটি সাহিত্য ইতিহাস- পৃষ্ঠা 126]।
- ↑ [সাহাবিয়াত-১৮৪]।
- ↑ [আশ-শি‘রু ওয়াশ-শু‘আরাউ-১৬২]।
- ↑ [প্রাগুক্ত-৩/২৬৭]।
- ↑ [তাবাকাত আশ-শু‘আরাউ-২৭১]।
- ↑ Ibn Qutaybah, al-Shiʿr wa-al-shuʿarā’ (Beirut, 1964)
- ↑ [সাহাবিয়াত-১৮৮]।
- ↑ [সিফাতু জাযীরাতুল আরাব-২৬৩]।
- ↑ [সাহাবিয়াত-১৮৬]।
- ↑ [আস-শিরু ওয়াশ শু‘আরাউ-১৬০]।
- ↑ [আশ-শিরু ওয়াশ শুয়ারাউ-১৬০]।
- ↑ [আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানী : কিতাবুল আগানী-১১/৬]।
- ↑ [আল-আগানী-৯/৩৪০]।
- ↑ [কাদুমা ইবন জা‘ফার : নাকদুশ শি‘র-পৃ. ৬২]।